শিক্ষার্থীদের ডাকা কোটা সংস্কার আন্দোলন চলছে। তারা ঘোষণা দিয়েছেন, বুধবার হবে সর্বাত্মক ‘ব্লকেড’। এর আগে রবি ও সোমবার ‘বাংলা ব্লকেড’ দেখেছি। ঢাকা শহরের অচলাবস্থার প্রভাব অন্তত অফিসে আসা-যাওয়ার পথেও টের পেয়েছি। বলা বাহুল্য, শিক্ষার্থীরা শুধু রাজধানীকেই অচল করেননি, বরং দেশজুড়ে কোটা সংস্কারের আন্দোলন ছিল স্বতঃস্ফূর্ত। মাসখানেক ধরে সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের এ আন্দোলন করছেন প্রধানত কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং চাকরিপ্রার্থীরা। কোটার বিষয়টি ২০১৮ সালে ‘সুরাহা’ হলেও চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিলের সেই আন্দোলন নতুন করে ফিরে আসে। কারণ ২০১৮ সালে নবম থেকে ১৩তম গ্রেড তথা প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিল করে পরিপত্র জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন সেই পরিপত্র বাতিল করেছেন উচ্চ আদালত।
আগের মতো কোটা চালু হওয়া মানে মেধাবীরা বৈষম্যের শিকার হবেন। সে জন্যই ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের’ ব্যানারে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিচ্ছেন– ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের মূলকথা, সুযোগের সমতা’, ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’, ‘একাত্তরের বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’। কোটা কত বড় বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ৫৬ শতাংশ কোটা চালু থাকার অর্থ হলো, মেধাবীদের পিছিয়ে পড়া। আর কোটা প্রয়োজন কাদের জন্য? সাবেক সচিব একেএম আব্দুল আউয়াল মজুমদার সমকালকে বলেছেন, ‘আমার গবেষণা ও দীর্ঘ চাকরিজীবনের অভিজ্ঞতা থেকে অভিমত হলো, এখনকার বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী ছাড়া আর কোনো কোটাই থাকা উচিত নয়। সরকারি চাকরির ৯৫ ভাগই মেধাভিত্তিক হওয়া দরকার।’
আন্দোলনকারীদের দাবি স্পষ্ট। তারা ২০১৮ সালের কোটা পদ্ধতি বাতিল ও মেধাভিত্তিক নিয়োগের পরিপত্র বহাল রাখার কথা বলছেন। সেই পরিপত্রে শুধু প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির কথা বলা ছিল; এবার আন্দোলনকারীরা সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাদ দেওয়ার দাবি তুলেছেন। তবে তারা সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী কোটা রাখার পক্ষে। অবশ্য সে ক্ষেত্রে সরকারি চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় কোটা সুবিধা একাধিকবার ব্যবহার করা যাবে না এবং কোটায় যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে শূন্যপদগুলোতে মেধা অনুযায়ী নিয়োগ দেওয়ার দাবি তুলেছেন। পাশাপাশি তাদের দাবি দুর্নীতিমুক্ত, নিরপেক্ষ ও মেধাভিত্তিক আমলাতন্ত্র নিশ্চিত করা।
আমাদের দুর্ভাগ্য, কোটার বিষয়টি চূড়ান্তভাবে ২০১৮ সালেই সমাধান হতে পারত। তখন আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল কোটা সংস্কার; কিন্তু তা না করে যেভাবে পুরোপুরি বাতিল করা হয়, তখনই বোঝা গিয়েছিল যে বিষয়টি পুনরায় সংকট তৈরি করবে। তা ছাড়া তখন সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় গ্রেড থেকেই কেবল কোটা বাতিল হয়। যাহোক, কোটার সেই সংস্কারের সুযোগ এখনও শেষ হয়ে যায়নি।
তরুণদের আন্দোলনের মাধ্যমে কোটা সংস্কার করে আমাদের সমাজ ও দেশকে বৈষম্যমুক্ত করার এই সুযোগ গ্রহণ করা দরকার। আন্দোলনকারীরা অতিরিক্ত কোনো সুযোগ-সুবিধা চাইছেন না। পরীক্ষা ছাড়া চাকরির নিয়োগও দাবি করছেন না। তাদের দাবিকে ভিন্নভাবে দেখার সুযোগ নেই। কিন্তু এতদিন ধরেও সরকার আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যে বসছে না, সেটাই বিস্ময়কর। আন্দোলনকারীদের চার দফা দাবি যথার্থ। তাদের সঙ্গে বসলে নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধা কোটা নিয়েও আলোচনা হতে পারে। মুক্তিযোদ্ধাসহ সুবিধাবঞ্চিত ও প্রতিবন্ধী মিলে ১০ শতাংশের মধ্যে কোটা সীমাবদ্ধ থাকলে তা সর্বজনগ্রাহ্য হতে পারে।
উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরির বাজার এমনিতে তরুণদের জন্য সীমিত। এর মধ্যে যারা প্রজাতন্ত্রের সেবা করতে চান, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করতে চান, তাদের সামনে একদিকে কোটার বাধা, অন্যদিকে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও অনিয়ম থেমে নেই। এ পরিস্থিতিতে দেশের তরুণ প্রজন্ম কতটা হতাশ বলার অপেক্ষা রাখে না। সে জন্য বড় একটা অংশ বিদেশমুখী। এভাবে মেধাবীরা চলে গেলে দেশ ‘ব্রেন ড্রেনের’ শিকার হবে। তারপরও তারুণ্যের বড় অংশ এই আন্দোলন করে আশা জাগিয়ে রাখতে চায়। বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াই করেই তারা টিকতে চায়। তাদের সাধুবাদ জানাতেই হবে। ফেসবুকে আমার এক শিক্ষক যথার্থই লিখেছেন, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের ‘হাইকোর্ট’ দেখানো অনুচিত। তাদের সঙ্গে দ্রুত বসেই সমাধানে আসা জরুরি।
সমকাল অনলাইনে প্রকাশ: ৯ জুলাই ২০২৪– কোটা আন্দোলনকারীদের ‘হাইকোর্ট দেখানো’ হচ্ছে কেন? (samakal.com)