Mahfuzur Rahman Manik
জ্বালানি নিরাপত্তা : সংকট ও সম্ভাবনা
এপ্রিল 4, 2010

সংবাদপত্রগুলো যখন শিরোনাম করছে-‘দু:সহ নগর জীবন’ কিংবা-‘বিদ্যুত গ্যাস পানি তিন সমস্যায় রাজধানি’, তখন বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীর আহবান-‘কৃষকদের কথা ভেবে নগরবাসিকে ধৈর্য্য ধরতে হবে’। বাস্তবতা হলো সেদিনই (২৪ মার্চ) চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নড়াইল, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুতের জন্য বিক্ষোভ করেছে কৃষকরা, সংশ্লিষ্ট বিদ্যুত অফিস ভাংচুর করেছে। এর আগের সংবাদ হলো সিরাজগঞ্জে লোভোল্টেজের কারনে পুড়ে গেছে শতাধিক মোটর, বিদ্যুত সমস্যায় বরিশালে বোরো আবাদ হুমকিতে , টাঙ্গাইল, ঝালকাঠি, কুমিল্লাসহ গোটা দেশের বোরো আবাদের অবস্থা একই রকম। বিদ্যুত নেই। এ বোরোর মওসুমে কৃষকদের নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত দেয়ার অঙ্গীকার করেছিলো সরকার। অথচ কৃষকরা দিনেতো বিদ্যুত পানইনা আর রাত ১১ টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুত দেয়ার কথা থাকলেও , এ সময়ে বিদ্যুত থাকে মাত্র ২ ঘন্টা। এতে গোটা দেশেই বোরোর আবাদ হুমকিতে, বোরো চাষে মনযোগ দেয়ার কথা থাকলেও কৃষক এখন বিদ্যুতের আন্দোলনে রাস্তায়।শহরগুলোতে লোডশেডিং তীব্র, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রীসহ অন্যান্য মন্ত্রী ও কর্তা ব্যক্তিরা বলছেন সেচ কাজের জন্য বিদ্যুত মিলছেনা শহর গুলোতে। এখন শহরেও বিদ্যুত নেই আর সেচ কাজের অবস্থা বা কৃষকদের অবস্থাও এই। এ চিত্রটা একজন কার্টুনিস্ট (সাপ্তাহিক বুধবার ১৭ মার্চ) চমৎকার এঁকেছেন, আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় এক জন, তার দুইপাশে দুইটা মুখ, একপাশে কৃষক আরেক পাশে শ্রমিক। কৃষক কাঁচি নিয়ে বিদ্যুতের জন্য বিক্ষোভ করছে। তাকে বলছেন, শিল্প উৎপাদনের কথা ভেবে একটু ধৈর্য্য ধরুন। অন্য পাশের শ্রমিক মোমবাতি নিয়ে বিদ্যুৎ চাচ্ছে। তাকে বলছেন; কৃষি উৎপাদনের কথা ভেবে একটু ধৈর্য্য ধরুন। কার্টুনের বা¯তব চিত্রই আমরা দেখছি। মূল সমস্যা বিদ্যুৎ। প্রয়োজনে বিদ্যুৎ নেই। কারণ বিদ্যুতের উৎপাদন কম। কৃষকদের বোরো চাষ গরম মৌসুম অন্যান্য কাজে এখন বিদ্যুাতের চাহিদা সাড়ে পাঁচ হাজার থেকে ছয় হাজার মেগাওয়াট, বিদ্যুৎ উৎপাদন হচ্ছে ৩ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট হতে ৪ হাজার ২০০ মেগাওয়াট। ফলে বিদ্যুৎ ঘাটতি পনেরশ হতে দুই হাজার মেগাওয়াট। ঘাটতি পনেরশ কিংবা দুই হাজার মেগাওয়াট হলে ও বর্তমান ভয়াবহ লোডশেডিং এ মনে হয় আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন ২ হাজার মেগাওয়াটের উর্ধে নয়। কৃষকের বোরো চাষের জন্য এ মৌসুমে বিদ্যুতের বাড়তি চাহিদার কথা সকলের জানা। সরকার আগ থেকেই কৃষকদের আশ্বাস দিচ্ছে, এ মৌসুমে বিদ্যুতের কোন সংকট হবে না, অšতত বোরো চাষের কোন ক্ষতি হবে না। বা¯তবতা হলো সরকারের এ আশ্বাস কৃষকের সাথে প্রতারণা বৈ কিছু নয়। এবার ৪৮ লাখ হেক্টর জমিতে এককোটি ৮৭ লাখ মেট্রিকটন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করা হয়। এর জন্য ২লাখ ৫৯ হাজার ৪৪টি সেচ পাম্প (বিদ্যুৎ মন্ত্রনালয়ের তথ্য মতে) চালাতে অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজন ১ হাজার ৬৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। সব মিলিয়ে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ৬ হাজার মেগাওয়াটের ওপরে। উৎপাদন সর্বোচ্চ ৪ হাজার ২০০ (পিডিবির মতে) মেগাওয়াট। ঘাটতি মেটাতে সরকার রেন্টাল বা ভাড়ায় চালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প হাতে নিয়েছিলো। ব্যয় বহুল ফার্নেস তেল এবং ডিজেলে চালিত ৮টি রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের টেন্ডার আহবান করে। আটটি কেন্দ্রের পাঁচটি কেন্দ্রের দরপত্র মন্ত্রি সভার ২৩ ডিসেম্বরের বৈঠকে অনুমোদন পায়। তিনটি কেন্দ্রের চুক্তি পিডিবি ৪ ফেব্রুয়ারি মাত্র সম্পন্ন করে। এগুলো হলো নোয়াপাড়া, উৎপাদন ক্ষমতা ১০৫ মেগাওয়াট, ঠাকুর গাঁও ৫০ মেগাওয়াট এবং ভেড়ামারা ১১০ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন। এগুলো থেকে বিদ্যুত আসতে ন্যূনতম চার মাস সময় লাগবে। অথচ এখনি বোরোর সর্বোৎকৃষ্ট সময়। আগামী মাসেই বোরোর মৌসুম শেষ হচ্ছে। কৃষকের জন্য এ রেন্টাল বা ভাড়ায় চালিত প্রকল্প গুলো হাতে নিলেও কৃষকরা এখান থেকে উপকৃত হতে পারছে না। এ রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন অত্যšত ব্যয়বহুল। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে এ রেন্টাল পদ্ধতির কথা না থাকলেও আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, সরকারের কৃষকদের বিদ্যুত চাহিদা মেটানোর জন্য এ পদ্ধতি গ্রহণ করে বাহবা কুড়ানো ছাড়া অন্যকোন উদ্দেশ্য নেই। অবশ্য সেটাও ভে¯েত গেছে। এটি কৃষকের সাথে সরকারের স্পষ্ট প্রহসন। কৃষকরাতো এতে লাভবান হচ্ছেনইনা অন্যদিকে এ বিদ্যুৎ উৎপাদকেরা অতিরিক্ত দামে বিদ্যুৎ বিক্রি করে ব্যাপক মুনাফা লাভ করবে। সরকার অযথাই এখানে হাজার হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিবে। জনগনের টাকা সরকারের দিতে কী।রেন্টাল পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ ঘাটতির বিষয়টি ১৯৯৬ সালে প্রথম আলোচনায় আসে। তখন বা¯তবায়ন না হলে ও এখন সেটার বা¯তবায়ন হচ্ছে। বিদেশ থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ভাড়া এনে এ প্রকল্পে বিদ্যুৎ উৎপাদনে ইউনিট প্রতি ২টাকার স্থলে খরচ হবে ১২-১৩ টাকা। অথচ এ প্রকল্পে উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমান মাত্র ২৬৫ মেগাওয়াট মাত্র, এ অল্প পরিমান বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকার এতো টাকা গচ্ছা দিচ্ছে কেন তা কারোর কাছেই স্পষ্ট নয়।সরকার ২০১১ সালের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন ৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করার কথা বলেছে। কীভাবে করবে গ্যাস দিয়ে? সরকারের গত এক বছরের কার্যকলাপে সেটাই মনে হচ্ছে। অথচ গ্যাস সংকটই এখন বিদ্যুৎ সমস্যার প্রধান কারন। এখন বাংলাদেশের অধিকাংশ বিদ্যুৎ কেন্দ্রই গ্যাস ভিত্তিক। বর্তমানে ১৯টি গ্যাস ক্ষেত্রের ৭৯টি কূপ থেকে গ্যাস উৎপাদিত হচ্ছে। এসব গ্যাস ক্ষেত্রের উৎপাদন ক্ষমতা দুই হাজার মিলিয়ন (পেট্রোবাংলার মতে) ঘটফুট। শিল্প কারখানা, বেসরকারি, সরকারি, গৃহস্থালি, বিদ্যুত উৎপাদনসহ নানা কাজে গ্যাসের চাহিদা ৩ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। গ্যাসের ঘাটতি এতে প্রতিদিন ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। গ্যাসের এ ঘাটতি থাকতে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে অর্থহীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী গ্যাসের নিরাপত্তার গ্যারান্টি ছাড়াই সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১২০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্টের একটি ইউনিট উদ্বোধন করেন। সেখানে গ্যাস স্বল্পতার কারনে পরদিনই উৎপাদন ৫০ মেগাওয়াটে নেমে আসে। সরকারের দাবি, তারা এ প্রকল্পটি সহ এ সময়ের মধ্যেই জাতীয় গ্রীডে ৫৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ গ্যাস চালিত হলে ও এসব প্রকল্পের কাজ আগ থেকেই শুরু হয়, সরকার শুধু উদ্বোধন করেছে মাত্র। সরকার গ্যাস ভিত্তিক আরো দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করে। চাঁদপুর ও সিলেট ১৫০ মেগাওয়াট করে মোট ৩০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের চুক্তিই বিশেষজ্ঞদের কাছে বর্তমান সরকারের সরকারিখাতে নতুন কোন বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের প্রথম চুক্তি। গ্যাস রেশনিং, গ্যাসের জন্য সিএনজি ষ্টেশনের অলস বসে থাকা কিংবা গৃহিনীরা যেখানে রান্না করতে গ্যাস পাচ্ছে না। সেখানে গ্যাস ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র কতটা নির্ভরশীল সেটাই ভাবার বিষয়। এমনিতেই এখন চট্টগ্রামের গ্যাসের অভাবে রাউজানে ২১০ মেগাওয়াটের ২টি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ৫৬ ও ৬০ মেগাওয়াটের দুটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র শিকলবাহায় বন্ধ আছে। এছাড়া গ্যাস সংকটে অনেক কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও কমে গেছে। বিদ্যুাতের এ পরিস্থিতির কারনে রাজধানি ঢাকা সহ গোটা দেশেই ব্যাপক ভাবে বেড়েছে লোডশেডিং। গ্যাস সংকট তো আছেই সাথে সাথে দেখা দিয়েছে পানি সংকট। গ্যাস, পানি এবং বিদ্যুৎ সমস্যায় অস্থির জনজীবন। তারওপর চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহ। গনমাধ্যম গুলো এনিয়ে কয়েকদিন ধরেই প্রতিবেদন দিচ্ছে । কেউ বলছে ‘অসহ্য লোডশেডিং’ কারো ভাষায় ‘এক ঘন্টা বিদ্যুৎ এক ঘন্টা লোডশেডিং ২৪ ঘন্টা ভোগাšিত’ কারো শিরোনাম ‘বিদ্যুতের মিসড কল’ কিংবা ‘সারাদেশে বিদ্যুৎ সংকট’। বিদ্যুতের এসব যাওয়া আসা আর ভোগাšিতর অবসান হবেনা যতদিন না স্থায়ী কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়। সদিচ্ছার কারোই অভাব থাকে না কিংবা অঙ্গীকার করতে কেউ কম করেননা। কিন্তু কর্মে সেটা ফলে না, এর অন্যতম কারন দূর্নীতি। ১৯৮৮ সাল থেকে এরশাদ আমলে শুরু হওয়া দুর্নীতির ভূত মাঝখানের হাসিনা খালেদার সরকার এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকারকেও ছাড়েনি। প্রত্যেকের আমলেই বিদ্যুতের নামে কয়েক হাজার কোটি টাকার দূর্নীতি হয়েছে। এসব টাকা বিদ্যুত খাতে ঠিকভাবে খাটালে আজ আমাদের এতো সংকটও থাকতোনা।এ দূর্নীতির ফলে আরেকটা কাজ হয়েছে, বাংলাদেশ ২০০৮ সালে বিশাল এক ফান্ড থেকে বঞ্চিত হয়। গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফান্ড বা জিইএফ নামের এ তহবিল থেকে যে পরিমান অর্থ পাওয়া যেত বিশেষজ্ঞদের ধারনা যে ফান্ড দিয়ে ৭০০ মেগাওয়াট পরিবেশ বান্ধব বিদ্যুত ঊৎপাদন করা যেত। বিষয়টি হলো ১৯৯৬ সালে পাওয়ার সেল নবায়ন যোগ্য জ্বালানীর একটি নীতিমালা মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। সেটা অনুমোদিত হয় ১২ বছর পর ২০০৮ সালে সময়মতো এ নীতি বা¯তবায়ন হলে জিইএফ এর অর্থ পাওয়া যেত। যা দিয়ে ২৫০ মেগাওয়াট উইন্ড পাওয়ার সহ ১৫০ মেগাওয়াট সোলার বায়োগ্যাস থেকে ১৫০ মেগাওয়াট ও কো-জেনারেশন থেকে ১৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত পাওয়া যেত।বিদ্যুৎ সমস্যার অন্যতম কারণ হলো বিশ্বব্যাংক আইএমএফ সহ বিদেশিদের প্রেসক্রিপশন গ্রহণ। বিদ্যুতের রেন্টাল পদ্ধতিও এদেরই অন্যতম এজেন্ডা। লক্ষ্য হলো বিদেশী কোম্পানী গুলোর মুনাফা নিশ্চিত করা। এরা বিদ্যুৎ খাতে সংস্কারের নামে সরাকারি প্রতিষ্ঠান (পিডিবি) ভেঙ্গে কোম্পানি করার পরামর্শ দেয়। ফলে হয়েছে ডেসা, ডেস্কো, পল্লী বিদ্যুত, ডিপিডিসি ইত্যাদি। সরকারি প্রতিষ্ঠানের বাইরে এগুলো থেকে সরকার চড়া দামে বিদ্যুৎ ক্রয় করে জনগনকে অল্প দামে দিচ্ছে। এতে সরকারের ক্ষতি হচেছ হাজার হাজার কোটি টাকা। অথচ সরকার যদি এ টাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে না দিয়ে সরকারি প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতো। এতে বিদ্যুৎ সমস্যার সমাধান হতো। ইতিমধ্যে সরকার বিদ্যুাতের দাম একদফা বাড়িয়েছে ৪ থেকে ৭ ভাগ, বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে কার্যত কিছুই হয়নি। বিদ্যুত সমস্যাতো বেড়েছেই কার্যত মোটা অংকের লাভ করছে কোম্পানিগুলো। এ প্রসঙ্গে একটু বলে রাখি, বাংলাদেশ ব্যাংকের চেয়ারম্যান জনাব আতিউর রহমানকে ধন্যবাদ কারণ তিনি সম্প্রতি (২৪.০৩.০১) আইএমএফ এর দেয়া ঋনের প্র¯তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন। আইএমএফ বা বিশ্বব্যাংক ঋণদেয় শর্তে সেটা হলো তাদের ফর্মূলা অনুসারে বা¯তবায়ন। অতীতে বিদ্যুৎসহ সব কাজে তাদের ফর্মুলার অনুসরন করা হয়েছে, তাদের আনীত প্রেসক্রিপশনের বাইরে দেশের স্বার্থে কথা বলার মত যোগ্য মানুষ খুবই কম। এক্ষেত্রে তাদের ফর্মুলা বা¯তবায়নে আমাদের কী ক্ষতি, কিভাবে গ্রহণ করলে আমাদের লাভ, সে ব্যাপারে দরকষাকষি করার মত যোগ্য মানুষের ভীষন প্রয়োজন। আতিউর রহমান যদি তার সূচনা করেন নিশ্চয়ই সেটা দেশের জন্য সুখবর।বিদ্যমান বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে গত বছর সরকার ডেলাইট সেভিং টাইম চালু করেছিলো যা জনগনের কাছে ডিজিটাল টাইম হিসেবে পরিচিতি। এমাসের ৩১ তারিখ থেকে আবার সেটি চালুর পরিকল্পনা সরকারের ছিল। কিন্তু জনগন, বিশেজ্ঞসহ নানাজনের রাঁধায় সেটি আর চালু হচ্ছে না। বা¯তবে দরকার ও নেই। কারণ গতবছরের অভিজ্ঞতায়ই তার অসারতা প্রমান হয়েছে। সরকার (সিএফ এল) তথা কম্প্যাক্ট ফ্লুরোসেন্ট লাইট বাল্বের কথা বলেছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে এ বাল্ব কিছুটা হলেও ভূমিকা পালন করবে, সেটা যদি জনগনের কাছে পৌছানো হয়। বর্তমান বিদ্যুত কেন্দ্র গুলোর যন্ত্রপাতি মেরামত এবং পুরনো বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করে উৎপাদন কিছুটা বাড়ানো সম্ভব। গ্যাস সংকটে নতুন ক্ষেত্র অনুসন্ধান করে বঙ্গোপসাগর সহ সম্ভাবনাময় বিভিন্নস্থানে একাজ করা যেতে পারে। গ্যাসের উপর নির্ভর না থেকে কয়লার উপর নির্ভরতা বাড়ানো প্রয়োজন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশ্বে ৫৮ শ মিলিয়ন টন কয়লা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে ৭৫% ব্যবহৃত হয় বিদ্যুৎ উৎপাদন। চীন ভারত সহ পৃথিবীর অনেক দেশই কয়লা থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে খুব ভালোভাবেই। এজন্য আমাদের একটি সুষ্ঠু কয়লানীতি হওয়া আবশ্যক। দেশে এখনও কয়লনীতি চূড়াšত হয়নি। লেখাটা যখন লিখছি তখনও (২৫.০৩.১০) দেশের প্রথম ও চালু থাকা একমাত্র কয়লাখনি দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লা খনিতে চলছে শ্রমিক আন্দোলন। উৎপাদনের বদলে সেখানে বিরাজ করছে অস্থিরতা। শ্রমিকদের বেতন না বাড়নোর কারনে এ আন্দোলন। বলা হয় বাংলাদেশে ২০০/৩০০ কোটি মেট্রিকটন কয়লা মজুদ রয়েছে। যা দিয়ে অনায়াসেই দেশের বিদ্যুৎ সংকট মেটানো সম্ভব। কিন্তু আমাদের পরিকল্পনার অভাবে সে কাজ ভালোভাবে এগুচ্ছেনা । সুষ্ঠু কয়লা নীতিমালা করে দ্রুত আমাদের এ জ্বালানি সম্পদকে রক্ষা করা দরকার।বিদ্যুতের বিষয়ে ব্যক্তিগত উৎপাদন পদ্ধতিতে জনগনকে উৎসাহ দেয়া প্রয়োজন। এলাকা ভিত্তিক প্লান্ট স্থাপন, সেটা হতে পারে রিয়েল এষ্টেট কোম্পানী গুলোর এলাকা ভিত্তিক, কিংবা পৌরসভা সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বিদ্যুৎ উৎপাদন। এগুলোকে পরে জাতীয় গ্রীডের সাথেও যুক্ত করা যায়।বিদ্যুৎ উৎপাদনে রেন্টাল প্রক্রিয়া কিংবা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দেয়া কোন সমাধান নয়। ইতিমধ্যে এখাতে বিদেশি কোম্পানিকে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকার ভর্তুকি দেয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। এটা কখনো লাভজনক কিছু না। বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় উৎপাদন, বিতরন, সরবরাহ এতো বিভাজন না রেখে এ গুলোকে এক সংস্থায় করে দেখা যেতে পারে।গ্যাস কয়লা এগুলো অনবায়নযোগ্য শক্তি। এগুলোর মজুদ ও আমাদের বেশি না। ইতিমধ্যেই গ্যাস সংকট দেখা দিয়েছে। আমাদের গ্যাস সম্পদ যা মজুদ আছে তা দিয়ে হয়তো কয়েক বছর চলবে। এরপর যে সংকট আসছে তা অত্যাšত ভয়াবহ। বিশ্বব্যাপী এ জ্বালানী সংকট ঘনীভুত হচ্ছে। এগুলোর প্রতি আমাদের নির্ভরতা এখনি না কমালে, দেশের বিপদ অত্যাসন্ন। এজন্য তেল গ্যাস কয়লার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা করে এর বাইরের জ্বালানি সম্পদের দিকে নজর দেয়া অত্যšত জরুরি। এর বাইরে রিনিউয়েবল এনার্জি তথা নবায়নযোগ্য শক্তিই রয়েছে বিকল্প। এ শক্তির মাধ্যমে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন সহজসাধ্য, তেমনি কম খরচ এবং পর্যাপ্তও। এ শক্তি কখনো নিঃশেষ হবে না। অবশ্য এ নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে যে আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ যে শুরু হয়নি তা নয়। নবায়নযোগ্য শক্তি সমূহ হলো সৌরশক্তি, বায়ু প্রবাহ শক্তি, জলবিদ্যুৎ শক্তি, হাইড্রোজেন শক্তি, এছাড়া আরেকটি হতে পারে পারমানবিক বিদ্যুৎ শক্তি। বিকল্প শক্তি হিসেবে বাংলাদেশে জৈব গ্যাস প্রযুক্তি ও সম্ভাবনার। জলবিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহার করে দেশের কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ প্রকল্প চালু আছে। এখানে ৭টি ইউনিটের মোট উৎপাদন ক্ষমতা ২৩০ মেগাওয়াট। জল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের অšতর্ভূক্ত হিসেবে জোয়ার ভাটা কেন্দ্রিক বা তরঙ্গ বিদ্যুৎ পদ্ধতির কথাও বলা যায়। এসব পদ্ধতিতে ফ্রান্স, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য, নরওয়ে প্রভৃতি দেশ সমূহ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে থাকে। বাংলাদেশের বঙ্গোপসাগরকে কাজে লাগিয়ে তরঙ্গ শক্তির বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার করার সম্ভাবনা রয়েছে। সৌরশক্তির ব্যবহার ও আমাদের দেশে বাড়ছে। সূর্যের রশ্মি থেকে আহরিত শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বর্তমানে দেশে প্রতিদিন ১৫ মেগাওয়াট সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। এবং এ শক্তি ব্যবহার করে প্রায় ৮ লাখ বাড়ি আলোকিত হচ্ছে। এ পদ্ধতি প্রধানত গ্রীড লাইন থেকে দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকা সমুহ এবং চা বাগান গুলোতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। অথচ এ পদ্ধতিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের জন্য সহজ ও সুলভ। বিজ্ঞানীরা বলেছেন সূর্য এক বছরে পৃথিবীতে যে শক্তি সরবরাহ করে তা বিশ্বের পারমানবিক ফসিল জ্বালানি তথা কয়লা তেল, গ্যাস ইত্যাদির মিলিত শক্তির তুলনায় পনের হাজারগুন বেশি। হাইড্রোজেন শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন আমাদের দেশে শুরু না হলেও বায়ু প্রবাহ শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষুদ্র প্রয়াসে হলেও শুরু হয়েছে। এরমধ্যে গ্রামীন শক্তির কক্সবাজারের চকোরিয়া চিংড়ি খামারের স্থাপনা এবং ব্রাকের বিভিন্ন উপকূলী এলাকায় ১১টি টারবাইন স্থাপন অন্যতম। পারমানবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের কথা আওয়ামীলীগের ইশতিহারে রয়েছে। রূপপুরের এ পারমানবিক কেন্দ্রের ব্যাপারে চীন ও রাশিয়ার আগ্রহ আছে।ু সরকার সে আলোচনা নিশ্চয়ই চালিয়ে যাচ্ছে। তবে এ পদ্ধতি অত্যšত ব্যয়বহুল এবং পরিবেশের জন্য ও ঝুঁকিপূর্ন। এজন্য অনেকে একে স্বপ্নবিলাস বললে ও ২০১৭ সাল পর্যšত হয়তো আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। বিকল্প জ্বালানির কথা বললে জৈব গ্যাস প্রযুক্তিও সম্ভাবনাময়ী খাত। ১৯৯৬ গবাদি পশুছিল ২কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার। এগুলো থেকে যদি প্রতিদিন ২৪ কোটি পশু বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সে বর্জ্য দিয়ে প্রতিদিন অনেক জৈব গ্যাস উৎপাদন সম্ভব। এখন গবাদিপশুর পরিমান প্রায় ৫কোটি সুতরাং বলাই যায় এটা সম্ভব নয় ক্ষেত্র। প্রাকৃতিক সম্পদে ভরপুর আমাদের দেশে সম্ভাবনার কমতি নেই। এসব সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সম্পদে রূপাšতরিত করার মত জনসম্পদ আর দেশপ্রেমিক নাগরিকের অভাব রয়েছে। এসব কিছুকে কাজে না লাগালে আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ, সম্ভাবনার বাংলাদেশ বিদ্যুৎ বিহীন ঘরের মত অন্ধকারেই থেকে যাবে। তখন ডিজিটিাল বাংলাশের শ্লোগান অধরাই থেকে যাবে।

দৈনিক ডেসটিনিতে প্রকাশিত ১ এপ্রিল২০১০

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।