করোনার সময় লিখেছিলাম, ইন্টারনেট নির্ভরতার কাল। ২০২০-২১ সালে করোনাভাইরাসের প্রকোপের সময় ঘরে আবদ্ধ মানুষকে শান্তি দিয়েছিল ইন্টারনেট। কিন্তু এখন মানুষের উভয় সংকট– ঘরে নেই ইন্টারনেট, বাইরে কারফিউ। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া বাইরে বের হওয়ার সুযোগ নেই। ইন্টারনেট না থাকায় ঘরে থেকে বোঝার উপায় নেই, বাইরে কী হচ্ছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে সংবাদের যে বহুমুখী প্রবাহ ছিল, তাও বন্ধ। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত ৯টা থেকে এ লেখা পর্যন্ত (মঙ্গলবার বিকেল) দেশে ইন্টারনেট পুরোপুরি বন্ধ।
প্রাত্যহিক জীবনে আমরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে, এটি ছাড়া অল্প সময় কাটানোও প্রায় অসম্ভব। অথচ পাঁচ দিন ধরে ফেসবুকসহ কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই ঢোকা যাচ্ছে না। বর্তমান সময়ের জন্য এটা অবিশ্বাস্য। আগে দেখেছি, দেশে ফেসবুক বন্ধ হলেও কায়দা করে সেখানে ঢোকা যায়। শুক্রবার রাতে যখন এ সমস্যায় পড়লাম, তখন প্রযুক্তিতে অভিজ্ঞ কয়েকজন বন্ধুর শরণাপন্ন হলাম। অবশেষে নিশ্চিত হলাম, ইন্টারনেট আসলেই নেই এবং কোনোভাবে পাওয়ার সুযোগ নেই। অনলাইন সংবাদমাধ্যম বন্ধ। অনলাইনভিত্তিক কোনো অ্যাপসই চলছে না।
ইন্টারনেট না থাকায় নাগরিকরা বহুবিধ অসুবিধার সম্মুখীন হন। অনেকের জীবন-জীবিকার ভিত্তিই ইন্টারনেট। অনলাইনে বাজার তথা ই-কমার্স, ফ্রিল্যান্সিং, অনলাইন টিকিট ব্যবস্থা, রাইড শেয়ারিং অ্যাপ তো আছেই; সংবাদমাধ্যমসহ অধিকাংশ খাতও এখন বহুলাংশে ইন্টারনেটনির্ভর। পোশাকশিল্পসহ বিদেশে রপ্তানি কিংবা আমদানি উভয় যোগাযোগেই ইন্টারনেট প্রধান। ইন্টারনেট মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, জীবিকার বৈচিত্র্যপূর্ণ পথ উন্মুক্ত করেছে, অটোমেশনে কাজকর্মে সমস্যা কমেছে। বস্তুত ইন্টারনেটই গোটা বিশ্বকে একটি গ্রামে পরিণত করেছে। ইন্টারনেটের কল্যাণে বিভিন্ন অ্যাপের মাধ্যমে মোবাইল ফোন হয়ে উঠেছে সকল কাজের কাজি। এ সময়েই কিনা ইন্টারনেট নেই! ইন্টারনেট জরুরি বলেই নাগরিক সব অধিকারের সঙ্গে এটিও একটি অধিকার। তাই তা নিশ্চিত করার দায় কর্তৃপক্ষের ওপর বর্তায়।
ইন্টারনেট সাধারণত আমরা দু’ভাবে পাই– মোবাইল ডেটা ও ব্রডব্যান্ডের মাধ্যমে। ১৯ জুলাই শুক্রবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদনে এসেছে, ‘ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলক জানান, কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে সাময়িকভাবে মোবাইল ইন্টারনেট বন্ধ রাখা হয়েছে।’ খবরে আরও বলা হয়েছে, আগুনে সার্ভার ও কেবল ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ব্রডব্যান্ড আংশিক বন্ধের বিষয়টি সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। যদিও ব্রডব্যান্ড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর বক্তব্য, ব্যান্ডউইথ না পাওয়ায় তাদের সেবা বন্ধ। অবশ্য শনিবার বিকেলে মোবাইল ফোনে বার্তা আসে– ‘সন্ত্রাসীদের অগ্নিসংযোগের কারণে ডেটা সেন্টার পুড়ে যাওয়া এবং আইএসপির তার পুড়ে যাওয়ার কারণে সারাদেশে ইন্টারনেট সেবা ব্যাহত; মেরামত করতে সময় লাগবে।–পলক।’
কত সময় লাগবে? সোমবার থেকেই চাউর– ইন্টারনেট খুলে যাচ্ছে। মঙ্গলবার দুপুরেও ব্রিফিংয়ে ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জানান, রাত থেকেই সীমিত পরিসরে ইন্টারনেট খুলছে। ইন্টারনেট সেবা খুলতেই হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার পরও বিশেষত শুক্র ও শনিবার সহিংসতা থেমে ছিল না এবং এই দু’দিনও মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সরকারকে কারফিউ জারি করতে হয়েছে। সরকারের বক্তব্য– গুজবে কান দেবেন না। কিন্তু ইন্টারনেটের মাধ্যমে গুজব কিংবা অপতথ্য যতটা ছড়ায়, না থাকলে গুজব আরও বেশি ছড়াতে পারে। এর ফলে গুজবের নানামুখী ডালপালা যেমন গজাতে পারে, তেমনি অযথা মানুষের আতঙ্কিত হওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। যেখানে আমরা বলছি তথ্য অধিকার, সেখানে তথ্যের অবাধ প্রবাহ বন্ধ করলে হিতে বিপরীত হওয়াই স্বাভাবিক।
ইন্টারনেট ব্ল্যাকআউটের কারণে বিদ্যুৎ-গ্যাস রিচার্জ করতে না পারায় মানুষ যে ভোগান্তিতে রয়েছে, সেটা অবর্ণনীয়। বিশেষ করে ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ছাড়া জনজীবন একেবারে অচল। গ্যাসের বিকল্প ব্যবস্থা করা গেলেও বিদ্যুতের ব্যবস্থাপনা কঠিন। তা ছাড়া বিদ্যুতের সঙ্গে মোবাইল রিচার্জ, লাইট, ফ্যানসহ অনেক কিছুই যুক্ত। যে কারণে রিচার্জ সমস্যার সমাধানে বিদ্যুৎ অফিসে মানুষের দীর্ঘ সারির চিত্র সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এর আপাতত সমাধান দিয়েছে বটে, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ইন্টারনেটই ভরসা।
মঙ্গলবার পর্যন্ত ছিল সাধারণ ছুটি। সংবাদমাধ্যমের কর্মী হিসেবে যদিও আমাদের ছুটি নেই। এখন মানুষ সংবাদমাধ্যমের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল বলে আমরাও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার চেষ্টা করছি। আমাদের কাজের ক্ষেত্রেও ইন্টারনেট জরুরি। অফিস, আদালত, ব্যাংক ইত্যাদি খুললেও যেমন ইন্টারনেটের প্রয়োজন পড়বে, তেমনি মানুষের বাড়িতে অবস্থানকালেও ইন্টারনেট থাকার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। ঘরে-বাইরে দম বন্ধ পরিবেশ প্রত্যাশিত নয়। এই মুহূর্তে ইন্টারনেটও মানুষের মধ্যে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে পারে।
ইন্টারনেট না থাকার সময়ে যেন আমরা ‘চোখ থাকতেও অন্ধ’। তথ্যপ্রযুক্তির কালে এর বিকল্প কারও কাছে নেই। ডিজিটাল বাংলাদেশ কিংবা স্মার্ট বাংলাদেশের সরকারি বয়ানের সঙ্গেও ইন্টারনেট না থাকাটা সাংঘর্ষিক।
সর্বশেষ বলতে চাই, শিক্ষার্থীদের কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে সৃষ্ট সংঘাত-সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনার তদন্তের কথা বলা হচ্ছে। দোষীদেরও নাকি শাস্তি দেওয়া হবে। নিঃসন্দেহে তা ভালো উদ্যোগ। একই সঙ্গে ইন্টারনেট বন্ধের কারণে রাষ্ট্রের তো বটেই, জনগণেরও বিভিন্ন অংশের কার কতটুকু লাভ বা ক্ষতি হলো, সে চিত্রও সামনে আসা দরকার। তার ভিত্তিতে অন্তত সম্পূর্ণ ইন্টারনেট ব্যবসায়ীদের ক্ষতিপূরণ দেওয়াও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।