Mahfuzur Rahman Manik
স্বপ্ন ফেরি করা লাল বাস
জানুয়ারী 28, 2018

অপেক্ষা লাল বাসের জন্য। প্রতীক্ষাটা কত সময়ের? ক্লাস শেষ, বাস আসবে, সবাই হুড়মুড়িয়ে উঠবে। পাঁচ-দশ মিনিট কিংবা আধা ঘণ্টা। না! 'লাল বাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়' নামে ফেসবুক পেজে একজন লিখেছেন- '৬ মাস ধরে ডিইউতে [ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে] বসবাস করছি; লাল বাসে চড়ার ইচ্ছাটা কবে যে পূরণ হবে...।' ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার পরও হয়তো নানা কারণে তার লাল বাসে চড়ার সুযোগ হয়নি। তিনি এখনও সুযোগের অপেক্ষায়। তার অপেক্ষা মাত্র ছয় মাসের। কারও অপেক্ষা তো ১৯-২০ বছরের! একজন লিখেছেন, ১০টি কারণে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন, যার প্রথমটিই- লাল বাস।
লাল বাসের কী এমন মাহাত্ম্য যেটা স্বপ্ন হতে পারে? ঢাকার বুক চিরে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাল বাসগুলো কেবল দাপিয়েই বেড়ায় না, শিক্ষার্থী পরিবহনই করে না, বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজই করে না; বরং স্বপ্নও ফেরি করে বেড়ায়। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম অলঙ্কৃৃত ক্ষণিকা, চৈতালি, বৈশাখী-বসন্ত, উয়ারী-বটেশ্বর, হেমন্তসহ একঝাঁক লাল বাস যখন ঢাকার রাস্তায় চলে, তখন হাজার হাজার কিশোর-কিশোরীর মনে স্বপ্ন জাগায়; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার প্রেরণা দেয়।
চোখ-ধাঁধানো লাল রঙের বাস দেখার পর হয়তো তা অনেকক্ষণ মানসপটে ভেসে থাকে। বাসের রঙ লাল হওয়ার বিশেষত্ব কি এখানেই? জানা নেই। তবে এটা জানা যে, বিশ্বের অনেক দেশেই স্কুল বাসের একটা বিশেষ রঙ আছে- হলুদ। হলুদ হওয়ার কারণ আছে অবশ্য। নিউইয়র্ক টাইমসের ব্লগে 'হোয়াই স্কুল বাস নেভার কামস ইন রেড অর গ্রিন' শিরোনামে একজন লিখেছেন, হলুদ রঙ ভোলার নয়। শিশুরা রঙটা সহজে মনে রাখতে পারে; একই সঙ্গে বিভিন্ন আবহাওয়ায় হলুদ রঙে কোনো পরিবর্তন হয় না। ফলে হলুদ রঙের বড় গাড়ি রাস্তা দিয়ে চললে মানুষ বুঝে নেয়- এটা স্কুল বাস। ঠিক তেমনি ঢাকা শহরে লাল রঙের বিশেষ গাড়ি চললে নাম না দেখেও অনেকে বলে দিতে পারেন, এটা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস।
একতলা বা দোতলা বিশিষ্ট লাল বাস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর তুলনায় অপ্রতুল। তারপরও কয়েক শিফটে বিশেষ বিশেষ রুটে বাস চলাচল করে। অনেক সময় শিক্ষার্থীদের ঝুলেও যেতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসের বিশেষত্ব শুধু টাকা ছাড়া চলাচলই নয় [যদিও বিশ্ববিদ্যালয় সব শিক্ষার্থীর কাছ থেকে পরিবহন বাবদ বার্ষিক এককালীন নির্দিষ্ট একটা ফি নেয়] বরং এর আরও অর্জন রয়েছে। বিশেষ করে যারা হলে থাকেন না, তারাই নিয়মিত এ বাসে চলাচল করেন। স্কুল-কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটা বড় জায়গায় এসে, এখানকার অন্যদের সঙ্গে মিথস্ট্ক্রিয়া, যোগাযোগ, পরিচয়ের একটা ভালো সুযোগ লাল বাস। একই এলাকা থেকে কারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছে, তা দেখার সুযোগ যেমন ঘটছে, তেমনি আসা-যাওয়ার পথে পরিচিত মানুষের কিংবা বিশেষভাবে বললে বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠীদের সঙ্গেই সময়টা কাটছে। সময়টা শুধু ভালো কাটাই নয়; বরং সমমনাদের সঙ্গে কথা বলে একত্রে নানাবিধ কাজেরও পরিকল্পনা করা যায়। এর মাধ্যমে কয়েকজন মিলে ভালো কোনো কাজের উদ্যোগ নেওয়া সহজ হয়। অনেক সময় দেখা যায়, কেউ বিপদে পড়লে কিংবা জটিল রোগে আক্রান্ত হলে চিকিৎসায় অনেক টাকা দরকার। তখন সম্মিলিত প্রয়াসে অর্থ সংগ্রহ করে বন্ধু বা বন্ধুর আপন কারও সাহায্যে এগিয়ে আসা সহজ হয়।
কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই নয়, সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েরও নিজস্ব পরিবহন ব্যবস্থা রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল ট্রেনের কথা আমরা জানি। পাহাড়ে ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আধার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশেষত্ব দিয়েছে এই শাটল ট্রেন। ১৯৮১ সাল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়টির নিত্যসঙ্গী শাটল ট্রেনকে ঘিরেই সেখানকার শিক্ষার্থীদের আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্নার গল্পের মেলা বসে। সেখানকার শিক্ষার্থীরা বলছেন, ঘণ্টাখানেকের শাটল যাত্রা জন্ম দিয়েছে অনেক গায়ক আর কবির। চট্টগ্রামের সাবেক শিক্ষার্থীদের মনে বুঝি সে স্মৃতিই জ্বলজ্বল করে।
তারুণ্যের পরিবহন, সেটা লাল বাস হোক, শাটল ট্রেন হোক বা অন্য কিছু হোক- সেখানে আনন্দ আছে, আড্ডা আছে, সৃজনশীলতা আছে। কিছু করার প্রেরণা আছে। যে তারুণ্য বিজয় এনেছে। যে তারুণ্যের জয়গান গেয়েছেন জাতীয় কবি নজরুল। কিছু সৃষ্টি করাই তো সে দুর্দমনীয় তারুণ্যের কাজ।
আসলে লাল বাস তো কেবল বাস নয়, এটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস। বিশেষভাবে বললে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস। প্রকৃতপক্ষে লাল বাসের চেয়েও কদর বিশ্ববিদ্যালয়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসই একে মহিমান্বিত করেছে। বিশেষায়িত করেছে। আর সে কারণেই এটি স্বপ্নের বাসে পরিণত হয়েছে। পরিবহনের অন্যান্য লাল বাস আমাদের মনে সে অনুভূতি জাগায় না। কারণ এটি মেধাবীদের মিলনমেলা। অনেক সাধনা ও তীব্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সেখানে আসন পেতে হয়। অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও এটি প্রযোজ্য।
লাল বাস আহামরি কিছু নয়, এখানে এসি নেই, খুব ভালো আসন নেই, কারও নির্ধারিত জায়গা নেই, অনেক সময় হয়তো দাঁড়িয়ে কিংবা ঝুলে যেতে হয়। তারপরও এর কদর। তারপরও এটি স্বপ্ন এঁকে যায়। এটিই তার বৈশিষ্ট্য। বাস নির্জীব, কথা বলতে পারে না। তারপরও এটি গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো তারই কোনো যাত্রী আজ ভালো প্রশাসক, দেশের জন্য কাজ করছেন; ভালো লেখক, সাংবাদিক মানুষের জন্য লিখছেন; বড় ব্যবসায়ী অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। বলা চলে, এভাবে প্রত্যেকটি যাত্রীই কাজ করে যাচ্ছে। আর বাসেও কেউ স্থায়ী যাত্রী হয়ে থাকে না। হয়তো বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের ৪-৫ বছর। তারপর সবাই ছুটে চলে পৃথিবী জয়ে, নানা কাজে। এটাই তারুণ্যের শিক্ষা, লালবাসের তাৎপর্য আর জীবনের সফলতা।

ট্যাগঃ , , , , ,

One comment on “স্বপ্ন ফেরি করা লাল বাস”

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।