Mahfuzur Rahman Manik
সবার নজর শুধু রাফা নয়, ওয়াশিংটনের দিকেও

আবদুল আজিজ আলুওয়েশেগ

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

গত সপ্তাহে দক্ষিণ গাজার রাফায় ইসরায়েল হামলা চালায়। রাফার তেল আল-সুলতানে ফিলিস্তিনি বাস্তুচ্যুতদের একটি শিবিরে ইসরায়েলি গণহত্যায় কমপক্ষে ৪৫ জন প্রাণ হারান। আগুনে অনেকে জীবন্ত পুড়ে যান এবং আরও শতাধিক আহত হন। ইসরায়েলি হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৩৬ হাজার নিহত ও এক লাখ আহত হয়েছেন।

বোমা মেরে ইসরায়েলি বাহিনী প্রায় পুরো গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। তাদের নির্দেশেই গাজার মানুষ রাফায় গিয়েছিল। তিন সপ্তাহ আগে রাফা আক্রমণকালে ইসরায়েল তাদের পূর্বাংশে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। সে সময় অনেক শরণার্থী পশ্চিমে তেল আল-সুলতানসহ বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে যায়। বোমা হামলার এক সপ্তাহ আগে ইসরায়েল এলাকাটিকে ‘নিরাপদ অঞ্চল’ হিসেবে আখ্যায়িত করে এবং ফিলিস্তিনিদের সেখান থেকে সরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে লিফলেট বিতরণ করে। সেখানে তারা কুয়েত শান্তি শিবিরের একটি তাঁবুতে আঘাত করে, যার অবস্থান ইসরায়েলের জানা ছিল। সুতরাং এই যুদ্ধাপরাধের দায় ইসরায়েলের ওপরই বর্তায়।

আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের নির্দেশ অমান্য করে ইসরায়েল হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। উল্লিখিত হামলার মাত্র দু’দিন আগে ইসরায়েলকে রাফা আক্রমণ বন্ধ করার নির্দেশ দেন আন্তর্জাতিক আদালত। ইসরায়েল আদেশটি উপেক্ষা করে হামলা অব্যাহত রেখে তার দুর্বৃত্ত রাষ্ট্রের পরিচয়ই নিশ্চিত করে।

এই ভয়াবহ হামলা সত্ত্বেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনও ইসরায়েলের রাফা অভিযান বন্ধ করার আহ্বান জানায়নি। এর আগে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, ইসরায়েল যদি রাফার ‘মানুষের শিবিরে’ আক্রমণ করে, তবে তিনি ইসরায়েলে অস্ত্র সরবরাহ সীমিত করবেন। বাস্তবে ইসরায়েল আক্রমণ করলেও যুক্তরাষ্ট্র কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। তার পরিবর্তে উপকরণ দিয়ে ও কূটনৈতিকভাবে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। প্রশাসনের মুখপাত্ররা বাইডেনের সতর্কবার্তা মেনে চলার বিষয়ে ইসরায়েলকে আহ্বান জানাতে ব্যর্থ হয়েছেন; অন্যদিকে জাতিসংঘের কূটনীতিকরা ইসরায়েলের রাফা অভিযান বন্ধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের প্রচেষ্টা ঠেকাতে ব্যস্ত।

চলমান যুদ্ধেই ইসরায়েল রাফায় এ নিয়ে দ্বিতীয়বার নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালাল। গত ফেব্রুয়ারিতে দেশটির বাহিনী সেখানে হামলা চালায় এবং ৮৩ জনের বেশি লোক হত্যা করে। বিমান হামলায় বহু বাড়িঘর ধ্বংসের পাশাপাশি তাদের বাসিন্দাদের হত্যা করে; যাকে বলা যায় একেবারে টেক্সটবুক যুদ্ধপরাধ। রাফায় শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি গণহত্যা ১৯৫৬ সালের গণহত্যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন শতাধিক শরণার্থীকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোয়াইট আইজেনহাওয়ারের পদক্ষেপের পরই ১৯৫৭ সালের প্রথম দিকে ইসরায়েল হামলা বন্ধ করতে বাধ্য হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের কঠোর পদক্ষেপের কারণেই ইসরায়েল অতীতে একাধিকবার ফিলিস্তিনি ভূমি ও জনগণের ওপর হামলা বন্ধ করেছিল। চলমান এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এমন সিদ্ধান্ত নেয়নি; বরং ইসরায়েলের প্রতি অস্ত্রসহ সামরিক সমর্থন অব্যাহত রেখে এবং নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো দিয়ে ইসরায়েলকে আরও উৎসাহিত করেছে।

আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে, গাজায় ফিলিস্তিনিদের মানবিক সহায়তা প্রদানে ইসরায়েলকে রাজি করাতে ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন প্রশাসন। বিভিন্ন দিক থেকে সাহায্য এলেও গাজায় ত্রাণ বিতরণে আরও ক্রসিং খুলতে তারা ব্যর্থ হয়েছে। গাজায় অস্থায়ী ঘাট নির্মাণে মার্কিন প্রচেষ্টাও ভেস্তে গেছে। এটি সম্ভব হয়েছে, কারণ যুক্তরাষ্ট্র রাফা সীমান্ত ক্রসিংসহ বন্ধ স্থল ক্রসিংয়ের মাধ্যমে পর্যাপ্ত ত্রাণ প্রবেশে অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরায়েলকে সেভাবে চাপ দিতে চায়নি। অথচ এটা জরুরি ছিল। কারণ ফিলিস্তিনে অনেকেই অনাহার ও অপুষ্টিতে মারা যাচ্ছে।

ইসরায়েল রাফায় হামলা চালিয়ে মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি করেই ক্ষান্ত হয়নি, এখন তারা মিসর ও গাজার মধ্যবর্তী রাফা ক্রসিংয়ের দখল নিয়েছে। এর ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। ইসরায়েল গাজায় প্রধান মানবিক সহায়তা প্রবেশ বন্ধ করে দিয়েছে এবং সেখানে জরুরি সাহায্য সরবরাহে বাধা দিয়েছে। তা ছাড়া ইসরায়েল গাজায় নিজের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জোরদার চেষ্টা করছে। স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যরা যেমনটা বলছে, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গাজাকে পশ্চিম তীরের সঙ্গে পুনরায় একত্র করবে, সেটা উপেক্ষা করছে ইসরায়েল।

অধিকৃত ফিলিস্তিনি অঞ্চলের বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিনিধি রিচার্ড পিপারকর্ন ফেব্রুয়ারিতে বলেছিলেন,‘সবার নজর এখন রাফার দিকে।’ এটা ছিল ইসরায়েলি বাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে তাঁর সতর্কবার্তা। তিনি ভয় পেয়েই বলেছিলেন, যদি ইসরায়েলি সেনাবাহিনী শহরে অনুপ্রবেশ করে বড় ধরনের হামলা চালায়, তবে ‘অকল্পনীয় বিপর্যয়’ সৃষ্টি হবে। বস্তুত সে সময় এমন আক্রমণ করার হুমকি ছিল, যা এখন বাস্তবে দেখা গেল।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ইসরায়েলের গত সপ্তাহে রাফায় হামলার পর ব্যাপক নিন্দা করছে। প্রশাসনের মানুষ ও অধিকারকর্মীরা রাফায় ইসরায়েলের সামরিক অভিযানের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর বিরোধিতার অংশ হিসেবে মানুষ পিপারকর্নের কথার পুনরাবৃত্তি করছে। বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনি শিবিরের একটি চিত্রের ওপরে তাঁর এই কথা ‘সবার নজর এখন রাফার দিকে’– তারা সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার করছেন। কেবল ইনস্টাগ্রামে এটি শেয়ার হয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি বার।

এই ছবি সামাজিক মাধ্যমে ঘুরছে। যদিও চিত্রটি খুবই সাধারণ এবং সেখানে মৃতদেহ, রক্ত, প্রকৃত মানুষ, নাম বা বেদনাদায়ক দৃশ্য নেই। তারপরও মানুষ এটি শেয়ার করছে। এর ব্যাপক প্রচার প্রমাণ করছে, অধিকাংশ আমেরিকানসহ বিশ্বের বেশির ভাগ মানুষ রাফা ও গাজার হত্যাকাণ্ডকে কতটা ঘৃণার চোখে দেখছে।

এটাও বলা দরকার, সবার নজর যেমন রাফার দিকে, তেমনি ওয়াশিংটনের দিকেও। গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ অব্যাহত রয়েছে। কারণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটি বন্ধ করার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়েছে। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে যদি তাঁর ইচ্ছা অনুযায়ী কাজ করতে দেওয়া হয়, তবে তিনি জনগণকে তো বটেই, পুরো অঞ্চল এবং সম্ভবত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকেও তাঁর সঙ্গে গভীর সংকটে টেনে নিয়ে যাবেন।

উনিশ শতকের ব্রিটিশ দার্শনিক জন স্টুয়ার্ট মিলের পর্যবেক্ষণ যেমন বলেছিল, ‘খারাপ লোক কতটা খারাপ করতে পারে, তা শেষ পর্যন্ত দেখার সময় দেওয়া ভালো লোকদের উচিত নয়; সময় থাকতেই তাদের কিছু করতে হবে।’ কিন্তু মার্কিন প্রশাসনের ‘ভালো মানুষ’ এখন পর্যন্ত কিছুই করতে পারেনি।

ড. আবদুল আজিজ আলুওয়েশেগ: গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিলের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল; আরব নিউজ থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফজুর রহমান মানিক

সমকালে প্রকাশ: ২ জুন ২০২৪

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।