Mahfuzur Rahman Manik
সিআইএ প্রযোজিত মাদক ব্যবসায় তালেবানি লালবাতি
জুলাই 18, 2023

উইলিয়াম ভ্যান ওয়াগেনেন

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

আফগানিস্তান থেকে ২০২১ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সৈন্য প্রত্যাহারের পর ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত এক নিবন্ধে পাকিস্তানি সাংবাদিক হামিদ মীর আফগান মাদক ব্যবসা সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর দেশটিতে মাদক ব্যবসা আরও চাঙ্গা হবে। হামিদ মীর ওই নিবন্ধে প্রত্যয়ের সঙ্গে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন– আগামী কয়েক বছরে আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদের চেয়ে মাদকের ব্যাপকতা বড় হুমকি হিসেবে দেখা দেবে। তখন তাঁর অনুমানটি বাস্তবসম্মত মনে হয়েছিল। কারণ দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দুই দশকের বিদ্রোহের ক্ষেত্রে তালেবানের অর্থায়ন এসেছে আফিম উৎপাদন থেকে। বস্তুত তখন ব্রিটেনের নেশার জগতের ৯৫ শতাংশ হেরোইনই আসত আফগান আফিম থেকে।

এখন যা দেখা যাচ্ছে, সেটাকে বিস্ময়করই বলতে হবে। ইংল্যান্ডভিত্তিক ভৌগোলিক তথ্যসেবা সংস্থা এলসিস চলতি বছরের জুন মাসে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে বলা হয়েছে, তালেবান সরকার আফগানিস্তান থেকে আফিম চাষ নির্মূল করেছে। এর অর্থ হেরোইন উৎপাদনের জন্য মৌলিক উপাদান তারা নিশ্চিহ্ন করে ফেলেছে। ২০০০ সালে আফগানিস্তানে তালেবান প্রথমবারের মতো যখন ক্ষমতায় ছিল, তখনও এমনটি দেখা গিয়েছিল। তখনও তারা আফিম উৎপাদন নিষিদ্ধ করে। তবে পরিহাসের বিষয়, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় অবৈধ মাদকের উৎস ধ্বংসে কাবুলের এবারের সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অর্থায়নে প্রতিষ্ঠিত ইউএস ইনস্টিটিউট ফর পিস (ইউএসআইপি) বলেছে, তালেবানের আফিম নিষিদ্ধের ঘটনা আফগানিস্তান ও বিশ্বের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে।

বিশ্বব্যাপী হেরোইন বাণিজ্য বন্ধে তালেবানি প্রচেষ্টায় পশ্চিমা বিশ্বের এমন মন্তব্য প্রথমে বিভ্রান্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু ঘটনার ভেতরে ঢুকলে ভিন্ন চিত্র সামনে আসবে। ২০০১ সালে ‘ওয়ার অন টেরর’ তথা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আড়ালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের আফগানিস্তান দখলের অন্যতম কারণ ছিল হেরোইন ব্যবসা পুনরায় চালু করা, যেটি ২০০০ সালে তালেবান বন্ধ করে দিয়েছিল। হেরোইন বাণিজ্য পশ্চিমা বিশ্বকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার এনে দিয়েছিল বলেই ব্যবসাটি তারা পুনরুজ্জীবিত করেছিল। বস্তুত আমেরিকা ২০ বছর ধরে আফগানিস্তানকে ‘মাদক রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচালনা করে।

আফগানিস্তানের হেরোইন বাণিজ্যের সূচনা ১৯৭৯ সালে, যখন মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ সোভিয়েত সমর্থিত আফগান সরকারকে দুর্বল করতে গোপন কর্মসূচি গ্রহণ করে। সে সময় যুক্তরাষ্ট্র আফগান মুজাহিদিনদের এ আশায় সহায়তা করেছিল, তাদের বিদ্রোহ সোভিয়েত সামরিক বাহিনীকে হস্তক্ষেপ করতে উৎসাহ দেবে। বিদ্রোহীদের দমন করতে গিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন শেষ পর্যন্ত দুর্বল হবে। যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব সে সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইর সহায়তায় পাকিস্তানে মুজাহিদিনদের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করে। তাদের অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও নগদ অর্থ দিয়ে সোভিয়েতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে সাহায্য করে। হিজবে ইসলামীর প্রতিষ্ঠাতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ছিলেন অন্যতম মুজাহিদিন নেতা। তিনি সিআইএ ও তার মিত্রদের কাছ থেকে ৬০০ মিলিয়ন ডলার সহায়তা পান।

হেকমতিয়ার ও অন্যান্য মুজাহিদিন নেতার সাহায্য শুধু অর্থ ও অস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বিখ্যাত ইতিহাসবিদ আলফ্রেড ম্যাকয়ের মতে, ১৯৭৯ ও ’৮০ সালে সিআইএ আফগান-পাকিস্তান সীমান্তে হেরোইনের ল্যাবরেটরি খোলে। এর পর অঞ্চলটি শিগগিরই বিশ্বের বৃহত্তম হেরোইন উৎপাদনকারী হয়ে ওঠে। ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে আফগান হেরোইনের পরিমাণ ছিল ৬০ শতাংশ। আর ইউরোপের বাজার ৮০ শতাংশ। শুধু তাই নয়; সে সময় পাকিস্তানে ১৩ লাখ মানুষ হেরোইনে আসক্ত হয়। অথচ এর আগে পাকিস্তানে এ মাদক দেখা যায়নি।

১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করে, তখন দেশটি গৃহযুদ্ধের মুখে পড়ে। কারণ সিআইএ সমর্থিত গ্রুপগুলো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘাতে জড়ায়। এ সংকটের মধ্যেই পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার সহায়তায় তালেবান ১৯৯৬ সালে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। ২০০০ সালে তালেবান নেতা মোল্লা ওমর আফগানিস্তানে আফিম চাষ নিষিদ্ধ করেন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার পর বুশ প্রশাসন তালেবানের কাছে ওসামা বিন লাদেনকে হস্তান্তরের দাবি করে। এদিকে বিন লাদেনের বিরুদ্ধে অভিযোগের প্রমাণ প্রকাশের দাবি জানান মোল্লা ওমর। কিন্তু বুশ প্রশাসন সে অনুরোধ অগ্রাহ্য করে ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে বোমা নিক্ষেপের নির্দেশ দেয়। এর পর ধীরে ধীরে আফগানিস্তানের নিয়ন্ত্রণ নেয় যুক্তরাষ্ট্র। সেখানে ফিরে আসে আফিম চাষ। ২০০২ সালে আবার ব্রিটেনে আফগান হেরোইনের রপ্তানি শুরু হয়। এর পর উজবেকিস্তান, রাশিয়া ও ইউরোপেও রপ্তানি হতে থাকে আফগান হেরোইন। এভাবে আফিম থেকে হেরোইনের বিশাল শিল্পকারখানা গড়ে ওঠে দেশটিতে। ২০১০ সালের শুরুতে ওবামা প্রশাসন পপি চাষের জন্য পরিচিত জেলাগুলোতে ৩৩ হাজার সৈন্য নিয়োজিত করে। এমন একটি জেলা হেলমান্দ প্রদেশের মারজা, যাকে ম্যাকয় ‘বিশ্বের হেরোইন রাজধানী’ বলে উল্লেখ করেছেন। এ ঘটনার আট মাস পর অভিযোগ ওঠে, ব্রিটিশ সৈন্যরা হেরোইন পাচারের সঙ্গে জড়িত।

২০২১ সালের আগস্টে সেনা প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত আফগানিস্তানে পপি চাষ অব্যাহত ছিল। ২০২১ সালের নভেম্বরে এক আফিম ব্যবসায়ী দাবি করেন, সব মুনাফা চলে যায় বিদেশে। আফগানিস্তান শুধু শ্রমিক রপ্তানি করে। জাতিসংঘের হিসাবে, ২০০৯ সালে মাদক ব্যবসার ৩৫২ বিলিয়ন ডলার মুনাফা হয় পশ্চিমা অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্যাংকের মাধ্যমে আদান-প্রদান হয় উল্লেখযোগ্য অংশ। ২০১২ সালে ডেইলি মেইলের প্রতিবেদন অনুসারে, ব্রিটেনের সবচেয়ে বড় ব্যাংক এইচএসবিসি ৬৪০ মিলিয়ন পাউন্ড জরিমানার সম্মুখীন হয়। কারণ ব্যাংকটির বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে মাদক কার্যক্রমের বিলিয়ন ডলার পাউন্ড পাচার হয়।

আফগানিস্তানের হেরোইন বাণিজ্য থেকে পশ্চিমা ব্যাংকগুলোতে আসা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মুনাফার সেই পথ এখন তালেবান বন্ধ করে দিয়েছে।

সমকালে প্রকাশ : ১৮ জুলাই ২০২৩

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।