বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমেছে- এটি নিঃসন্দেহে ভালো খবর। মঙ্গলবার আমরা জানতে পারছি- গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে বা গ্যাটস প্রকাশিত জরিপে বাংলাদেশে আট বছরে আট শতাংশ তামাকের ব্যবহার কমেছে। ধূমপায়ী অর্থাৎ বিড়ি-সিগারেটের মাধ্যমে তামাক গ্রহণ আর ধোঁয়াহীনভাবে অর্থাৎ গুল, সাদাপাতা, জর্দা প্রভৃতি তামাকজাত দ্রব্য সেবনের মাধ্যমে তামাক গ্রহণ করা হয়। এ জরিপে দেখা যায়, ২০০৯ সালে সার্বিকভাবে বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারের হার ছিল ৪৩.৩ শতাংশ। আর ২০১৭ সালে এ হার কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫.৩ শতাংশ। ২০০৯ সালে ৫৮ শতাংশ পুরুষ তামাক সেবন করত, ২০১৭-এ তা কমে ৪৬ শতাংশ। আর নারী তামাকসেবীর হার ২৮.৭ শতাংশ থেকে ২৫.২ শতাংশে নেমেছে।
বলা বাহুল্য, ধূমপানের কারণে ব্যক্তি নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, পরোক্ষভাবে অন্যরাও তার শিকার হয়। এ প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে ধূমপায়ীর সংখ্যা এক কোটি ৯২ লাখ। এটি মোট তামাকসেবীর প্রায় অর্ধেক হলেও এর প্রভাব বলা চলে দ্বিগুণ। যেমন এ পরিসংখ্যানেই দেখানো হয়েছে, ২০১৭ সালে নিজ বাড়িতে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হন ৩৯ শতাংশ জনগোষ্ঠী। ২০০৯ সালে এ হার ছিল ৫৪.৯ শতাংশ। এখানেও উন্নতি ঘটছে বটে। ঘরের বাইরে কর্মক্ষেত্রে ও গণপরিবহনেও পরোক্ষ ধূমপানের শিকার মানুষের হার কমেছে। এটা বিস্ময়কর যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ নিজেরা ধূমপান না করেও ক্যান্সারসহ নানা ধরনের জটিল রোগের হুমকিতে রয়েছে। ধূমপান না করে যারা ধূমপায়ীর পাশে থাকছেন, তাদের বরং ক্ষতি আরও বেশি।
তবে তামাক ব্যবহার কমার হার ইতিবাচক হলেও সন্তোষজনক নয়। যদিও সরকারি নানা উদ্যোগ রয়েছে; যেমন- ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন হয়েছে, তামাকজাত দ্রব্যের ওপর ১ শতাংশ হারে স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জ রয়েছে। আবার তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে ৫০ শতাংশ স্থানজুড়ে সচিত্র সতর্কবাণী মুদ্রণের বাধ্যবাধকতাটাও আছে। এরপরও কিন্তু হুমকি রয়ে গেছে। এমন সময়ে তামাক ব্যবহার কমার তথ্য পেলাম, যখন আমরা দেখেছি- বৈদেশিক বিনিয়োগের নামে জাপান টোব্যাকো (জেটি) গ্রুপকে বাংলাদেশে সরাসরি ব্যবসার সুযোগ দিচ্ছে সরকার। আকিজ গ্রুপের সিগারেট তৈরির সব ব্যবসা কিনতে সম্প্রতি জাপান টোব্যাকো ১২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার বিরাট অঙ্কের চুক্তি সই করে। স্বাভাবিকভাবেই বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো পণ্যের বৈচিত্র্য ও আগ্রাসী বিপণন কৌশল অবলম্বন করে বাজার দখল করতে চাইবে, এতে সিগারেটে তরুণ প্রজন্মের আকৃষ্ট হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাতে যেমন তামাকসেবীর সংখ্যা বাড়তে পারে, একই সঙ্গে বছর দুয়েক আগে করা আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশে সিগারেট ও তামাকজাত পণ্যের প্যাকেটের দু'পাশেই নিচের দিকের ৫০ শতাংশে ধূমপানের ক্ষতিকারক নমুনা সংবলিত ছবি থাকার কথা থাকলেও বাজারে প্রায় ৮০ শতাংশ তামাকজাত পণ্যে সচিত্র সতর্কবাণী দেওয়া হচ্ছে না।
এমতাবস্থায় প্রশ্ন থাকে, সত্যি তামাক ব্যবহার কমবে কি? যেখানে আইনের কার্যকর প্রয়োগ সেভাবে নেই, নতুন করে তামাক ব্যবসা সম্প্রসারণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে, এর বিরুদ্ধে জোরদার প্রচারণা নেই, সেখানে প্রশ্নটি অসঙ্গত নয়। এটা কষ্টের বিষয়, ধূমপানের কারণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি বছর প্রায় ৬০ লাখ মানুষ মারা যায়। সে ধূমপান প্রতিরোধ করা জরুরি। সত্যিকার অর্থে তামাক সেবন কমাতে হলে এর বিরুদ্ধে সামাজিক ঘৃণা সৃষ্টি করা দরকার। একে সামাজিক অপরাধ হিসেবে দেখলেই বোধ হয় কার্যকর ফল পাওয়া সম্ভব।