Mahfuzur Rahman Manik
প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়: শিক্ষক নিয়োগে চাই স্বচ্ছতা
নভেম্বর 29, 2011

বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। এগুলোর পড়াশোনার মান, ক্যাম্পাস, সনদ বাণিজ্য প্রভৃতি বিষয়ে গণমাধ্যম প্রায়ই সংবাদ পরিবেশন করে থাকে। ১২ নভেম্বর বণিক বার্তা ‘শিক্ষক নিয়োগে নেই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা’ শিরোনামে এসব বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনটি বলছে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক নিয়োগে এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মানার কথা বললেও অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ই তা মানছে না; নিজেদের ইচ্ছামতো শিক্ষক নিয়োগ দিচ্ছে। প্রতিবেদনটি আরও বলছে, ৭০ শতাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ শিক্ষককে খণ্ডকালীন হিসেবে নিয়োগ দেয়।
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড— এর সঙ্গে মিলিয়ে অনেকে বলেন, শিক্ষক শিক্ষার মেরুদণ্ড। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এমন অবস্থায় সে শিক্ষাব্যবস্থা কেমন চলছে, তা বোঝা কষ্টের কিছু নয়। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে অনেক আগে। ১৯৯২ সাল থেকে যাত্রা। বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন দুই লক্ষাধিক শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে। এত বছর পার হওয়ার পরও এ ক্ষেত্রে শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা নেই, এটা দুঃখজনক। প্রতিবেদনটি যদিও বলছে, ২০০৩ সালে একবার ইউজিসি শিক্ষক নিয়োগের নীতিমালা করেছিল; কিন্তু শিক্ষা মন্ত্রণালয় তার অনুমোদন দেয়নি। সে নীতিমালায় হয়তো ঘাপলা ছিল। ভালো কথা, সেটার অনুমোদন হয়নি। তাই বলে তা দ্রুত সংশোধন করে কি আবার করা যেত না?
এ ব্যাপারে ইউজিসি দায়িত্ব এড়াতে পারে না। যখন সংবাদমাধ্যম ইউজিসি চেয়ারম্যানকে প্রশ্ন করছে, তিনি বলছেন, এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে; শিগগিরই নীতিমালা হবে। দায়টা এখানেই শেষ নয়। নীতিমালা না থাকলেও ইউজিসি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বলছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিমালা অনুসরণ করতে; কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল তারা সেটা করছে না। কোনো পরীক্ষায় তৃতীয় বিভাগধারী শিক্ষক হওয়ার কথা না থাকলেও সেটা হচ্ছে। কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক-তৃতীয়াংশের বেশি খণ্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগের নীতি না থাকলেও তা হচ্ছে। এগুলো তো ইউজিসির দেখা উচিত। বিরাজমান নীতিমালার ব্যত্যয় ঘটালে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার দায়িত্বও ইউজিসির।
মজার বিষয় হলো— বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের প্রোসপেক্টাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামিদামি শিক্ষকের নাম ব্যবহার করলেও তাদের অনেকেই বিষয়টা আদৌ জানেন না। সে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের না জানিয়ে নাম ব্যবহার করছে! অথচ এদের নাম দেখেই শিক্ষার্থীরা ভর্তি হওয়ার জন্য আগ্রহী হন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের ধোঁকা দিয়ে তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ হাসিলের জন্য এসব কাজ করে যাচ্ছে। এটাও কি ইউজিসি দেখছে না!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে নেই তা নয়। যারা আছেন, তাদের নাম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবহার করতেই পারে। বরং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কোনো শিক্ষকের ব্যাপারে এমন অভিযোগও আছে, যারা এগুলোয় সময় দেয়া, ক্লাস নেয়া কিংবা গবেষণার চেয়ে বেসরকারিগুলোতেই বেশি সময় দেন। একেকজন কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস নেন। কারণ এতে তিনি বেশি টাকা কামাতে পারছেন। আজকের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদের কারণেই খণ্ডকালীন শিক্ষক দিয়েই তাদের কাজ স্বাচ্ছন্দ্যে চালাতে পারছে। ফলে এটা একদিকে যেমন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ক্ষতি, একই সঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্যও।
বাংলাদেশে বেসরকারি বা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় আর পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে একটা অঘোষিত দ্বন্দ্ব চলে আসছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে তেমন একটা পাত্তা দিতে চান না। সাধারণ মানুষও উভয়ের মানের ক্ষেত্রে আকাশ-পাতাল তফাত করে। খুবই স্পষ্ট, এগুলো মানুষের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছে। এটা অবশ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডেই হয়েছে। অথচ বিশ্বব্যাপী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাপক সমাদৃত। বিশ্ববিদ্যালয়ের র্যাংকিংয়ে প্রথম স্থানে থাকা এমআইটি আর বিশ্বখ্যাত হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ও প্রাইভেট।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগের কথা আগেই বলা হয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষাকে বাণিজ্যিকীকরণের বিষয়টা স্পষ্ট। দেশের মানুষের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বিবেচনায় এখানে উচ্চশিক্ষার খরচ বেশি— এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের আরেকটা সমস্যা হলো, সবাই উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে চায়। সে ক্ষেত্রে কোনো শিক্ষার্থী পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ না পেলে বাধ্য হয়ে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। অভিভাবকরাও বাধ্য সন্তানের খরচ চালাতে, এতে তার জমি বিক্রি করতে হলেও বা কি!
সমস্যাটা আসলে এখানে নয়। কথা হলো, যেখানে শিক্ষার্থীরা এত টাকা খরচ করে পড়াশোনা করছে, সে অনুযায়ী সেবা যদি তারা না পায়, তাদের যারা পাঠদান করবেন সে শিক্ষকরা যদি যথাযথ পাঠদান করতে না পারেন, সেটা মেনে নেয়া যায় না। ব্যবসায়িক প্রজেক্ট মনে করে যেকোনো ব্যবসায়ী কিংবা ক্ষমতাধর রাজনীতিবিদ একেকটা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে বসলেন, আর তার আত্মীয়-স্বজন বা পরিচিতদের দিয়ে কিংবা টাকার কথা চিন্তা করে অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেন— এটা হতে পারে না।
এটা অবশ্য বলতেই হবে, কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এসব দিক উতরে এসেছে। তাদের শিক্ষক, পাঠদান পদ্ধতি উন্নত। এখানে ভালো পড়াশোনাও হয়। তাদের ভালো ক্যাম্পাস আছে। এটা হাতেগোনা কয়েকটা। তবে এগুলোয় আবার খরচ অনেক। আমাদের মধ্যবিত্তের সন্তানরা পড়ার সামর্থ্য রাখে না। তবু অধিকাংশের অবস্থা যখন খারাপ হয়, অল্প কয়েকটার অবস্থা দেখে সবাই গড়ে গোটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন।
বর্তমানে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেভাবেই হোক ভালোভাবে যে চলছে, তার উদাহরণ হলো নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন। ইউজিসির অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ৫৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকা রয়েছে; যেগুলো বর্তমান। এর বাইরেও পত্রিকাগুলো সংবাদ দিচ্ছে ৭৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের আবেদন পড়েছে, এগুলোর আবেদনকারী কারা সে বিষয়টা আপাতত থাক। ২০০৬ সাল থেকে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন বন্ধ আছে, এখন সরকার সিদ্ধান্ত নিলেই অনুমোদন দিতে পারে। তবে সরকার বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা ভেবেই অনুমোদনের কাজ করবে।
আমাদের উচ্চশিক্ষার, বিশেষ করে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় দেখভাল করার দায়িত্বে রয়েছে ইউজিসি। সুতরাং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোয় কোথায় শিক্ষক নিয়োগ ঠিকমতো হচ্ছে না, কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কত ভাগ শিক্ষক খণ্ডকালীন আছেন— এগুলো ইউজিসিই দেখবে। এ ক্ষেত্রে কোথাও নিয়ম মানা না হলে তার জন্য শাস্তির ব্যবস্থাও ইউজিসি করবে। সবচেয়ে জরুরি হলো, শিক্ষক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করা। শোনা যাচ্ছে, এখন আবার ইউজিসির চেয়েও উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন হাইয়ার এডুকেশন কমিশন হচ্ছে। দেখার বিষয় এটা কেমন কাজ করে।

বণিক বার্তা, ৩০.১১.১১

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।