Mahfuzur Rahman Manik
মা এখন আর আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখে না
জানুয়ারী 24, 2012

অস্থিরতায় সময় কাটছে আমার মায়ের। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো খারাপ খবর শুনলে তার চঞ্চলতা বেড়ে যায়, ফোন দিয়ে জানতে চান— আমি ঠিক আছি কি না। সাবধানে চলতে বলেন। তার এ অস্থিরতা যত না পীড়া দেয়, তার চেয়ে বেশি অসহায় করে আমাকে। এ অসহায়ত্ব মাকে বোঝানোর নয়।
বিরাট স্বপ্ন দেখতেন মা, তার ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে বড় চাকরি করবে, দশ জনের একজন হবে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত ঘটনায় এসবের চেয়ে ছেলেকে সুস্থ ফিরে পাওয়ার স্বপ্নটাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে আমার মায়ের। অসহায়ত্ব আসলে এখানেই। আর এ জন্যও যে, তার ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে সব খবর তিনি রাখতে চেষ্টা করেন। এতে অসহায়ত্বের পাশাপাশি আফসোসও হয়। এখানকার ভালোর চেয়ে খারাপ খবরই বেশি
পান তিনি।
ক্যাম্পাসের সাম্প্রতিক সময়ের সব খবর হয়তো মা জানেন না। ২০১২ সালকে নতুনভাবে দেখার একটা স্বপ্ন ছিল। ভেবেছি নতুন বছর ভালোভাবে যাবে; আগের মতো খারাপ সংবাদ পাব না; সময়কে গুরুত্ব দিয়ে কাজে লাগাব। ৩১ ডিসেম্বর যখন দেখলাম বুয়েটের (বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়) মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তথাকথিত রাজনীতির বলে বলিয়ান হয়ে আরেক শিক্ষার্থী বড় ভাইয়ের রুমে ঢুকে তাকে পিটিয়ে, হাত ভেঙে, পা থেঁতলে দিয়েছে, আমার স্বপ্ন নতুন বছর আসার আগের দিনেই ফিকে হয়ে গেল।
এই একটা ঘটনা ঘটলেও হতো; কিন্তু নতুন বছর আসতে না আসতে ২ জানুয়ারি দেখলাম সেই পুরনো ঘটনা। সরকারদলীয় ছাত্র সংগঠনের হামলায় কুয়েট বন্ধ। ৩ জানুয়ারি প্রায় সব দৈনিক বড় করে এ খবর প্রকাশ করে। অবশ্য স্বস্তির সংবাদও ছিল— বুয়েটে মারধরের ঘটনায় দুই ছাত্রকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়। এটা বাংলাদেশে বিরল দৃষ্টান্ত। মজা হচ্ছে, বুয়েট শিক্ষার্থীরা তিন দিন লাগাতার আন্দোলন করে এ শাস্তি নিশ্চিত করে। বুয়েট প্রশাসন তাদের প্রথমে ছয় মাসের সাময়িক বহিষ্কারাদেশ দিয়েছিল।
তবে এ স্বস্তিও টিকল না বেশিক্ষণ। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাবানদের হামলা দেখলাম ৩ জানুয়ারি, যাতে পাঁচ ছাত্রী লাঞ্ছিত এবং ২৫ জন আহত হয়। অতিরিক্ত ফি আদায়ের বিরুদ্ধে জগন্নাথের আন্দোলন চলছিল। দুঃখ পেয়েছিলাম জগন্নাথের ভিসি মহোদয়ের মন্তব্য শুনে। উনি বলেছেন, ‘উচ্চশিক্ষা কিনতে হয়।’ আবার ৫ জানুয়ারি দেখলাম বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনরত সাধারণ ছাত্রছাত্রীর ওপর সরকারসমর্থিত ছাত্র সংগঠনের হামলা। এসব খুবই অদ্ভুত ঘটনা। যাদের জন্য আন্দোলন সেসব সতীর্থরাই হামলা করছে আন্দোলনকারীদের ওপর।
এ ধকলও সহ্য করা যেত, যদি ৯ জানুয়ারি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়েরের মৃত্যু না হতো। তার মৃত্যুর খবর আমার মাকে খুবই বিচলিত করেছে। জুবায়েরের মায়ের কথা ভাবা যায়! জুবায়েরও তো একটা স্বপ্ন নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল। তাকে নিয়ে মা-বাবা স্বপ্ন দেখেছিলেন। সে স্বপ্নের সমাধি হয়েছে তথাকথিত ছাত্র রাজনীতি নামের সংঘর্ষে। ঠিক এ নামে হলেও প্রবোধ দেয়া যেত; তা হয়েছে শিক্ষক রাজনীতির নামে। আশ্চর্যের কথা হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও নাকি গ্রুপ পোষেণ। জুবায়েরের মৃত্যুর পরও প্রশাসন হত্যাকারীদের বলা চলে বাঁচানোরই চেষ্টা করেছে— শাস্তি হিসেবে প্রথমে তিন ছাত্রকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করে। যদিও ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে পরবর্তী সময়ে অভিযুক্তদের আজীবন বহিষ্কার করতে বাধ্য হয় প্রশাসন। এ-ই হচ্ছে
মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি!
বিস্ময়কর খবরের অভাব নেই। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে জুবায়েরের ঘটনায় শিক্ষক-ছাত্র রাজনীতির নতুন চমক দেখা গেলো— সেখানকার প্রক্টরের হাতে এক শিক্ষকের লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনার মাধ্যমে। যেখানে শিক্ষকদের এ অবস্থা, সেখানে পড়াশোনার অবস্থা কী বলার অপেক্ষা রাখে না। জাহাঙ্গীরনগরের এ ঘটনা হজম হতে না হতেই দেখলাম ১১ জানুয়ারি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই ছাত্রসংগঠনের মধ্যে মারামারি। সেখানকার ক্যাম্পাসে এখনো নাকি অস্থিরতা রয়েছে খানিকটা; পড়াশোনার পরিবেশ বিঘ্নিত।
এভাবেই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস। মানুষ গড়বে যে ক্যাম্পাস, সেখানে নেই মানুষ হওয়ার পরিবেশ। বরং আছে অস্ত্র, দলাদলি; রাজনীতির নামে দলবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। পড়াশোনার চেয়ে আড্ডায় সময় নষ্ট করাই অনেক শিক্ষার্থীর মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পাসের ভদ্র, মেধাবী, সৃজনশীল ছাত্রদের কোনো মূল্য নেই। ক্ষমতাই এখানে প্রধান। বৈধ শত শত শিক্ষার্থী আবাসিক হলগুলোর বারান্দায় রাত কাটায় আর ক্ষমতাবানরা অবৈধদের নিয়ে রুমে থাকে। এর বাইরের চিত্র কম। বাংলাদেশের সব ক্যাম্পাসের অবস্থাও হয়তো একই।
এ রকম একটা সন্ত্রাসকবলিত ক্যাম্পাসে আমার বাস। বুয়েটের হামলা দেখছি, কুয়েট বন্ধ হওয়া দেখছি, জগন্নাথ ও রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা দেখছি। দেখলাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবায়েরের করুণ মৃত্যু। এরপর কোন ক্যাম্পাসের পালা জানি না। তবে আমাদের ক্যাম্পাসের আশঙ্কা নাকচ করা যায় না। এসব হামলা, সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সাধারণ শিক্ষার্থীরাই প্রাণ হারায়। যেমনটা জুবায়েরের পরিবার বলছে, ‘রাজনীতি ছাড়ায় মৃত্যুদণ্ড পেয়েছে জুবায়ের’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও দুই বছর আগে মেধাবী ছাত্র আবু বকর মারা গেছে।
এখানে আমি সেই আবু বকরের মতো একজন সাধারণ শিক্ষার্থী। কোনো নিরাপত্তা নেই আমার। রাষ্ট্রযন্ত্র হন্তারকদেরই নিরাপত্তা দেয়। প্রশাসনের মাথাব্যথাও এদের বাঁচানো। ক্ষমতাবানরা ক্ষমতা পোক্ত করতে এদের লালন-পালন করেন। ক্ষমতা পেয়ে ক্যাম্পাসে এরা কী না করছে— চাঁদাবাজি, ফ্রি খাওয়া, নিরীহদের নিপীড়ন, অন্যায়ের প্রতিবাদকারীদের ওপর হামলা, এমনকি স্বার্থরক্ষায় প্রতিপক্ষকে খুন করা পর্যন্ত। এ ক্যাম্পাস— বলির পরবর্তী শিকার যে আমি নই, সে নিশ্চয়তা নেই। ফলে আমাকে নিয়ে মায়ের বড়
স্বপ্ন অনেক আগেই চুরমার হয়ে গেছে। আমাকে সুস্থভাবে মায়ের কোলে ফিরে পাওয়ার যে ক্ষীণ স্বপ্ন তিনি দেখছেন, তারও কোনো ঠিক নেই। এক অনিশ্চিত গন্তব্যে তার সব স্বপ্ন। আবু বকর কিংবা জুবায়েরের মায়ের মতো তার বুকও যে খালি হবে না, সে নিশ্চয়তা তাকে কে দেবে? তাই মা এখন আর আমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন না।
বণিক বার্তা ২৪.০১.২০১২

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।