Mahfuzur Rahman Manik
কোচিং সেন্টার চালু রাখতে হবে!
আগস্ট 1, 2011


‘আইন করে কোচিং বন্ধের দাবি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানদের’Ñ ২২ জুলাই যুগান্তরের একটি প্রতিবেদনের শিরোনাম। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সঙ্গে কোচিং বিষয়ে সব প্রতিষ্ঠান প্রধান বৈঠক করার পরদিনই প্রতিটি জাতীয় দৈনিকে এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। বোঝাই যাচ্ছে, শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে তারা কোচিং বন্ধের দাবিতে একমত হয়েছেন।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানরা কোচিং বন্ধের যে দাবি করেছেন, কোচিংয়ের প্রতি বিশেষ প্রীতি কিংবা কোচিং ব্যবসা না থাকলেও সচেতন মানুষ মাত্রই তাদের এ দাবির বিপক্ষে। অর্থাৎ বাংলাদেশে কোচিং চালু আছে, থাকবে এবং চালু রাখতে হবে। এর সপক্ষে যুক্তি উপস্থাপনের জন্যই এ লেখার অবতারণা।
যে কেউ কোচিংয়ের আন্তর্জাতিক রূপটা ইন্টারনেটের কল্যাণে সহজেই পেতে পারেন। কোচিং বিষয়ে অনুসন্ধান করলে, উইকিপিডিয়াসহ সব তথ্য ভাণ্ডার একত্র করলে বিশ্বব্যাপী চৌদ্দ ধরনের কোচিং পাওয়া যাবে। যেমন লাইফ কোচিং, স্পোর্টস কোচিং, বিজনেস কোচিং এমনকি ডেটিং কোচিং পর্যন্ত আছে। মজার বিষয় হল, এর মধ্যে এডুকেশন বা শিক্ষা কোচিং নামে কোন কোচিং নেই। আশ্চর্যের বিষয় হল, একমাত্র বাংলাদেশ ও ভারতে শুধু শিক্ষা কোচিং প্রচলিত আছে এবং এ দু’দেশে শিক্ষার জন্য কোচিং সেন্টারের সংখ্যা এত বেশি, যা পৃথিবীর সব কোচিংকে হারিয়ে দেবে। বাংলাদেশে কোচিং সেন্টার বন্ধ না করে চালু রাখার পক্ষে প্রথম এবং শক্তিশালী যুক্তি এটি। বিশ্ববাসীকে আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি এটা শিক্ষা ব্যবস্থায় সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা। আমাদের এ স্বাতন্ত্র্য ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য হলেও কোচিং সেন্টার চালু রাখতে হবে।
শিক্ষা প্রদান করা মহান ব্রত। একাডেমিক শিক্ষার বাইরে কোচিং ব্যবসায়ীরাও ঠিক এ মহান কাজটি করে যাচ্ছেন। কোচিং সেন্টার বন্ধ করে দিলে কোচিং ব্যবসায়ীরা জাতির এ মহান খেদমত কিভাবে করবেনÑ জাতি যেন বঞ্চিত না হয়, সেদিকটা দেখলেও কোচিং চালু রাখাটা আবশ্যক।
গোটা বাংলাদেশে ঠিক কত হাজার কোচিং সেন্টার আছে তার কোন হিসাব নেই। পাড়া অনুযায়ী ধরলে গোটা ঢাকায় ধরা যাক এক হাজার কোচিং সেন্টার আছে (ছোট-বড় মিলিয়ে)। ঢাকার বাইরে প্রত্যেকটা জেলা সদর এবং থানা মিলিয়ে সংখ্যাটি ধরি ২০ হাজার (বেশি হতে পারে, কমও হতে পারে)। এর মধ্যে আবার নানা কিসিমের কোচিং আছেÑ বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং, বিসিএস কোচিং, ইংরেজি শিক্ষার কোচিং ইত্যাদি। এসব কোচিংয়ের সঙ্গে গড়ে ১০ জন করে জড়িয়ে থাকলেও ২ লাখ মানুষ এবং তাদের পরিবার জড়িয়ে আছে। সংখ্যাটি আরও বেশি হওয়া স্বাভাবিক। কোচিং বন্ধ করলে এ মানুষগুলো বেকার হয়ে যাবে। সুতরাং কোচিং চালু রাখাই ভালো।
কোচিং দিয়ে অনেকেই কোটিপতি হয়েছেন। যারা প্রত্যেক বছর বিভিন্ন মানুষকে দান-সদকা করেন, তারা আবার এ টাকা দিয়ে অনেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বানিয়েছেন, যেখানে অনেক মানুষ কাজ করে। কোচিং বন্ধ করলে একদিকে কোটিপতি হওয়ার এ পথটা বন্ধ হয়ে যাবে, অন্যদিকে নতুন নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু ব্যাহত হবে, এতেও অনেক বেকার বাড়বে।
স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা অল্প ক’টাকা বেতন পান, যা দিয়ে নিজেদের সংসার চালানো দায়। কোচিং সেন্টারের মাধ্যমে সে শিক্ষক যদি আরামে ১০ তলায় থাকতে পারেন, মন্দ কি!
প্রত্যেক বছর কোচিং করে হাজার শিক্ষার্থী বাংলাদেশের নামিদামি প্রতিষ্ঠানে চান্স পাচ্ছে। প্রথম শ্রেণী থেকে শুরু করে পঞ্চম, অষ্টম, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিসহ বিদেশেও যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা। কোচিং বন্ধ করলে এরা চান্স পাবে কিভাবে?
শ্রেণীকক্ষে পড়ানোর জন্য যথেষ্ট সময় শিক্ষকরা পান না। একটার পর একটা ক্লাস নিতে গিয়ে তারা ক্লান্ত, শ্রেণীকক্ষে পড়ানোর মতো যথেষ্ট মুডও তাদের থাকে না। ফলে যা পড়ান শিক্ষার্থীরা কিছুই বোঝে না। ঠিক এ শিক্ষকরাই কোচিংয়ে পড়াতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন। ফলে বাধ্য হয়েই শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে যেতে হয়। কোচিং বন্ধ হলে এসব শিক্ষার্থীরা যাবে কোথায়?
বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা পড়াশোনা করে, অনেকেরই বাড়ি থেকে মা-বাবা টাকা পাঠাতে পারেন না। পাঠালেও তা দিয়ে চলে না। সেক্ষেত্রে কোচিং ক্লাস নিয়ে কিছু টাকা আয় করলে ভালোভাবেই চলা যায়।
যেসব শিক্ষকের কোচিং আছে, তিনি তার বিষয়ের পরীক্ষার প্রশ্নটা নিজের শিক্ষার্থীদের দিয়ে দিতে পারেন। শিক্ষার্থীরা এর মাধ্যমে একটা এ প্লাস পেলে মন্দ কি! এভাবে যদি প্রত্যেক শিক্ষকের একটা করে কোচিং থাকে, সব বিষয়ে এ প্লাস পাওয়া তো ব্যাপারই নয়। কোচিং না থাকলে এদের ভাগ্যে কী জুটত আল্লাহই জানেন।
কোচিং সেন্টারগুলো ভর্তির সময় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে থেকে ভ্যাটের টাকা অতিরিক্ত হিসেবে নিয়ে থাকে। স্বাভাবিকভাবেই সরকার সে টাকা পাচ্ছে। কোচিং বন্ধ করে দিলে সরকারের আয়ের অন্যতম একটা উৎস বন্ধ হয়ে যাবে। সুতরাং দেশের স্বার্থে হলেও কোচিংগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে।
আজকালকার অভিভাবকরা সন্তানের শিক্ষা নিয়ে খুবই টেনশনে থাকেন। তার পড়াশোনা আর ভালো রেজাল্টের চিন্তায় অভিভাবক অস্থির। কোন কোচিং যখন চ্যালেঞ্জ দিয়ে ভালো ফলাফলের নিশ্চয়তা দিচ্ছে সে কোচিংয়ে সন্তানদের দিয়েই অভিভাবক কিছুটা টেনশনমুক্ত থাকেন। কোচিংগুলো বন্ধ হয়ে গেলে অভিভাবকদের এ টেনশন কে কমাবে?
কোচিং চালু রাখার পক্ষে এভাবে অনেক যুক্তিই আসবে। সবচেয়ে ভালো হয় বাংলাদেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়ে কেবল কোচিং সেন্টারগুলো চালু রাখা। সরকার বছর শেষে শুধু একটা পরীক্ষা নিতে পারেন। এর মাধ্যমে বছর বছর সার্টিফিকেট দিয়ে এসএসসি-এইচএসসি পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা পৌঁছবে। আরও ভালো হয় বাংলাদেশের পুরো শিক্ষা ব্যবস্থার দায়িত্বটা কোচিং ব্যবসায়ীদের হাতে দিয়ে দেয়া। এতে সরকারের শিক্ষা সংক্রান্ত দুটি মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজন হবে না, আর প্রয়োজন হবে না বছর বছর শিক্ষানীতি করা।
ফুটনোট : শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে প্রধান শিক্ষকরা বলেনÑ ক্লাসভিত্তিক পাঠদান নিশ্চিত করা গেলে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ের প্রয়োজন পড়ে না। কোচিং বন্ধ করা না গেলে সার্বিক জাতীয় শিক্ষায় ধস নামবে। তাদের প্রতি এক নাগরিকের প্রশ্নÑ আপনার প্রতিষ্ঠানে ঠিকমতো ক্লাস হচ্ছে তো, আপনার প্রতিষ্ঠানের কয়জন শিক্ষক কোচিং ব্যবসা করেন?

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।