Mahfuzur Rahman Manik
প্রাথমিক শিক্ষা: শুধু 'জীর্ণ গৃহে শীর্ণ পাঠ'ই নয়
অক্টোবর 8, 2010





গত ২৯ আগস্ট দৈনিক সমকাল প্রাথমিক বিনের ১৮ নম্বর পাতাজুড়ে বিশেষ আয়োজন হিসেবে বিদ্যালয়দ্যালয় ভবন নিয়ে প্রধান প্রতিবেদন করে। এর সঙ্গে সমকাল একই দি ভবনগুলোর বাস্তব অবস্থা তুলে ধরে। সমকালের প্রতিবেদনগুলোর মাধ্যমে সহজেই সারাদেশের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর চিত্র একনজরে দেখা সম্ভব। এগুলোর মাধ্যমে একটি বিষয় স্পষ্ট, প্রাথমিক বিদ্যালয় ভবনগুলো শিশুসুলভ তো নয়ই, উল্টো জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। শিরোনামই তা বলে দেয়, 'জীর্ণ গৃহে শীর্ণ পাঠ' কিংবা 'রাতের বেলায় গোয়ালঘর, দিনে শ্রেণীকক্ষ।' প্রতিবেদনের তথ্যমতে, মোট বিদ্যালয়ের নয় শতাংশই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব ভবনের কোনোটির ছাদ থেকে খসে পড়েছে পলেস্তারা, কোনোটি বিলীন হয়ে যাচ্ছে নদীতে, কোনোটির ছাদ ও দেয়ালে ফাটল ধরেছে, কোনো কোনো ভবন দেবে গেছে কিংবা ভেঙে পড়েছে। কোথাও আবার ভবনই নেই। এসব বিদ্যালয়ের শিশুরা কেউ পাঠ নেয় উন্মুক্ত খোলা ময়দানে, কেউ মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে পাঠ নেয় ভবনের ভেতরেই, কেউ আবার নেয় চেয়ার-টেবিল ছাড়াই নিচে বসে। বেহাল দশা বলতে যা বোঝায় আর কি।নয়ভাগ বিদ্যালয়ের অবস্থা এ রকম, অন্যগুলোর অবস্থা যে ভালো তা ভেবে প্রবোধ পাওয়ার অবকাশ নেই। সে বিদ্যালয় ভবনগুলো হয়তো ভালোভাবে দাঁড়িয়ে আছে, জীবননাশের ঝুঁকি নেই। এর বাইরে একটি শিশুর পড়ার পরিবেশ বলতে যা বোঝায় তার কিছুই নেই। খেলার মাঠ, ভালো টয়লেট, পানির কল_ এ সাধারণ বিষয়গুলোই নেই। এর বাইরে শিশুসুলভ শিক্ষা উপকরণের কথা না-ইবা বললাম। প্রাথমিক শিক্ষার যাত্রা সাম্প্রতিক কোনো বিষয় নয়। ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পর বাহাত্তরের সংবিধানের ১৭ নং অনুচ্ছেদেই এ শিক্ষার ব্যাপারে জোর তাগিদ দেওয়া আছে। ২০১৫ সালের মধ্যে আমাদের নিজস্ব পরিকল্পনা এবং সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যগুলোর পরিকল্পনায় প্রাথমিক শিক্ষায় শতভাগ শিক্ষার্থীর ভর্তির কথা বলা আছে। খুব বেশি বাকি না থাকলেও আমাদের বিদ্যালয়ের বর্তমানে এই হাল। প্রাথমিক শিক্ষার সমস্যা শুধু ভবন তথা অবকাঠামোই নয়, অন্য সব সমস্যায় এ শিক্ষা জর্জরিত। শিক্ষক সংকট, বই সংকট, শিশুসুলভ সিলেবাস সংকট, ভবন সংকট। শিক্ষক সংকট কতটা প্রকট তা একটি বিভাগের অবস্থার মাধ্যমেই অনুমান করা সম্ভব। ২৮ আগস্ট সমকালের এক প্রতিবেদন অনুসারে সিলেট বিভাগে ৩৫৫ বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নেই আর সহকারী শিক্ষকের পদ খালি আছে ১ হাজার ১৮টি। এতসব সমস্যার ফল যেটা হচ্ছে, শিক্ষার্থীরা দ্রুত ঝরে পড়ছে। এখন বলা হয়, প্রাথমিক শিক্ষায় নিট ভর্তির হার ৯০ ভাগ আর স্থূল ভর্তির হার ৯৭ ভাগ। এ হার দেখে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষার অবস্থা খারাপ বোঝার কোনো উপায় নেই। যখন দেখা যাচ্ছে, প্রথম শ্রেণীতে যত শিশু ভর্তি হচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণী পার না হতেই তার অর্ধেক ঝরে পড়ছে, সেটা নিশ্চয়ই সুখকর নয়। এ চিত্রটা খুব সহজেই পাওয়া সম্ভব। প্রতি বছর প্রাথমিক শিক্ষায় দেশে প্রায় ৪০ লাখ শিশু ভর্তি হয়। গত বছর শুরু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় উনিশ লাখের কিছু বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। তাহলে বাকি শিশুরা কই? উত্তর হলো, ঝরে পড়েছে।প্রাথমিক শিক্ষার অবকাঠামো কিংবা নানা সমস্যার কথা যখন বলি, দৃষ্টিটা আমাদের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর ওপরই পড়ে। এসব বিদ্যালয়ে দরিদ্র এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের শিশুরা পড়াশোনা করে। বিত্তবানদের সন্তানরা এসব বিদ্যালয়ে পড়ে না। তারা মাসে হাজার হাজার টাকা খরচ করে ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয় বা প্রাইভেটভাবে পরিচালিত উন্নত, আলিশান অট্টালিকায় বিভিন্ন বিদ্যালয়ে পড়ান। এমনকি বিভিন্ন দেশের (বাংলাদেশে অবস্থিত) ইন্টারন্যাশনাল স্কুলগুলোতে পড়ান, যাদের কোনো কোনোটির মাসিক খরচ লাখ টাকার ওপর। সমাজে স্পষ্ট একটা বৈষম্য। কেউ দশতলায়, কেউ নিচতলায় (বস্তিতে)। যাদের অর্থ আছে তারা এসব প্রতিষ্ঠানে তাদের সন্তানদের পড়াবেন, এটিই স্বাভাবিক। প্রশ্ন হলো, দেশের অধিকাংশ শিশু যেসব বিদ্যালয়ে পড়ছে, সরকার কি এখানে আরেকটু দৃষ্টি দিতে পারে না?

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।