Mahfuzur Rahman Manik
প্রশ্নবিদ্ধ ক্যাম্পাস নিরাপত্তা (দৈনিক ডেসটিনি ২১ এপ্রিল ২০১০)
এপ্রিল 21, 2010

প্রশ্নবিদ্ধ ক্যাম্পাস নিরাপত্তা
মাহফুজুর রহমান মানিক

দুই মাস পাঁচ দিনের মাথায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবিতে) তিন শিক্ষার্থী খুন। গত ১৫ এপ্রিলের ঘটনায় ১৬ তারিখ সর্বশেষ খুন হওয়া আসাদ বিবিএর (অ্যাকাউন্টিং) এর শিক্ষার্থী। এর আগে ১১ ফেব্রুয়ারি খুন হওয়া মহিউদ্দিন এবং ২৯ মার্চ খুন হওয়া হারুন-অর-রশিদ আর এবারের আসাদ হত্যা, তিনজনের খুনের মোটিভ বলা চলে একই ধরনেরর। তারা কোন প্রত্যক্ষ মারামারি কিংবা সামনাসামনি স্পষ্ট শত্রুদের হাতে খুন হননি। খুন হয়েছেন ক্যাম্পাসের আশেপাশে। শাটল ট্রেনের স্টেশনে। চবির এ নিয়মিত হত্যাকান্ড ক্যাম্পাসকে করেছে অস্থিতিশীল। শিক্ষার্থীরা রয়েছে চরম আতংকে। এ তিনজনের মিছিলের পরবর্তী শিকার কে এ নিয়ে তাদের ভয়।
চবির এ ধারাবাহিক হত্যাকান্ডে অন্তত একটা বিষয় স্পষ্ট, ক্যাম্পাসটি একটি সন্ত্রাস কবলিত ক্যাম্পাস। যেখানে নিয়মিত হত্যা-সন্ত্রাসের ধারাবাহিকতায়ই এসব সন্ত্রাসী কার্যক্রম চলছে। ১১ ফেব্রুয়ারি প্রথম শিক্ষার্থী যখন নিহত হয় তখন গোটা দেশের ক্যাম্পাস ছিলো উত্তাল। বিশেষ করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক হত্যা এবং এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরীহ ছাত্র আবু বকর হত্যা। সেসময়ে চবির হত্যাকান্ডটি অন্যান্য ক্যাম্পাসের হত্যাকান্ডের ধারাবাহিকতা বললেও, ঘটনা কিন্তু এক নয়। সে হত্যার পর দু’মাস পেরুলে ও অপরাধীরা এখনও ধরাছোয়ার বাইরে।
প্রথম হত্যাকান্ডটি ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলে ও দ্বিতীয়টি ততটা আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এখন অবশ্য তৃতীয়টা ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। কারন একেতো খুন হওয়া শিক্ষার্থীটি ছাত্রলীগ কর্মী অন্যদিকে এটি খুনের হ্যাট্রিক।
এ হত্যাকান্ডের পরই ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে মিছিল করেছে। ভিসি প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি করেছে এবং অনির্দিষ্ট কালের জন্য ধর্মঘট ডেকেছে। প্রথম অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তিনদিনের কাস ও পরীক্ষা স্থগিতের নির্দেশে ছাত্রলীগ ধর্মঘট প্রত্যাহার করে, পওে আবার ধর্মঘটের ডাক দেয়।
সংবাদপত্রের ভাষ্য অনুযায়ী গ্রামবাসীর হাতে নিহত হয় আসাদ। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকটস্থ জোবরা গ্রামের সন্ত্রাসীদের হাতে শাটল ট্রেনের স্টেশনে আড্ডারত আসাদ এবং তার সহপাঠীরা জখম হয়। দেখার বিষয় হলো এবারের হত্যাকান্ড আর আগের দুটি হত্যাকান্ড একই জায়গায় সংঘঠিত হয়। শেষ আসাদ খুনের বিষয়টিকে আপাত দৃষ্টিতে একটা ঘটনার কারনে হয়েছে বলা গেলেও আগের দুইটির স্পষ্ট কোন কারন এখন বের করতে পারেনি কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান পাহাড়ঘেঁষা শহর থেকে দূরে এমন এক স্থানে যেখানে গ্রাম আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা মাখামাখি। অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় আর গ্রামের সীমানার মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। ফলে গ্রামের মানুষের সাথে শিক্ষার্থীদের হরহামেশাই সাক্ষাৎ ঘটে থাকে। গ্রামবাসী শিক্ষার্থীদের আচরনে যে খুব একটা সন্তুষ্ট নয় এ ঘটনাই ত্রা প্রমাণ। হতাশার কথা হলো শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ই নয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানাই এভাবে গ্রামের সাথে লাগোয়া। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আলাদা সীমানা নেই বললেই চলে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কোন দ্বীপ রাষ্ট্র নয় যে একেবারে গ্রাম থেকে আলাদা সীমানায় রাখতে হবে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বলে কথা। নিরাপত্তার খাতিরেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা আলাদা করে নিরাপত্তা বেষ্টনী দেয়া দরকার। আর এখন যেহেতু গ্রামের সাথে সীমানা রয়েছে সেহেতু গ্রামবাসীর সাথে ভালো সম্পর্কেও বিষয়টি গুরুত্বপূর্ন।

যদি বলা হয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের হত্যাকান্ডগুলো আশেপাশের এলাকার মানুষের ক্ষোভের বহিপ্রকাশ, তা কিন্তু মেনে নেয়ার মত নয়। গ্রামবাসীর সাথে বিরোধ থাকতেই পারে কিংবা গ্রামবাসী শিক্ষার্থীদের আচরনে নাখোশ হতেই পারেন, তাই বলে এভাবে সিরিজ হত্যাকান্ড ঘটাবেন এমনটা বিশ্বাস করাটা কষ্টেরই বটে। তবে অন্যান্য কারনগুলোর সাথে এ কারনটিকে একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায়না।
সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাম্পাসে সহিংসতার মাত্রা কতটা বেড়েছে তা প্রত্যেকদিনের সংবাদপত্রই সাক্ষী। কিছুদিন আগেও শিক্ষার্থী সহিংসতার জেরে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়ে যায় খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষার্থীদের নিজস্ব দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, টেন্ডারবাজি চাঁদাবাজির দ্বন্দ্ব, আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্ব ইত্যাদি নানা দ্বন্দ্ব আর সংঘাতে অস্থির শিক্ষাঙ্গন।
শিক্ষাঙ্গনের এসব অস্থিরতার বলি হয়েছে অনেক শিক্ষার্থী। ঢাকা, চট্টগ্রাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা যেমন খুন হয়েছে তেমনি আহতও হয়েছে অনেক। বারবার অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ হয়েছে অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। ব্যাহত হয়েছে প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত শিক্ষা কার্যক্রম।
গনমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী গত ১৫ মাসে শিক্ষাঙ্গনগুলোতে প্রায় পনেরশ সংঘর্ষেও ঘটনা ঘটেছে। মানুষ গড়ার আঙ্গিনা পরিনত হয়েছে মানুষ মারার আঙ্গিনা হিসেবে। মেধাবী শিক্ষার্থীরা মননের চর্চার বদলে চর্চা করছে হননের। এ ফলে দিনদিনই প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছে আমাদেও বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কয়েকদিন পরপরই যখন আমরা শুনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বর‌্যাংকিংয়ে পাঁচ হাজারের উপরে কিংবা দিনদিন আরো পিছিয়ে পড়ছে। সে সংবাদ আমাদের হতাশাচিত্তে গলধকরণ ছাড়া কিছুই করার থতাকেনা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আসাদ খুন হলো কেন? ঘটনা প্রবাহে প্রত্যক্ষ কারন যেটা দেখা যাচ্ছে, সূচনাটা পহেলা বৈশাখ। পহেলা বৈশাখে বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে আসা নিকটস্থ গ্রামের নব দম্পতিকে লাঞ্চিত করার ঘটনা হলো মূল ইস্যু ( এখনও সর্বশেষ তথ্যমতে, তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে, তাদের রিপোর্ট পাওয়া পর্য›ত প্রকৃত সত্যের জন্য অপেক্ষা করতে হবে) । পরদিন ১৫ এপ্রিল আসাদ এবং তার সহপাঠীদের স্টেশনে আড্ডারত অবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী পরিচয় পেয়ে জোবরা গ্রামের সন্ত্রাসীরা তাদের উপর আক্রমন করে।পহেলা বৈশাখে যে শিক্ষার্থীরাই ঘটনাটা ঘটিয়ে থাকুক, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় সে ঘটনাই আসাদেও মৃত্যু ও তার সহপাঠীদের আহত হওয়ার কারণ।

এসব ঘটনার মাধ্যমে প্রমাণ করে শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের ভয়াবহ রকমের অবক্ষয় ঘটেছে। শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনাটাই নয়, ঠিক পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ঘটনাও তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় পহেলা বৈশাখ আসে কালো আর জীর্নতা থেকে পৃথিবীকে পবিত্র করতে। এবারের পহেলা বৈশাখ ছিলো তার উল্টো। ১৫ জন তরুণী পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠানে লাঞ্চিত হয়েছে। পরদিন সংবাদপত্রগুলোতে বৈশাখের ভালো খবর ছাপিয়ে প্রাধাণ্য পেয়েছে তরুণীদের লাঞ্চিত হওয়ার সংবাদটি। শিক্ষার্থীদের হাতে তরুণীদের লাঞ্চিত হওয়ার বিষয়টি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কতটা বেদনা দায়ক তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।

আজকে শুধু শিক্ষাঙ্গনের শিক্ষার্থীদেরই মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটেছে বিষয়টি তা নয়। গোটা দেশব্যাপি এ অবক্ষয় স্পষ্ট। বখাটেপনার শিকার হয়ে ছাত্রীদের আতœহত্যা, নিয়মিত ধর্ষন আর যৌন হয়রানির ঘটনাগুলো তারই উদাহরণ। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও উঠছে যৌন হয়রানির অভিযোগ।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদ হত্যাকান্ডকে যে যেভাবেই বলুক, এটাতো ঠিক এ আসাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের মত একটি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠের শিক্ষার্থী। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে পড়াশোনা করতে। সে পড়াশোনা করে চাকরি করবে। দুঃখী পরিবারের দুঃখ ঘুচাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেকটি শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেই এটা সত্য। সেখানে যদি শিক্ষার্থী নিহত হয়, পরিবারগুলো কিভাবে তার সন্তানের হত্যাক্ান্ড মেনে নেবে। সন্তানের খুন হওয়া একজন মাতা পিতার জন্য কতটা কষ্টের তা ভূক্তভোগিরাই ভালো জানেন।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার্থী হত্যার এ ট্রেন্ড অনেক আগ থেকেই চলে আসছে। সববিশ্ববিদ্যালয়েই কমবেশী অনেক শিক্ষার্থী খুন হেেয়ছে। এসব হত্যাকান্ডের মধ্য দিয়ে যে বিষয়টি আলোচনায় চলে আসে সেটি হলো ক্যাম্পাস নিরাপত্তা। যদি শিক্ষাঙ্গন বা ক্যাম্পাস এ জীবনের নিরাপত্তাই না থাকে সেখানে পড়াশোনা আর গবেষনার চিন্তা করাটাও অমূলক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদ হত্যার পর যেটা দেখা গেছে, অনেক শিক্ষার্থীই নিরাপত্তার অভাবে বাড়ি চলে গেছে। যারা হলে অবস্থান করছে তারাও ভয়ে বাইরে বের হচ্ছেনা। মেয়েরাতো আরো ভয়ে আছে। এখন চবির গোটা ক্যাম্পাসেই বিরাজ করছে ভীত বিহবলতা।
ক্যাম্পাসের এ নিরাপত্তার হুমকি আমাদের গোটা শিক্ষাব্যস্থার জন্যই একটা চ্যালেণজ। এর প্রভাব হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এ নিরাপত্তার স্বার্থে প্রত্যেকটি ক্যাম্পাসে সংগঠিত ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত এবং বিচার হওয়া প্রয়োজন্। এ তদন্তের মাধ্যমে একটি ঘটনার ও যদি সুষ্ঠু কারণ শনাক্ত করা যায় বা সে ঘটনার সাথে কারা জড়িত সেটার গডফাদারই বা কে তবে হয়তো প্রত্যেকটি ঘটনা আমাদের কাছে স্পষ্ট হতো।
ইদানিং সংবাদপত্রগুলো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘটনায় একটা গ্রুপের সন্ধান পেয়েছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অপকর্মের জন্য বিভিন্ন সময়ে বহিস্কার হয়েছে। তারাই সেখানে এখনও নানা অপরাধ করছে। এভাবে প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই একটা না একটা অপরাধী চক্র সক্রিয় রয়েছে। এছাড়া যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সীমানা গ্রামের সাথে রয়েছে সেখানে গ্রাম বাসীর সাথে ভালো আচরণ করার বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা আলাদা করে নিরাপত্তা বেষ্টণীর কথাতো আগেই বলা হলো।
ক্যাম্পাস নিরাপত্তায় রাজনৈতিক কমিটমেন্টটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ক্যাম্পাসে যত সংঘর্ষ বা আহত নিহতের ঘটনাই ঘটেছে অধিকাংশই ঘটেছে রাজনৈতিক কারনে। বিশেষ ছাত্ররাজনীতির নামে এখন ঘটছে সংঘর্ষ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আসাদের মত এভাবে হত্যাকান্ড চলতে দেয়া যায়না। যারাই এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে তাদের খুজে বের করে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ভবিষ্যতে এসব হত্যাকান্ড আর যাতে না ঘটে সে ব্যাপারে সরকারসহ প্রশাসনের অধিক সতর্কতা তৎকাম্য।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।