Mahfuzur Rahman Manik
নারী শিক্ষা, উন্নয়ন ও বাস্তবতা
এপ্রিল 4, 2010

নারী শিক্ষা, উন্নয়ন ও বাস্তবতা

মাহফুজুর রহমান মানিক
৮ মার্চই যদি নারী দিবস হয় বাকী দিনগুলো কী? অর্থাৎ অনেকে বলেন বছরের একটি দিন মাত্র নারীর আর বাকী দিনগুলো কী পুরুষের? তাহলে একদিন নারী দিবস নির্ধারন করে প্রকারান্তরে নারীদের কী খাটো করা হলো। একদিকে চিন্তা করলে এ যুক্তি অমূলক নয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো অবহেলিত নারীর ঘুরে দাঁড়ানোর সুচনাটা এ দিন ছিলো বলেই, দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে নারী দিবসের অবতারনা। মূলত প্রত্যেকটি দিনই যেমনভাবে পুরুষের তেমনি নারীরও।নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে সবসময়ই প্রতিবন্ধকতা থাকে। দেশের প্রায় ৭৫ ভাগ মানুষ গ্রামে বাস করেন। গ্রামের অধিকাংশ মানুষই মনে করেন তাদের মেয়েদের এসএসসির পর পড়ানো মানে বেহুদা খরচ। অনেকেতো তারও আগে মেয়েদের পড়াশোনা বাদ দিয়ে দেন। তাদের ভাবনা বউ, সংসার আর সন্তান উৎপাদনই মেয়েদের প্রধান কাজ। এর জন্য পড়াশোনার প্রয়োজন নেই। ফলে গড়ে ১৫ বছরেই মেয়েদের বিয়ে হয়ে যায়। বউ হয়ে আবার পড়াশোনার সুযোগ কোথায়। ফলে দেশের একটা বড় অংশের মেয়েরা একটা পর্যায়ের পর নিশ্চিতভাবে পড়াশোনা থেকে ঝরে পড়ছে।শহরে বাকী যে ২৫ ভাগ মানুষ বাস করেন এর ১০ ভাগই বলা যায় অত্যন্ত মানবেতর জীবন যাপন করেন। যারা তাদের মেয়ে সন্তান কেনো পুত্র সন্তানদেরই পড়াশোনা করাতে পারেন না। বাকী থাকলো ১৫ ভাগ, যারা মনমানসিকতা, অর্থসম্পদে উচ্চমানের, এদের সন্তানরা ছেলে হোক মেয়ে হোক উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে। অবশ্য গ্রামেও অনেক আধুনিক চিন্তার অধিকারী মানুষ আছেন, সমস্যা হলো অর্থনৈতিক। মেয়েদের পড়াশোনার জন্য একদিকে পর্যাপ্ত প্রতিষ্ঠান নেই আবার দূরে বা শহরে পড়াশোনা করানোর মতো অনেকের সামর্থও নেই।ধর্মীয় গোড়ামীর কারণেও অনেকে মেয়েদের প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে চান না। কবি নজরুল পঞ্চাশ বছর আগে এ বিষয়টি বলে গেলেও বাস্তবতা এখনও বলবৎ আছে। তার কবিতার লাইন-‘বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে/আমরা তখনো বসে বিকি তালাকের ফতোয়া খুঁজছি/কোরানও ফিকাহ চষে’। নারী শিক্ষার প্রতিবন্ধকতা যেমন মানসিকতা, অর্থনৈতিক সমস্যা কিংবা গোঁড়ামি একই সাথে নিরাপত্তাও বটে। যেমন আজকের পিংকীরা আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিচ্ছে মুরাদ নামক নরাধমদের কারণে কিংবা ক্যাম্পাসে ছাত্রের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছে ছাত্রী। নিরাপত্তাজনিত কারণে অনেক অভিভাবক তার মেয়েকে প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে ভয় পান।এতসব প্রতিবন্ধকতা থাকা সত্ত্বেও এ পর্যায়ে দাড়িয়ে আমরা বলতে পারবো আমাদের নারীরা এখন আর শিক্ষায় তেমন পিছিয়ে নেই। বেগম রোকেয়ার কাছে যখন শিক্ষা অফিসার গ্রাজুয়েট নারীর তালিকা পেয়েছে, তার সময়ে তিনি ক’জন পেয়েছেন, তার কথা-‘কিন্তু আমি বঙ্গের মাত্র একটি গ্রাজুয়েট এবং আগা মইদুল সাহেবের কন্যাত্রয় ব্যতীত আর কাহারো নাম দিতে পারিনাই। আর এখন শুধু গ্রাজুয়েটই নয় বিসিএস এর ২৮ টি ক্যাডারে পাঁচ হাজারের ও বেশি নারী কাজ করেন। আর গ্রাজুয়েশন করে অন্যান্য চাকরিতে তো নারীরা আছেনই।আমাদের জাতীয় শিক্ষায় পুরুষের তুলনায় নারীর অনুপাতও একেবারে কম নয়। শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০০৫ এর তথ্য মতে, (তার আগে একটু বলে রাখি, অত্যন্ত দু:খের বিষয় এখন ২০১০ সাল আর পাঁচ বছর আগের পরিসংখ্যান এখানে দিতে হচ্ছে, শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা এর অধীনে যে ব্যানবেইজ আছে এরা কী প্রতি দু’বছর অন্তর অন্তর জাতিকে নতুন পরিসংখ্যান দেখাতে পারে না?) প্রাথমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬২ লাখ ২৫ হাজার ৬৫৮ জন এর মধ্যে ছাত্রী ৮১ লাখ ৩৪ হাজার ৪৩৭ জন। এখানে ছাত্রী অর্ধেকের চেয়ে একটু বেশি। মাধ্যমিকের চিত্র আরেকটু ভালো, মোট শিক্ষার্থী ৭৩ লাখ ৯৮ হাজার ৫৫২ জন, ছাত্রী ৩৮ লাখ ৬৮ হাজার ১৪ জন। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের এ দু’টি পরিসংখ্যান থেকে আরেকটু দেখার বিষয় হলো প্রাথমিকে মোট শিক্ষার্থী ১ কোটি ৬২ লাখ হলেও মাধ্যমিকে এ সংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে মাত্র প্রায় ৭৪ লাখ অর্থাৎ অর্ধেকের বেশি ছেলে এবং মেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা হতে ঝরে গেছে। বিষয়টা উদ্বেগেরই বটে।কলেজ লেভেলে এসে (এইচএসসি ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি, স্নাতক, স্নাতকোত্তরসহ) ছাত্রী সংখ্যা কিছুটা কমলেও হতাশ হওয়ার মতো চিত্র নয়, মোট শিক্ষার্থী ১৩ লাখ ৬৭ হাজার ২৪৬ জন, ছাত্রী ৫ লাখ ৬৯ হাজার ৩৩৭ জন। বিশ্ববিদ্যালয়ে (পাবলিক ও প্রাইভেট) এসে অবশ্য আনুপাতিক হারে ছাত্রী বেশ কমে গেছে, মোট শিক্ষার্থী ২লাখ ৭ হাজার ৫৭৭ জন, ছাত্রী ৪৯ হাজার ৮৬৭ জন। আমাদের নারী শিক্ষার তুলনামূলক চিত্র খুব বেশি খারাপ নয়। ২০০১ এর শেষ ও চতুর্থ আদমশুমারী অনুযায়ী পুরুষ এবং নারীর অনুপাত যথাক্রমে ১০৩.৮:১০০। আবার নারী শিক্ষার এ চিত্র আরো পাঁচ বছর আগের সে হিসেবে বর্তমানে এ সংখ্যা বাড়বে নিঃসন্দেহে।আজকে বিশ্বব্যাপী নারীর জাগরন হয়েছে। বাংলাদেশেও তার ছোঁয়া লেগেছে। নারীরা উচ্চশিক্ষিত হয়ে সকল সেক্টরে ভূমিকা রাখছে। তবে অনেক সময় আমরা নিজেরাই সেটা মেনে নেইনা। এ প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলা যেতে পারে। বাংলাদেশি এক শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে যাবে। সকল কিছু সেরে বিমান বন্দরে এসেছে। বিমান চড়েই তার যায়যায় অবস্থা। সুস্থ মানুষ হঠাৎ বিমান চড়ে অসুস্থ। সবাই তাকে ধরাধরি করে শুশ্রƒষা করছে। শ্রমিকের ভাবটা এমন যেনো সে ভয় পেয়েছে। তাকে জিজ্ঞেস করা হলো কী সমস্যা, কোন সমস্যা নয়। অবশেষে জানা গেলো বিমান চালক (পাইলট) কে দেখে তার এ অবস্থা। কারণ চালক ছিলো একজন মহিলা। লোকটা ভেবেছে একজন মহিলা কিভাবে বিমান চালাবে, সে তো নির্ঘাৎ অ্যাক্সিডেন্ট করবে। তার ভাবনা বিমান শুধু পুরুষরাই চালাতে পারে, নারীরা নয়।নারী শিক্ষা দিয়ে শুরু করছিলাম। আজকে নারী জাতি যত শিক্ষিত হবে আমাদের উন্নয়নের পথ ততই শানিত হবে। শিক্ষা আর উন্নয়ন দু’টি একটি অপরটির পরিপূরক। নারীরা শিক্ষিত হয়ে কোন চাকরি না করলেও তারা উন্নয়নে অনেক ভূমিকা পালন করতে পারবে। এ ক্ষেত্রে নেপোলিয়ানের কথাটি না বললেই নয়। তিনি বলেছেন- তুমি আমাকে শিক্ষিত মা দাও, আমি তোমাকে শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো। শিক্ষিত জাতি মানেই উন্নত জাতি। বেগম রোকেয়া যেমন নারীদের সমাজের অর্ধাঙ্গী কল্পনা করেছেন, তেমনি প্রত্যেক পুরুষকে তার স্ত্রীকে অর্ধাঙ্গী হিসেবে দেখা উচিত। তাদের মেয়ে সন্তানদের মনে করা উচিত আগামী দিনের যোগ্য নাগরিক। আমাদের রাষ্ট্র যদি রাষ্ট্রীয় উন্নতি চায়, সকলের অধিকার নিশ্চিত করতে চায় অবশ্যই নারীদের দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। নারীর শিক্ষার সুবিধা আরো বাড়াতে হবে। চীনাদের যে প্রবাদ, ‘যদি একশ বছরের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করো তবে মানুষকে শিক্ষিত করে তোল। এখানে নারী শিক্ষা ও গুরুত্বপূর্ন। এক্ষেত্রে শুধু রাষ্ট্রকেই নয় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিও ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। এরপর নারী পুরুষ সকলের প্রচেষ্টায় আমরা দেশকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবো।

দৈনিক ডেসটিনিতে প্রকাশিত  ১০ মার্চ ২০১০
ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।