গরিব, আগুনে বড়লোক!
আমাদের জাতীয় জীবনে ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ একটা শোকের দিন। গত বছরের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির বিডিআর বিদ্রোহে ৫৭ জন প্রশিক্ষিত সেনা নায়কদের আমরা হারিয়েছি। ২০১০-এ এসে ২৫ ফেব্রুয়ারি যখন নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণ করে চোখের পানি ফেলছি, তখনি আরেক দুঃসংবাদ এসে উপস্থিত। ২১ জন মূল্যবান শ্রমিকের লাশ। গাজীপুরের গরিব এন্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় আগুন। আগুনের ভয়াবহতা খুব বেশি না হলেও একসাথে এতো শ্রমিকের মৃত্যু আমাদের ব্যথাতুর হৃদয়কে আরো ব্যথিত করে। আগুনে একজন শ্রমিকেরও হতাহত হওয়ার কথা নয় সেখানে একুশটি নিরীহ প্রাণ ঝরে গেল। কতটা নির্মম ঘটনা। আমরা যদি একুশ শতকের আগুনে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছে, এমন একটি ঘটনার কথা বলি তাও প্রবোধ পাই না, ২০০৪-এ প্যারাগুয়ের আসুনসিয়নে একটি সুপার মার্কেটে আগুন লেগে ৩শ ৭০ জন নিহত হয়, সে ঘটনায় আগুনের সাক্ষাৎ পেয়েছিলেন তারা, কিন্তু আমাদের এ শ্রমিকরা আগুনের প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎ না পেয়েও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। সচেতনতা, বুদ্ধি কতটা গুরুত্বপূর্ণ এ ঘটনা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে। প্রায় প্রত্যেকটি সংবাদপত্রই বিষয়টাকে প্রধান শিরোনাম করেছে। কেউ লিখেছে ‘কাল হলো নিরাপত্তার তালা’, কারো শিরোনাম ‘বন্ধ দরজা আর বিষাক্ত ধোঁয়ায় মারা গেলো তারা’। এসব ঘটনা আমাদের যতই সাবধান করে আমরা ততই বোকা হচ্ছি মনে হয়। কারণ এর কিছুদিন আগেও ঠিক এ রকম ঘটনায় জাপান গার্ডেন সিটিতে একই পরিবারের সাতজন মারা যায়।
আগুনের কারণে মৃত্যুর মিছিলের দৈর্ঘ্য এভাবে কত বড় হবে। এবার যেখানে গার্মেন্টস এ আগুন। গার্মেন্টস শিল্প বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান শিল্প বটে, এ শিল্প থেকে আমাদের মোটা অংকের রফতানী আয় অর্জিত হয় বটে, এতে এ শিল্পের মালিকরা অনেকে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হন বটে, কিন্তু যাদের শ্রমের বিনিময়ে বর্তমানে এ শিল্প জয়জয়কার সে শ্রমিকরা বরাবরের মতোই নিগৃহীত। অজ পাড়াগায়ের নিঃস্ব মানুষগুলো একটু বাঁচার তাগিদে এখানে কাজ করে। সারাদিন কলুর বলদের মতো খেটেও ৩/৪ হাজার টাকা আয় করাও তাদের অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারপরও মালিকরা ঠিকমতো টাকা পরিশোধ করে না। প্রায়ই আন্দোলন করে শ্রমিকদের টাকা আদায় করতে হয়। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো এখানে আমাদের অনেক নারী শ্রমিক কাজ করেন। আমাদের এসব মা আর বোনরা পারিবারিক কাজের পাশাপাশি অর্থনৈতিক কাজেও পরিবারকে সাপোর্ট দিতে কাজ করেন। এসব কর্মরত মা বোনদের নির্যাতনের খবর প্রায়শই শোনা যায়। তবুও পেটের জ্বালায় কাজ করে যান।
গরিব এন্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় আগুনের ঘটনায় যারা মারা গেছেন তাদের অধিকাংশই নারী। ২১ জনের মধ্যে ১৫ জন নারী বাকি ৬ জন পুরুষ। নিঃস্ব এসব নারী কতোটা খাটুনি খেটে পরিবারকে অর্থনৈতিক সাপোর্ট দিতেন ভাবা যায়? যখন তার সন্তান মায়ের লাশ নিতে এসে বলে, ‘গরিবে কাজ করতে এসে মা এখন বড়লোক।’ মানবতার প্রতি কতোটা কটাক্ষ। ছেলে মায়ের লাশের কফিনের জন্য ১৫ হাজার টাকা পেয়ে, আর পরিবারের জন্য ২ লাখ টাকা ঘোষণায় এ মন্তব্য করে।
গার্মেন্টস ফ্যাক্টরী শ্রমিকদের ঘামে পণ্য তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে, বিদেশে রফতানি করে টাকা পায়। শ্রমিকদের ভাগ দিতে গেলেই, তাদের অধিকার দিতে গেলেই সব শেষ, নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। শ্রমিকদের নিরাপত্তা তো অনেক দূরে। আগুন লাগা এ গার্মেন্টসে কথাই ধরা যাক, আট মাসে তিনবার আগুন। গত বছরের আগস্ট মাসে এ কারখানায় অগ্নিকান্ডের ঘটনায় একজন দমকল কর্মীর নির্মম মৃত্যু হয়। এরপরও টনক নড়েনি মালিকের। কোনো ব্যবস্থাই নেয়নি, উল্টো ছয় তালার বিল্ডিংকে অবৈধভাবে বানিয়েছে সাত তলা।
শুধু এ গার্মেন্টসই নয় অন্যান্যরাও যে সচেতন তা কিন্তু নয় বা আগুনের ঘটনা যে শুধু এ গার্মেন্টসে হয়েছে তাও নয়। একটি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন আনুসারে পোশাক কারখানায় আগুনে বছরে প্রাণহানি ঘটে ৪১ শ্রমিকের। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ সাল থেকে এ পর্যন্ত আগুনে পুড়ে কমপক্ষে ৪১৪ জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গার্মেন্টসে আগুনের বড় ঘটনা ঘটে ২০০৬ সালে। সে বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের কেটিএস কম্পোজিট টেক্সটাইল মিলে আগুন ধরলে ৯১ জন শ্রমিক পুড়ে মারা যান। এর আগের বড় ঘটনা ২০০০ সালের ২৫ নভেম্বর নরসিংদীর চৌধুরী নিটওয়্যার এন্ড গার্মেন্টস লিমিটেড এ আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান ৫৩ জন শ্রমিক।
পোশাক শিল্পে আগুনেই শ্রমিক হতাহত হয়নি বরং প্রতিনিয়ত সংঘর্ষ, ফ্যাক্টরি ধস, শ্রমিক অসন্তোষ এবং নিরাপত্তার অভাবে অনেক শ্রমিক মারা যায়। পোশাক শিল্পের ইতিহাসে আমাদের দেশে ১৯ বছর আগে প্রথম অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। সে ঘটনার ধারাবাহিকতায় ১৫০ বারের অধিক এ শিল্প-কারখানায় আগুন লাগে। আগুনের সাথে শ্রমিকদের মৃত্যুর সংখ্যা তো বাড়ছেই।
আমাদের এ আগুনের বিষয়টি যে শুধু গার্মেন্টস এর সাথে জড়িত তা নয়। গার্মেন্টস ছাড়াও প্রতিনিয়তই বিভিন্ন স্থানে দেখছি আগুন। ২৫ ফেব্রুয়ারির পোশাক শিল্পের এত বড় আগুনের ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই ২৮ তারিখ মিরপুর তালতলার বস্তিতে আগুন, এখানে কেউ হতাহত না হলেও অনেক ঘর পুড়ে গেছে। ক্ষতির পরিমাণও কয়েক লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এভাবে আগুনে পুড়ে প্রতিবছর আড়াইশ কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয় বলে সম্প্রতি একটি সাপ্তাহিকের প্রতিবেদনে জানা যায়। অগ্নিকান্ডের (নির্বাপণ) সাথে জড়িত সরকারি প্রতিষ্ঠান ফায়ার সার্ভিস-এর তথ্যমতে, ২০০৮ সালে ৯ হাজার ৩শ দশটি অগ্নিকান্ডে ফায়ার সার্ভিসের ৪ জনসহ প্রাণ হারিয়েছে ১শ ৬ জন, ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ২শ ৩১ কোটি টাকা। গত বছরের এনসিটিবি, বসুন্ধরা এর আগে বিএসইসি ভবনের আগুনের ঘটনা ছিলো অন্যতম আলোচিত ইস্যু।
বিশ্বব্যাপিও আগুনের ঘটনা কম নয়। গত বছরে থাইল্যন্ডের রাজধানী ব্যাংককের সানটিকা ক্লাবে আগুনে পুড়ে মারা যায় ৫৬ জন। ২০০৭ এ রাশিয়ায় একটি নার্সিং হোমে আগুনে মারা যায় ৬৩ জন। এভাবে হংকং, কানাডা, ইরান, মস্কোসহ বিভিন্ন দেশে অনেক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। তবে আমাদের দেশের মতো এত রেকর্ড পরিমাণে অগ্নিকান্ড কোথাও সেভাবে ঘটেনি। আমাদের দেশে অগ্নিকান্ড ঘটলেও ভবিষ্যতের জন্য সাবধান হই না। সাবধানতার কথা বললে অনেক বিষয়ই আসবে, একটা হলো ব্যক্তিগত সাবধানতা অন্যটা, সরকারের বা প্রশাসনের সাবধানতা। প্রত্যেকটি স্থাপনা বা বিল্ডিং তৈরির সময় স্বাভাবিকভাবেই ভবনটির নিরাপত্তার যাবতীয় বিষয় দেখারই কথা, এ ক্ষেত্রে আগুনের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। বাস্তবতা হলো রাজধানীর অধিকাংশ বহুতল ভবনই এদিক থেকে অরক্ষিত। অনেক ভবনে হয়তো ব্যবস্থা থাকলেও সেখানে নেই প্রশিক্ষিত জনবল। গত বছরের বসুন্ধরা সিটিতে আগুনের সময় বিষয়টি দেখা যায়। পাশাপাশি প্রশাসনিকভাবেও আমাদের অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে। বিএসইসি ভবনে আগুন লাগার পর বিষয়টি চোখে পড়ে। ফায়ার সার্ভিসে বহুতল ভবনে অগ্নিনির্বাপনের উঁচু মই নেই। ২০৭টি ফায়ার স্টেশনের জন্য ২০৭টি অ্যাম্বুলেন্সের প্রয়োজন হলেও আছে মাত্র ৬৩টি। সেভাবে দক্ষ জনবলও নেই। অনেক সময় দেখা যায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের অভাবে দ্রুত আগুন নেভানো সম্ভব হয় না।
গার্মেন্টস শ্রমিকদের কারখানায় আগুনের বিষয়টি এ ২১ জন শ্রমিক হতাহত হওয়ার পরও যে খুব একটা আলোচনায় এসেছে তা বলা যায় না। সংবাদপত্রগুলো শিরোনাম, সম্পাদকীয় করেছে ঠিকই তবে বাস্তব উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো নয়। এ ঘটনায় মালিক গা ঢাকা দিয়েছেন, দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন কবে প্রকাশ হবে, প্রকাশ হলেও বাস্তব কার্যকারিতা বা দোষীদের শাস্তি দেয়া হবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। সবচেয়ে বড় কথা হলো যে কারণে অগ্নিকান্ডের ঘটনা অর্থাৎ বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার উন্নতি, শ্রমিকদের পরবর্তী নিরাপত্তার ব্যবস্থা আদৌ নেয়া হবে কিনা তার নিশ্চয়তা নেই। কারণ এর আগেও এমন অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে, হতাহত হয়েছে, তদন্ত কমিটিও গঠন হয়েছে। এরপর অনেক সময় তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হয় না, হলেও সে সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না।
আমেরিকাসহ আনেক উন্নত বিশ্ব আমাদের কাছ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি করে। এসব দেশ কখনোই চায় না এভাবে আমাদের শ্রমিকরা মারা যাক। এখানে গার্মেন্টস এ কমপলায়েন্টস সুবিধা, শ্রমিকদের বেতন-ভাতাদির ব্যাপারে সচেতন। গত মাসে আমেরিকার বাজারে রফতানি হওয়া আমাদের পোশাকের ৩০ শতাংশ যে কোম্পানি নেয়, সে ওয়ালমার্টের প্রধান নির্বাহী আমাদের দেশে আসেন। ডগলাস ম্যাকমিলান নামে সে ভদ্রলোককে আমাদের শিল্প মালিকরা বলেন, শিল্প কারখানায় প্রয়োজনীয় সকল সরঞ্জাম রয়েছে, এমনকি গত ২০০৬ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে শ্রমিকদের বেতন। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য এর ক’দিন পরই এ ঘটনা। এ ঘটনার ম্যাকমিলান কিভাবে নেবে। সে যাই হোক, আমাদের মনে রাখা উচিত পোশাক রফতানি শুধু আমরাই করছি না আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বীও আছে। ভারত, শ্রীলংকা, ভিয়েতনামের মতো বড় পোশাক শিল্প উৎপাদন ও রফতানিকারক দেশ বাংলাদেশকে প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করে। এমনকি চীনও এ বিষয়টি নিয়ে অন্তত আমাদের সাথে হিংসা করে।
গরিব এন্ড গরিব সোয়েটার কারখানায় কাজ করতে এসে ২১জন শ্রমিকের লাশ হওয়া আমরা দেখলাম। শ্রমিকদের লাশের এ সারি কখনো কী আমাদের হৃদয়কে একটু নাড়া দিয়েছে? গরিব এ শ্রমিকরা কাজ করতে এসেছে গরিব কারখানায়। তাদের এ গরিবি অবস্থার উন্নয়ন হয়নি কখনো। মাসে মাসে যা পেতো তাতে নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এ শ্রমিকরা কখনো একসাথে লাখ টাকার স্বপ্ন দেখেনি। যে সুফিয়া খাতুন (৪৫) তার ক্যান্সার আক্রান্ত স্বামীকে বাঁচানোর জন্য চাকরি নিয়েছে গার্মেন্টস এ, তার কাছে লাখ টাকার স্বপ্ন থাকাই স্বাভাবিক। সে সুফিয়া লাখ টাকা পাওয়ার অঙ্গিকার পেয়েছে বেঁচে নয়, নিজে লাশ হয়ে। এ শ্রমিক কত দিন কাজ করে পেতো লাখ টাকা। তাদের দারিদ্র্যের বোঝা কী ঘুচতো। বিজিএমইএ প্রত্যেক পরিবারকে দু’লাখ টাকা করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এখন তারা আর গরিব নয় লাশ হয়ে বড়লোক হয়ে গেছে। গরিব কারখানায় গরিব মানুষ কাজ করে বড়লোক! হায় সেলুকাস! এভাবে লাশ হয়ে আর কতো পরিবার বড়লোক হবে। কতো অগ্নিকান্ড ঘটবে। পত্রিকায় কতো শিরোনাম আসবে। কতো সুফিয়া স্বামীকে হাসপাতালে রেখে তাকে বাঁচানোর জন্য নিজে মরবে। কত মা তার আলমগীরের বাজারের আশায় বসে থাকবে। আলমগীর না আসলে বাজার করার টাকা আসবে কোথা থেকে? সে টাকায় ক’দিন একমাস, ছয়মাস, এক বছর, এরপর? এসব প্রশ্ন কাকে করবো? উত্তর দেয়ার মতো বুকের পাঠা কারো আছে, না এভাবে গরিব আগুনে বড়লোক হতেই থাকবে! য়
দৈনিক ডেসিটিন ০৩-০৩-২০১০