এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ইন্টারনেটের সুবাদে শিক্ষাসংশ্লিষ্টরা (শিক্ষক, শিক্ষাবিদ, শিক্ষাগবেষক) আশা করে আসছিলো যে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার প্রচলিত ধারা এবং প্রশাসনিক দিক থেকে একটা পরিবর্তন ঘটবে। ডিজিটাল দুনিয়া এ স্বপ্ন দেখাচ্ছে যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলো হবে ভার্চুয়াল এবং এর মাধ্যমে জ্ঞানের প্রসার ঘটবে। তারা এমন একটি ব্যবসায়িক মডেলের কথা চিন্তা করছেন যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনলাইন কোর্সগুলো তার সুবিধাভোগিদের কাছে পৌঁছানো যায়, যেমনটা আমাজনের পণ্যের বেলায় ঘটে থাকে। ই-বের মত টিউশন ফি নিলামের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। আর শিক্ষার্থীদের মেধার মূল্যায়ন গ্রেডের ভিত্তিতে হবেনা, তার দক্ষতার ভিত্তিতে হবে, যেমন ভিডিও গেমের লেভেল দেখা হয়। বিষয়টা সহজেই অনুমান করা যায়, যেমন শুক্রবারে শিক্ষার্থীরা জিনিয়াস বারে গিয়ে থাকে।
এটা খুবই সত্য যে সাম্প্রতিক সময়ে অনলাইন শিক্ষার বেশ প্রসার ঘটেছে, কম্যুনিটি কলেজ থেকে শুরু করে এমআইটি (ম্যাসেচুসেটস ইনস্টিটিউ অব টেকনোলজি) প্রদত্ত ওপেন কোর্স হিসেবে ভিডিও লেকচার পর্যন্ত (নিউ ইয়র্ক টাইমস কর্তৃপক্ষও তার নলেজ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে এর সঙ্গে জড়িত)। তবে ইন্টারনেট প্রচলিত ধারাকে সেটা অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই হোক মোটের ওপর খুব কমই ক্ষতিগ্রস্ত করছে, আজকে প্রতিযোগিতার বিশ্বে আমেরিকার গ্রেট স্কুলগুলো তার সুবিধাজনক অবস্থানের অনন্য উদাহরণ। আমাদের র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে এমন ভোক্তার অভাব নেই, যারা তাদের অভিভাবকদের কাঙ্খিত শিক্ষার জন্য খুব ভালো টাকা খরচ করতে রাজি।এরকম অভিজাত স্কুলগুলোতে তারা শিক্ষার্থীদের যে এওয়ার্ড দিয়ে থাকে তার মূল্যায়ন অস্বীকার করা সহজ নয়।
স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির সাম্প্রতিক দুটি বিষয় বলছে, সেসময় এগিয়ে আসছে যখন গুণগত উচ্চশিক্ষা টেকনোলজির দ্বারা সকল বাধা অতিক্রম করবে, এবং তারা ইতিমধ্যেই মিউজিক এবং বই শিল্পকে নিয়ে এসেছে, এ শিল্প কোডাক থেকে পোস্টাল সার্ভিস পর্যন্ত (তারা অবশ্য পত্রিকা ব্যবসার কথা বলেনি) এবং এগুলো মধ্যপ্রাচ্যের শক্তিধরদের ক্ষমতার দুর্গে আঘাত হানতে সাহায্য করেছিলো।
ভালো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মাঝে নিউ ইয়র্ক সিটিতে অ্যাপ্লাইড সায়েন্সের একটি শাখা ক্যাম্পাস স্থাপনের বিষয়ে একটা প্রতিযোগিতা লক্ষ্যনীয়। এটা মেয়র মাইকেল ব্লুমবার্গ এর পদক্ষেপ, যিনি শিক্ষা উদ্যোক্তাদের জন্য সিটিকে একটা আদর্শ জায়গা হিসেবে গড়ে তুলেছেন এবং এর মাধ্যমে অন্যান্য শিল্প উদ্যোক্তারাও এখানে আগ্রহী হয়, যেটা চুড়ান্তরূপে সিটির অর্থনীতিকেই সমৃদ্ধ করছে। স্ট্যানফোর্ড তথ্য-প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এতদূর এগিয়েছে যে, আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে ‘এটি বায়োটেকনোলজি পাওয়ারহাউজ’ নামে খ্যাত সিলিকন ভ্যালি এবং কর্ণেলকে ও ছাড়িয়ে যাবে।
তবে স্ট্যানফোর্ড এবং কর্নেল এর মাঝে প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে স্ট্যানফোর্ড-স্ট্যানফোর্ড প্রতিযোগিতাই অধিক মজার বিষয়।
স্ট্যানফোর্ডের নিউ ইয়র্ক ক্যাম্পাসের জায়গাটি যেকোন মূল্যে ভালো। স্ট্যানফোর্ডের পরিবেশ সিলিক্যান ভ্যালির মার্কেটের দিক থেকেও সফলতা পাবে। পূর্ব নদীর পাড়ে প্রতিষ্ঠিত এ ক্যাম্পাস (সিলিকন ভ্যালি-২) ইট পাথরের তৈরি একটি আবাসিক ক্যাম্পাস, যেটা একশ ফ্যাকাল্টি সদস্য এবং ২,২০০ শিক্ষার্থীর এক বিশাল কম্যুনিটি যারা এটি সিটির মধ্যে অবস্থিত বিজনেস কমুূ্যূনিটিও বটে।
ইতিমধ্যে স্ট্যানফোর্ডের একজন অন্যতম প্রতিভাবান শিক্ষক ‘সেবাস্টিয়ান থ্রুন’ এর ভবিষ্যত সম্পর্কে এক অন্যরকম দাবি করেছেন। থ্রুন, একজন জার্মান বংশোদ্ভূত এবং স্ব-প্রশিক্ষিত রোবোটিক্স বিশেষজ্ঞ, যিনি গুগল এর স্ব-চালিত গাড়ি তৈরির টিমে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য বিখ্যাত। তিনি তার “ইন্ট্রোডাকশন টু আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজ্যান্স” অনলাইন কোর্স বিনামূল্যে পড়ানোর ঘোষনা দিচ্ছেন। তার দূরবর্তী শিক্ষার্থীরা একই লেকচার পাবে যার জন্য শিক্ষার্থীরা বছরে ৫০ হাজার ডলার দিচ্ছে, একই অ্যাসাইনমেন্ট এবং একইরকম পরীক্ষা, যদি তারা পাশ করে তারা সম্পন্ন করার সার্টিফিকেট পাবে (এটা অবশ্য স্ট্যানফোর্ডের স্বীকৃতি নয়)। গত মাসে দ্যা টাইমস যখন এটি লিখেছে তখন ৫৮ হাজার শিক্ষার্থী এই কোর্সের জন্য রেজিষ্ট্রেশন করেছে। আর সে লেখার পরে এ সংখ্যাটা পৃথিবীব্যাপি ১লক্ষ ৩০ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
থ্রুনের আল্টিমেট মিশনটা হলো একটা ভার্চুয়াল বিশ্ববিদ্যালয় যেখানে সেরা প্রফেসররা শত শত হাজার হাজার শিক্ষার্থীদের লেকচার দিবেন। মূল্যায়ন, পারস্পরিক যোগাযোগ এবং গ্রেডিং সবই হবে অনলাইনে। একজন শিক্ষণ সাহায্যকারি কিছু মানবিক বিষয় পর্যবেক্ষণ করবেন; এবং এর সেবা-মূল্যটাও সকলের নাগালের মধ্যে থাকবে। “বস্তত, শ্রেণীকক্ষে যে খরচে প্রশিক্ষণ দিই তার দু-একভাগ খরচ দিয়েই আমরা সে মানের শিক্ষা দিতে পারবো বলেই আমাদের বিশ্বাস,” থ্রুন আমাকে বললেন।
তার ভাষায় প্রচলিত বিশ্ববিদ্যালয় অদক্ষভাবে ব্যবসার মানসিকতায় অল্পসংখ্যক শিক্ষার্থীর জন্যই কাজ করে। “আমি আদৌ উপস্থিত ক্যাম্পাস শিক্ষার বিরোধি নই,” তিনি বলেন “আমি এটা ভালোবাসি। এটা বেশভালো, এবং এর অনেক সুবিধা আছে যা অনলাইনে সম্ভব নয়, কিন্তু একই সঙ্গে এটি পাগলামি এবং অপচয়।”
থ্রুন স্বীকার করছেন অনলাইন শিক্ষার মাঝে এখনও গুনগত মান রক্ষাটা একটা সমস্যা। কিভাবে আপনি অদৃশ্য একজন শিক্ষার্থী প্রতারণা করছে কিনা তা জানবেন? এমনকি কিভাবে জানবেন আসলেই ওপাশে কে বসে আছে? তাহলে শিক্ষাটা কি বাধ্য করণের মতো হবেনা- এটা কি শেষ পর্যন্ত টিকবে? থ্রুন নাছোড়বান্দা, তিনি বিশ্বাস করেন এসকল প্রশ্নেরই টেকনোলজিক্যাল উত্তর আছে, এর মধ্যে অনেক কাজ শেষ হয়েছে, বাকীগুলো অনলাইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সমাধান করা সম্ভব।
“আমরা যদি এগুলোর সমাধান করতে পারি,” তার মতে, “আমার মনে হয় এটা হবে সকল উচ্চশিক্ষার জন্য একটা বাধা।”
বাধা হবে ঠিক, তবে এটা সেসকল কলেজগুলোর জন্যহবে ভূমিকম্পস্বরূপ যেগুলো বিশাল অংকের বৃত্তি এবং গবেষণা অনুদানের পরিবর্তে শিক্ষার্থীদের টিউশন এর ওপর নির্ভরশীল। অনেকেই তাদের স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে যাবে। বিখ্যাত শিক্ষকদের লেকচারের জন্য অনেক শ্রোতা হবে এবং অনেকে টাকাও খরচ করবে কিন্তু এটা বলা চলে তাদের জন্যই হবে বা তাদেরই কাজে লাগবে যারা একটু চালাক।
তবে দুঃখের বিষয়টা হলো কিংবা বলা চলে এটাই সত্য যে, এই খেলা পরিচালনা হচ্ছে স্ট্যানফোর্ড থেকে, যেটি অনেক জগতজোড়া প্রযুক্তির পিতৃস্থান। পূঁজির উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক তৈরি এবং শিক্ষার্থীদের মার্কেট পরিচালনার কৌশল শিক্ষা দিয়ে স্ট্যানফোর্ড এ দাবি করছে তারা অন্তত ৫ হাজার ব্যবসার ক্ষেত্র সৃষ্টি করেছে। এটা এমন একটা ক্যাম্পাস যেখানে গ্রাজুয়েট লেভেলের শিক্ষার্থীরা বারবার জানতে চাইবে যে তারা কখন ব্যবসায় শুরু করবে, আর এখানকার কিছু কিছু প্রফেসর অনেক টাকার মালিক, অনেক সম্পদশালী।
স্ট্যানফোর্ডের প্রেসিডেন্ট জন হিনাসী অবশ্য থ্রুনের পরীক্ষণ দেখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়কে আশীর্বাদ করেছেন, তিনি বলেন “একটা প্রারম্ভিক পরীক্ষনমূলক অবস্থা” কিন্তু তিনি ডিজিটালাইজড বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন বিষয়ে মন্তব্য করতে কিছুটা সতর্ক। তবে তিনি বিশেষায়িত কিছু প্রোগ্রাম এবং অব্যাহত শিক্ষার ক্ষেত্রে ভার্চুয়াল ক্যাম্পাসের কল্পনা করতে পারেন, এবং তিনি মনে করছেন অনলাইনে প্রদত্ত শিক্ষা আন্ডার গ্রাজুয়েট পর্যায়ের জন্য কিছুটা অসম্পূর্ণ হয়ে থাকতে পারে। যেমন- বড় কোন লেকচার এর পরিবর্তে ছোট লেকচারেই ল্যাপটপে শিক্ষার্থীদের অধিক মনযোগ থাকে। তিনি অবশ্য অনলাইন শিক্ষণ উন্নয়নশীল দেশের শিক্ষার্থীদের প্রদান করাটা সমর্থণ করছেন, যারা পূর্ণ ক্যাম্পাস শিক্ষাটা আশা করতে পারেনা।
জনাব হিনাসী কিন্তু বাস্তবিক ক্যাম্পাসেরই পক্ষে, অন্তত আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ের শিক্ষার জন্য। তিনি বলেন- ক্রিটিক্যাল চিন্তা, লেখা এবং জনসম্মুখে বক্তব্যের দক্ষতা বাস্তব পর্যায়ের আদান-প্রদান, যোগাযোগ ছাড়া কোনোভাবেই পরিপূর্ণ হতে পারেনা। অনলাইনে শিক্ষার্থীরা সবাই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা শিখছে কিনা, বা এ শিক্ষা তারা কিভাবে রাখবে এটা আদৌ স্পষ্ট নয়।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে সম্প্রতি (৩ সেপ্টে¤র) ম্যাট রিচেল এর নামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়, সেখানে উল্লেখযোগ্য কিছু তথ্যে দেখানো হয়েছে, কিভাবে প্রযুক্তি-নির্ভর শিক্ষা মৌলিক শিক্ষণকে ত্বরান্বিত করছে। এট খুবই সত্য যে, প্রযুক্তির প্রতি মোহ মানুষের জ্ঞানকে বাস্তবে পরিণত করেছেÑ শিক্ষকদের অধিকতর ভালো প্রশিক্ষণ দিয়েছে, শিশুদের অধিকসময় স্কুলে থাকতে দিয়েছে।
স্ট্যানফোর্ডের প্রেসিডেন্ট খুবকম মাত্রারই প্রযুক্তিভীতি আছে। হিনাসী এসেছেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে, তিনি তার শিক্ষা কাজে লাগিয়ে সফলভাবেই মাইক্রোপ্রসেসর কোম্পানি শুরু করতে সক্ষম হন, এবং তিনি গুগল ও সিসকো সিস্টেমের বোর্ড পর্যন্ত পৌছেন।
“ঠিক যেমনভাবে পত্রিকার খরচের বিষয়টা বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, তাদের রিপোটিংএর মান বজায় রাখা ছাড়া গত্যন্তর নেইÑ নিউজপ্রিন্ট এবং ডেলিভারি খরচÑবিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রেও আমাদের বিভিন্ন দিক বিবেচনা করা উটিত” হিনাসী আমাকে বলরেন. “ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণÑÑবাস্তবে যেমনটা রয়েছে, আমি এটা বিশ্বাস করি, একটি আন্ডারগ্রাজুয়েট পর্যায়ের আবাসিক অভিজ্ঞতা থেকেÑআর এটা কি শিখন প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় পর্যায়?”
কিন্তু, তিনি নোট করছেন, “ কোনো কিছু ধরে রাখতে এসব বিষয়গুলো চিন্তা করতে হবে। সবশেষে আধেয় প্রদানকারিকেও পে করতে হবে.”
একটা বিষয় হলো, আমাদের পরিচিত যারাই ডিজিটাল-যুগের রথি-মহারথি হিসেবে বাস করছেন, তারা সবাই ভাঙচেন, যেমন সেবাস্টিয়ান থ্রুন অথবা ন্যাপসটার, কিংবা তাহরির স্কোয়ারের টুইটার যোদ্ধা। আবার একই সঙ্গে অনেকে আছেন যারা সময়ের সঙ্গে খাপখাওয়াতে সক্ষম হোন, যেমন জন হিনাসী বা আইটিউনস (রঞঁহবং) কিংবা যে নতুন করে মিশরকে গড়তে চাইছে। উন্নতি এদের উভয়েরই যুগপত প্রচেষ্টার ফল।
আমরা একটা পরীক্ষণমুলক বিষয়ের বিরোধিতা করতে পারি, যেটা শিক্ষা সম্পদকে খুব বিস্তরভাবে উপস্থাপন করে, যেটা কার্যত কোনো কাজে লাগেনা। কিন্তু আমাদের চিন্তা-চেতনার দিক থেকে খুবই সতর্ক হতে হবে, যাতে করে আজকের দুনিয়ায় এখনও বিস্ময় এরকম কিছু দেখেই উড়িয়ে না দেই।
বিল কেলার: নিউ ইয়র্ক টাইমসের নিয়মিত লেখক
- ভাষান্তর -মাহফুজুর রহমান মানিক