Mahfuzur Rahman Manik
প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণী সমাপনী পরীক্ষা ও কিছু কথা
মার্চ 24, 2010

প্রাথমিক স্তরের সমাপনী পরীক্ষাকে অনেকে বলেছেন মিনি এসএসসি। এ পরীক্ষার পথ ধরে সরকার অষ্টম শ্রেণীতেও সমাপনী পরীক্ষা চালুর ঘোষণা দিয়েছে। যদি চালু হয় তাকে কী বলা হবে জুনিয়র এসএসসি? মূল কথা হলো, এসএসসির আদলে এসব পরীক্ষা হচ্ছে বলে এগুলোর সাথে এসএসসি কে জুড়ে দেয়ার চেষ্টা আর কি। এর আগে জাতীয় পর্যায়ে এসএসসি ছিলো প্রথম পরীক্ষা। ফলে কারো মেধার মাপকাঠি নিরূপনে প্রথমেই এসএসসির ফলাফল জানতে চাওয়া হয়। চাকরির ক্ষেত্রেও এসএসসির ফলাফল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এখন ৫ম শ্রেণীতেই হচ্ছে জাতীয় পরীক্ষা। ফলে জীবনের একটা হিসাব নিকাশ বলা চলে এখন থেকেই শুরু হচ্ছে। এ বছর থেকে আবার যোগ হচ্ছে অষ্টম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা।
জাতীয় পর্যায়ের একেকটি পরীক্ষা জীবনের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সে ধাপে আমরা আমাদের শিশুদেরকে ১০/১১ বছরেই ঠেলে দিচ্ছি। যুদ্ধ যাকে বলে। যদিও আমাদের দেশের শিশুরা ৫/৬ বছর থেকেই যুদ্ধের চ্যালেঞ্জে টিকে আসছে, নামীদামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি যুদ্ধের মাধ্যমে যার সূচনা। এটা অবশ্য রাজধানীসহ বিভাগীয় ও ভালো ভালো শহরের চিত্র। যদিও উচ্চশিক্ষায় এসব সংগ্রামে বেড়ে উঠা শিক্ষার্থীদের খুব একটা দেখা যায় না। অবশ্য ব্যতিক্রমও আছে। ছোটবেলা থেকেই চাপের মধ্যে থাকতে থাকতে বড় হলে এরা ঢিলা হয়ে যায়। ঘুম, বিশ্রাম, খেলাধুলার সুযোগ না দিয়ে সারাদিন পড়া আর পড়া, সাথে ৩/৪ জন হাউজ টিউটরতো আছেই। এগুলো অবশ্য শহরের চিত্র। এসবের বাইরে স্বাভাবিক পরিবেশে থেকেও গ্রামের শিশুরা ভালো করছে। যা এবারের প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় প্রমাণিত হলো।
এ সমাপনী পরীক্ষা কতোটা ভালো বা খারাপ তা পরিমাপের আগে এটা যে শহর আর গ্রামের পড়াশোনার মাঝে একটা সম্পর্ক স্থাপন করেছে তা স্পষ্ট। একটা জাতীয় দৈনিকে কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে, শহরের শিশু তার বাবাকে বলছে, বাবা আমাকে গ্রামের স্কুলে ভর্তি করে দাও। কেন? কারণ আমি ফার্স্ট হতে চাই। এটি কার্টুনিস্টের নিজস্ব চিন্তা হলেও বাস্তব।
গ্রামের স্কুলেও যে পড়াশোনা হয় বা এসব স্কুলে যে মেধাবী শিক্ষার্র্থীরা পড়ছে তা বুঝা গেলো। আমাদের চিন্তা অবশ্য অন্যরকম। নামী-দামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাতে মরিয়া অভিভাবকরা ঠেলে দেন নিশ্চিত যুদ্ধে। আবার অনেকে লবিং এমনকি মোটা অংকের টাকা দিয়ে হলেও নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করান। আমাদের এ চিন্তার পাশাপাশি নীতি নির্ধারনেও কিছু সমস্যা রয়েছে।
শিক্ষাবিজ্ঞানে প্রতিষ্ঠান স্থাপনে পধঃপযসবহঃ ধৎবধ-এর কথা বলা হয়েছে, অর্থাৎ নির্দিষ্ট এলাকার জন্য নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান থাকবে ওই এলাকার শিক্ষার্থীরাই কেবল সে প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারবে অন্য কোন এলাকা বা নির্দিষ্ট এ সীমানার বাইরের কোন শিক্ষার্থী এখানে পড়তে পারবেনা। অনেক দেশে এ পদ্ধতি চালু থাকলেও আমাদের দেশ নেই। এ পদ্ধতি অনুসরণ করলে আমাদের প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ই মানসম্মত প্রতিষ্ঠান হতে বাধ্য।
গত বছরের মাঝামাঝি থাকেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা হওয়ার জল্পনা-কল্পনা চলছিলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে লেগে যায় সেপ্টেম্বর মাস। সেপ্টেম্বরের সাত তারিখের ঘোষণায় প্রাথমিক শিক্ষার সমাপনী পরীক্ষা নিশ্চিত হয় এবং শিক্ষার্থীরা তখন থেকে প্রস্তুতি নেয়। ২১ নভেম্বর শুরু হয় পরীক্ষা। সকাল বিকাল অর্থাৎ একদিন দুই বিষয় করে পরীক্ষা হয়। একদিন দুই বিষয় করে পরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজন কী ছিলো? মানলাম সরকার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা না নিয়ে তার পরিপূরক হিসেবেও এ পরীক্ষা নিচ্ছে। তাই বলে আগের বৃত্তি পরীক্ষার আদলে সকাল বিকাল পরীক্ষা নেয়ারতো কোনো প্রয়োজন ছিলো না।
একেতো ঘোষণাই হয়েছে দেরিতে মাত্র দুই মাস আগে, তার ওপর আবার দিনে দুই বিষয়ের পরীক্ষা। অবশ্য এসব কারণ থাকা সত্বেও শিশুরা যে পরীক্ষায় ভালো করেছে, তা ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার একমাসের মাথায়ই শিক্ষার্থীরা পেয়ে যায় তাদের কাংখিত ফলাফল। মোট প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করলেও অংশগ্রহণ করে ১৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫ জন। অর্থাৎ পরীক্ষার আগেই একটা অংশ ঝরে পড়লো। এরপর অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাস করে মোট ১৬ লাখ ২০ হাজার ৫৪ জন। পাসের হার ৮৮.৮৪ ভাগ। যদিও এরমধ্যে গণিত ও ইংরেজীতে সর্বোচ্চ ১৩ নাম্বার গ্রেস দিয়ে আরো ৭ ভাগ শিক্ষার্থীকে পাস করানো হয়।
পাসের হার ৮৯ ভাগ ধরলেও এখানে ঝরে পড়েছে ১১ ভাগ শিক্ষার্থী। পাস করা শিক্ষার্থীদের প্রথম বিভাগ পেয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭১৭ জন। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে ৬ লাখ ১৫ হাজার ও তৃতীয় কিভাগ পেয়েছে ২৭ হাজার জন। অর্থাৎ ৪১.৭৭ পেয়েছে প্রথম বিভাগ, ৩৭.৯৮ ভাগ পেয়েছে দ্বিতীয় এবং ২০.২৫ ভাগ পেয়েছে তৃতীয় বিভাগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিসেবে ৩৭ হাজার ২২৫টি প্রতিষ্ঠানের সবাই পাশ করেছে। আর ১ হাজার ৯৩৭টি প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীই পাস করতে পারেনি।
প্রাথমিক শিক্ষায় ১১টি ধারা থাকলেও দুঃখজনক হলেও সত্য তার অন্যতম ধারা মাদ্রাসার শিক্ষার্থীরা গত বছরের সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। কর্তৃপক্ষ নাকি তাদের কথা ভুলে গেছে। এ বছর থেকে অবশ্য তাদেরকে অন্তভুক্ত করা হবে। ফলে এ বছর মাদ্রাসা পড়–য়া কোনো শিক্ষার্থী এসে সাধারণ ধারার ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারছে না।
যাই হোক, সার্বিক বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা সফল সরকার ৫০ হাজার শিক্ষার্থীকে ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বৃত্তি দেবে। বেশ ভালো কথা।
প্রাথমিক স্তরের সমাপনী পরীক্ষা চালু করার বিষয়ে কিছু যুক্তি দেখানো হয়েছে, ঝরে পড়ার হার কমানো, এনরোলমেন্ট বাড়ানো, আলাদাভাবে বৃত্তি ব্যবস্থা বাদ দেয়া ইত্যাদি। ঠিকই আছে, কিন্তু তাই বলে এসএসসির মতো দেশব্যাপী পাবলিক পরীক্ষার বোঝা শিশুদের মাথায় দেয়া কতটা কল্যাণের। কম টাকার মধ্যে ফরম পূরণ করা গেছে ঠিক আছে। এ পদ্ধতির খারাপ দিকও আছে। একটি দশ এগারো বছরের শিশুকে এভাবে পাবলিক পরীক্ষার দিকে ঠেলে দেয়া মানে তার মাথায় একটা বোঝা চাপিয়ে দেয়া, যা বহন করতে সে সক্ষম নয়। এ বোঝা হলো পড়ার বোঝা। তার এবং তার অভিভাবকের মাথায় শুধু পাস করার চিন্তা। ফলে শিশুর ধারণ ক্ষমতার বাইরে তাকে পড়তে হবে। গত বছর দেখা গেছে অনেক অভিভাবকই আর সন্তানকে রাত ১২টা পর্যন্ত পড়িয়েছেন। রাজধানীর ভর্তি যুদ্ধেও তাই হয়। ফলে এবার দেখা গেছে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে পরীক্ষার হলেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
প্রাথমিক শিক্ষাসমাপনীতে ফলাফলের যে বিন্যাস তা ও শিশু সুলভ নয়। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ এ ভর্তির ফলাফল দেয়া হয়েছে। যে শিশু প্রথম বিভাগ পায়নি, তার মনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ পাওয়ার বেদনা থাকতে পারে, যা তাকে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই কুঁকড়ে খাবে। সাথে সাথে আজীবন তাকে তৃতীয় শ্রেণীর সার্টিফিকেট নিয়ে থাকতে হবে। এরাতো পাস করলো বলা যায়, কিন্তু যারা পরীক্ষায় পাসই করেনি তারা তো ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারছে না। সে কী করবে? আরেকবার পরীক্ষা দেয়ার প্রেষণা সে কোথা থেকে পাবে। যেখানে তার সব সাথীরা তার উপরের শ্রেণীতে পড়ছে। এদেরকে পরবর্তী ধাপে ফিরিয়ে আনা যে কষ্ট হবে তা বলা যায়। দারিদ্র পিতা-মাতার পুনরায় পরীক্ষায় অংশ দিতে দেয়ার প্রেষণা ফুরিয়ে যাবে। এবার যদিও ১১ ভাগ শিশু পাশ করেনি, একটা বিরাট অংশ এ পরীক্ষায়ই অংশ নেয়নি। এদের জন্য সমাপনী পরীক্ষা কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বয়ে আনবে। এবার আসা যাক ৮ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার বিষয়ে। যাকে বলা যায় জুনিয়র এসএসসি। কিছুদিন হল সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানেও বৃত্তি পরীক্ষার বিষয়টিকে বড় করে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ৮ম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা না হয়ে একেবারে সমাপনী পরীক্ষা।
৫ম শ্রেণীর চেয়ে ৮ম শ্রেণীর এ সমাপনী পরীক্ষাই যুক্তিযুক্ত। ৮ম শ্রেণীকে আমরা শিক্ষার একটা ধাপ বলতে পারি। এ বয়সে তাদেরকে পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন করাই যায়। অন্যদিকে এ স্তর অধিক উপযুক্ত, কারণ এবারের শিক্ষানীতিতে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা করার সুপারিশ করা হয়েছে। শিক্ষানীতির এ প্রস্তাবনা চূড়ান্ত হলে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা হবে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত। তখন প্রাথমিক স্তরের সমাপনী পরীক্ষা হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে এসএসসির মত এ পরীক্ষা নেয়া যায়। যার সার্টিফিকেটও জীবনের সর্বস্তরে কাজে লাগানো যাবে। এখন যেমন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরিতে ৮ম শ্রেণী পাশ করা প্রার্থী চাওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে এ পরীক্ষা বৈধ সার্টিফিকেট প্রার্থী দেখাতে পারবে। এখন দেখা যায় অনেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা না করে ও যেকোন প্রতিষ্ঠান থেকে পাশের নকল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে নকল শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ দেখায়। এবারের শিক্ষানীতিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পর থেকে কারিগরি ভোকেশনাল তথা বাস্তবমুখী পাঠ্যপুস্তকের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তা যথোপযুক্ত। প্রথম শ্রেণী হতে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত আট বছরের শিক্ষা জীবনের অর্জন যেন তার জীবনের অর্জন হয়। অর্থাৎ ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েও সে যাতে তার পরবর্তী জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারে সেটি নিশ্চিত করা। ঠিক যে কারণে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৫ম থেকে বাড়িয়ে ৮ম শ্রেণী করার প্রস্তাবনা এসেছে, একই কারণে ৮ম শ্রেণী শেষে সমাপনী পরীক্ষা নেয়া দরকার। সরকার একই সিলেবাসের কথা বলেছে। ৮ম শ্রেণী সমাপনী পরীক্ষায় একই সিলেবাস হলে মাদ্রাসা যাবে কোথায়? তাহলে কি গতবারের ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার মতো অষ্টম শ্রেণীতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বঞ্ছিত করা হবে। এ বছর মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে মাদ্রাসা এবং স্কুলে দুই সিলেবাসে পরীক্ষা নেয়া যেতে পারে। অবশ্য এ ব্যাপারে মাত্র সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সভাপতি করে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে তাদের সুপারিশ দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
গত বছর থেকে যে ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা চালু হয়েছে তা নিয়ে অনেকের দ্বিমত রয়েছে। এটা বাদ দেয়ার পক্ষে কথা বলেছেন অনেক অভিভাবকও। তারা মনে করছেন, ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা বাদ দিয়ে একেবারে ৮ম শ্রেণীতেই সমাপনী পরীক্ষা হবে। তবে যেহেতু ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে এটাকে বাতিল না করে শিশু উপযোগী কিছু সংস্কার করা যেতে পারে।

দৈনিক ডেসটিনি ১৩ জানুয়ারি ২০১০

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।