Mahfuzur Rahman Manik
ছাত্র সংসদ নির্বাচন: ইশতেহার যেন কথার কথা না হয়
নভেম্বর 1, 2025

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসু নির্বাচন ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ জাকসু নির্বাচনে শিক্ষার্থীরা যে রায় দিয়েছে, সেখানে তাদের প্রত্যাশা অনুধাবন করা জরুরি। উভয় ক্যাম্পাসে ইসলামী ছাত্রশিবিরের ভূমিধস বিজয়ই প্রমাণ করছে, তারা শিক্ষাঙ্গনে কতটা পরিবর্তন চায়। সে জন্য বিজয়ই শেষ কথা নয়। বরং ইশতেহার অনুযায়ী শিক্ষার্থীদের স্বার্থে কাজ করাই অগ্রাধিকার হওয়া দরকার।

বিশেষ করে গত দেড় দশকে শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতাসীন দলের ভয়ে শিক্ষার্থীরা যেভাবে তটস্থ থাকত, সে ধরনের ভীতিকর পরিবেশ তারা চায় না। শিবিরও নির্বাচনী প্রচারণায় এমন ক্যাম্পাস গড়ার স্বপ্ন দেখিয়েছে এবং শিক্ষার্থীরাও তাদের ওপর আস্থা রেখে একচেটিয়া ভোট দিয়েছে। তা না হলে ডাকসুর ২৮টি পদের বিপরীতে ২৩টি জয়লাভ করা এবং জাকসুতে ২৫টির বিপরীতে ২০টিতে জয়লাভ করা সহজ ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বাভাবিকভাবেই দেশের সাধারণ মানুষ থেকে অনেক সচেতন। তারা জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যেমন সব বয়ান উপেক্ষা করেছিল, এ দুটি বিশ্ববিদ্যালয়েও অনুরূপ ঘটনা ঘটেছে। অর্থাৎ কথা নয়; শিক্ষার্থীরা কাজেই বিশ্বাসী।

ভোটের মাধ্যমে যারা নির্বাচিত হন তাদের মধ্যে ভোটারের আমানত রক্ষার তাগিদ থাকা দরকার। এমনটা হওয়া উচিত নয়– আমি নেতা হয়েছি। বরং এ অনুভূতি থাকা দরকার– মানুষ আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে। সেই দায়িত্বশীলতাই ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে থাকা চাই। এটা দুই কারণে জরুরি। প্রথমত, শিক্ষার্থীদের দিক থেকে। অর্থাৎ তারা দেখবে, তাদের প্রত্যাশা কতটা পূরণ হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, যারা জয়লাভ করতে পারেনি তারাও বসে থাকবে না। প্রার্থীদের ইশতেহার, প্রতিশ্রুতি, বক্তব্য প্রযুক্তির কারণে হাতের নাগালেই আছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী কাজ না হলে তাদের ধরাও সহজ হবে। ডাকসুর নবনির্বাচিত ভিপি সাদিক কায়েম অবশ্য বলেছেন, ‘শিক্ষার্থীরা যে কোনো বিষয়ে, যে কোনো সময়ে আমাদের প্রশ্ন করতে পারবে। আমাদের দায়িত্ব কাজ করা, আর শিক্ষার্থীদের কাজ হচ্ছে আমাদের প্রশ্ন করা।’ শিক্ষার্থীরা প্রশ্ন করতে হলে সেই পরিবেশও নিশ্চিত করতে হবে। 

এটা ঠিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ আলাদা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে সেখানকার বিষয় তুলে ধরা আমার জন্য সহজ। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কমন কিছু বিষয় আছে। যেমন গেস্টরুম, গণরুম সংস্কৃতি কিংবা র‍্যাগিং ইত্যাদি যাতে ক্যাম্পাসে না থাকে, সেই প্রত্যাশা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর। এসব বিষয়ে প্রায় প্যানেলই জোর দিয়েছিল। ছাত্রশিবির তাদের ইশতেহারে এ বিষয়গুলো যেমন প্রত্যাশিতভাবে এনেছে, তেমনি নির্বাচনী প্রচারণায়ও সেভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে উপস্থাপন করতে সক্ষম হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি, শিক্ষার্থীদের আবাসন সমস্যা, পরিবহন সংকট, ছাত্রীদের নিরাপত্তা, গবেষণা খাতে অপ্রতুল বরাদ্দ ইত্যাদি বিষয় সমাধানের আশ্বাসই যথেষ্ট নয়। বরং সমস্যার ধরন অনুসারে সমাধানে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করে আগাতে হবে। 

ছাত্র সংসদগুলোর সীমাবদ্ধতা অন্তহীন। তাদের বাজেট নেই বললেই চলে; ক্ষমতারও সীমাবদ্ধতা আছে। তারা যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করবে, সে জন্য শিক্ষার্থীদের স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে তারা প্রশাসনকে জবাবদিহি করতে পারবে। তবে তারা অ্যালামনাইদের সঙ্গে নিয়ে বড় পরিকল্পনাও বাস্তবায়ন করতে পারে, বিশেষ করে যেখানে অর্থ প্রয়োজন। অবশ্য অবকাঠামোগত সংকট ও শিক্ষার্থীদের সুস্থতা নিশ্চিত করার প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ যে গবেষণা ও নতুন জ্ঞান সৃষ্টি, সেখানে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বড় শূন্যতা তৈরি হয়েছে। শিক্ষার পরিবেশ ফিরে এলে এই শূন্যতা দ্রুত কাটানো সম্ভব। এখানে ছাত্র সংসদ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

শিক্ষাঙ্গনে পরিবেশ রক্ষা মানে সহাবস্থানও নিশ্চিত করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উন্মুক্ত জায়গায় সবার মতপ্রকাশের অধিকার থাকা জরুরি। জুলাই অভ্যুত্থানের পর কাঙ্ক্ষিত সে চিত্র নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু শঙ্কা থেকে গেছে, এমন পরিবেশ টেকসই হবে কিনা। ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের আগে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি প্যানেলই পরস্পর শ্রদ্ধা ও সহনশীলতা দেখিয়েছে। এমনকি ডাকসু নির্বাচনের আগে জুলাইযোদ্ধা হিসেবে এমন বক্তব্যও ভিপি প্রার্থীদের মুখ থেকে এসেছে, ‘একজন জিতলে জিতে যাবে সবাই‚ হারার প্রশ্নই  নাই। কারণ ৫ আগস্টের পর আমরা সবাই জিতে গেছি।’ এ বিষয়টি সাদিক কায়েম, ফরহাদ ও মহিউদ্দিন কিংবা জাকসুর ভিপি-জিএস-এজিএসকে মনে রাখতে হবে। বড় বড় কাজে সব ছাত্র সংগঠনের মতামত গ্রহণ করলে সবাই মিলে সহজে তা সমাধান করা সম্ভব হবে। 

ডাকসু ও জাকসুর ফল সামনে অনুষ্ঠিতব্য রাকসু ও চাকসুর ক্ষেত্রে দেখা গেলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। কিন্তু এমন সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আসার পরও শিবিরের প্যানেল তাদের ইশতেহারে প্রতিশ্রুত কাজ কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে সমাধান করতে না পারলে তা হবে হতাশাজনক। এটা তাদের জন্য পরীক্ষাও বটে। এক বছর কাজের পরিবেশ পেয়ে তারা যেভাবে শিক্ষার্থীদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে, এখন দায়িত্ব পেয়ে তারা সেই ধারা কতটা বজায় রাখতে পারে। ডাকসুতে অল্প সময়ের মধ্যে কিছু কাজ তারা শুরু করে দিয়েছে। তবে হলের খাবারের মান ঠিক রাখার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের ভিপি যেভাবে ক্যান্টিন ম্যানেজারের সঙ্গে আচরণ করেছে, তা অনেককেই হতাশ করেছে। মার্জিত ব্যবহার এবং বাস্তবতার আলোকে সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী হলে তার সমাধান সহজ হবে।

চারটি স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ডাকসু, জাকসুতে নির্বাচন হয়েছে এবং রাকসু ও চাকসু নির্বাচনও এক মাসের মধ্যে সম্পন্ন হবে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় এমনকি কলেজেও ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দাবি উঠছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্র সংসদ চালুর দাবি জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও হয়তো খুব শিগগির এ নির্বাচন আমরা দেখতে পাব। এ নির্বাচনগুলোর মাধ্যমে ক্যাম্পাসে ইতিবাচক পরিবেশ দেখা গেলেই কেবল এগুলো নিয়মিত হওয়ার তাড়না জোগাবে। 

ইশতেহার যেন কথার কথা না হয়, সমকালে প্রকাশ: ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।