Mahfuzur Rahman Manik
শিক্ষা, মূল্যবোধ ও সামাজিক অবক্ষয়
এপ্রিল 29, 2010

শিক্ষা, মূল্যবোধ ও সামাজিক অবক্ষয়মাহফুজুর রহমান মানিক
শিক্ষা কী? এ প্রশ্নটির উত্তর দিতে দার্শনিক, শিক্ষাবিদ, মনীষী অনেকেই গলদঘর্ম হয়েছেন। দুই অক্ষরের এ শব্দটির ব্যাপকতা এত বেশি যে একে একটি বা কয়েকটি বাক্যের ফ্রেমে আবদ্ধ করা অত্যন্ত কঠিন। তবুও একে সবাই নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে সংজ্ঞায়ন করার চেষ্টা করেছেন। শিক্ষার গ্রহনযোগ্য সংজ্ঞা আর পরিচিতি যাই বলি, সেটা হলো- ‘আচরণের কাংখিত এবং ইতিবাচক পরিবর্তন’। অর্থাৎ যে মানুষটি শিক্ষাগ্রহন করবে তার আচরণটি হবে কাংখিত এবং ইতিবাচক। ব্যক্তির আচরণ আগে যাই থাকুক শিক্ষা অর্জন বা গ্রহনের মাধ্যমে তার আচরণের অনিবার্যভাবে পরিবর্তন ঘটবে। এ পরিবর্তন তার সমাজ পরিবেশ এবং প্রতিবেশ দ্বারা স্বীকৃত।শিক্ষার কথা বললে অবশ্যম্ভাবিভাবে মূল্যবোধটি আমাদের সামনে ধরা দেয়। মূল্যবোধ সেটিই যাকে আমরা মূল্য দেই কিংবা সমাজ যে বিষয়গুলোর উপর মূল্য আরোপ করে। এ মূল্যটা একধরনের মান বা স্ট্যান্ডার্ড। যেটা নির্ধারণ হয় সমাজের নির্ধারিত নর্মস তথা সামষ্টিক গ্রহনযোগ্য আচরণ এবং ইথিকস তথা নৈতিকতার দ্বারা। সমাজের নর্মস এর ভিন্নতায় মূল্যবোধের বিভিন্নতা দেখা যায়। যেমন হতে পারে একটা বিষয় আমাদের দেশে নর্মস কিন্তু আমেরিকায় নয়।সামাজিক নর্মস বা ইথিকস ভঙ্গ হলে বা এর বাইরে কাজ করলে আমরা তাকে দেখি মূল্যবোধের অবক্ষয় হিসেবে। এ মূল্যবোধের অবক্ষয় মানে সামাজিক অবক্ষয়। সামাজিক অবক্ষয় আর শিক্ষা এবং মূল্যবোধ পরস্পর বিরোধী। যারা শিক্ষা অর্জন বা গ্রহন করছে তাদের মূল্যবোধের অবক্ষয় বা তাদেও দ্বারা সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ সংগঠিত হওয়া অসম্ভব।শিক্ষাকে আমরা যদি একটা ফলযুক্ত গাছের সাথে তুলনা করি বিষয়টা সহজেই বুঝে আসবে। যে গাছে ফল রয়েছে সে গাছটি ফলের ভারে সবসময় নিচু থাকে। যে গাছে যত ফল সে গাছ তত নিচু। সে ফলের দম্ভ প্রকাশ করতে কখনেই মাথা উঠায় না। একজন শিক্ষিত মানুষ যত যত বেশি জ্ঞানী তার ব্যবহার তত মার্জিত, মানুষ হিসেবে তিনি তত বিনয়ী। সামাজিক আচরণ আর শৃংখলার প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল। গাছের ফলটি যেমন অন্যের জন্য ঠিক সে ব্যক্তিটিও হয়ে যান সমাজের জন্য। তার দ্বারা সামাজিক মূল্যবোধ বিরোধী কাজ হওয়া তো দূরে থাক বরং তিনি এ মূল্যবোধ রক্ষায় বেশি সচেষ্ট থাকেন।আমাদের সমাজের বাস্তব অবস্থাটা সম্পূর্ণ বিপরীত। আমাদের দেশে এ বিপরীত চিত্র এতটাই স্বাভাবিক , বাস্তবতা দেখে মনে হয় যেন শিক্ষাই সামাজিক রীতি-নীতি ভাঙ্গার একমাত্র মাপকাঠি। যিনি যত শিক্ষিত সামাজিক আইন, মূল্যবোধ ভাঙ্গতে তিনি তত সিদ্ধহস্ত। অবস্থাটা এমন পাশ্চাত্যের ধারণা অনুযায়ী একটা মিথ্যা কথাকে একশত বার সত্য বললে মিথ্যাটি আর মিথ্যা থাকেনা সেটি সত্য হয়ে যায়। অর্থাৎ শিক্ষার বিপরীতমুখী এখানে এতটাই প্রবল যার ফলে শিক্ষিত মানুষ মাত্রই অনেকের কাছে খারাপ।স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন করার বিষয় হলো- এটা কেন? উত্তরটা এত সহজে দিতে না পারলেও সাদামাটাভাবে যেটা বলা যায়, আমরা শিক্ষা অর্জন করছি ঠিকই কিন্তু শিক্ষিত হচ্ছিনা। বা শিক্ষাকে মানার জন্য পড়ছি। এ বিষয়ে পরে আসছি।সাম্প্রতিক সময়ে দেশব্যাপি সামাজিক অবক্ষয়ের যে মিছিল দেখা যাচ্ছে এটা তারই প্রমাণ। নারীর প্রতি সহিংসতা, উত্যক্তকরণ, ধর্ষণ, নির্যাতন, আতœহত্যা করতে বাধ্যকরণ ইত্যাদি আগের চেয়ে এতবেশি বেড়ে গেছে যা বলাবাহুল্য। গণমাধ্যমের কল্যানে প্রত্যেকদিনই এসব দেখছি। অনেকে এসব ঘটনার বাড়তিকে আইয়ামে জাহেলিয়াতকে ছাড়িয়ে যাওয়ার বিষয় হিসেবে দেখছেন। আমাদের জাতীয় জীবনের দূর্ভোগ এসব সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই বেড়ে গেছে। শুধু নারী নির্যাতন বা নারীঘটিত বিষয়ই নয়- এর বাইওে দূর্নীতি, ঘূষ, প্রতারণাসহ নানা ধরণের সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ স্পষ্ট। বর্তমানে বিদ্যুত, গ্যাস, পানির আকাল চলছে। আমাদের চাহিদার তুলনায় এ সম্পদগুলো কমই। ফলে জনগণ অতিষ্ঠ। এরপরও এগুলোর চুরি আর দূর্নীতির সংবাদ আমাদের জন্য কতটা লজ্জাকর। দেখা গেছে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা কর্মচারীর বেতন ১০-১৫ হাজার টাকা হলেও অনেকেরই ঢাকায় রয়েছে নিজস্ব বাড়ি গাড়ি। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হওয়ার ঘটনা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।খোদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন নির্যাতনের অভিযোগ শিক্ষার প্রতি কতটা বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষকদের বিরুদ্ধে উঠছে ছাত্রী নির্যাতনের অভিযোগ। কয়েকজন শিক্ষক আর কয়েকটি ঘটনায আমাদের পুরো শিক্ষক সমাজটাই কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ।শিক্ষকদের যখন এ অবস্থা শিক্ষার্থীর আবস্থা কী? বর্তমানে ছাত্র সমাজেরও মূল্যবোধের ভয়াবহ রকমের অবক্ষয় ঘটেছে। পহেলা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনসার্টে ১৫ তরুণীর নির্যাতিত হওয়ার ঘটনা। এর আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কর্তৃক তরুনী লাঞ্চিত ইত্যাদি খবর সে বিষয়টাই জানান দিচ্ছে।গত মাস এবং এ মাস জুড়ে সংবাদপত্রের কিছু সংবাদ মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের আবস্থা বুঝতে কারোই কষ্ট হওয়ার কথা নয়। রাজধানীর ডেফোডিল ইউনিভার্সিটির শিক্ষাথী কর্র্তৃক তার মেয়ে ব›ধু ও তার বাবা-মায়ের জখমের ঘটনা। ২৪ মার্চ ঢাকার কালাচাঁদপুরে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি না হওয়ায় মা বাবাকে হত্যা। ১৭ এপ্রিল রাজধানীর ভিকারুন্নেসা সহ দুই কলেজ ছাত্রীর আতœহত্যা ইত্যাদি শিক্ষার্থীদেও নৈতিক অবক্ষয়েরই পরিচায়ক।আজকের যুব সমাজের নতুন নাম বেশি আলোড়িত হচ্ছে‘বখাটে’। এ বখাটেপনার বলি হয়ে কত মেয়ে যে আতœহত্যা করছে তা ইয়ত্তা নেই। ৩ এপ্রিলে বখাটে রেজাউলের উৎপাতে বিষপানে আতœহত্যা করে ইলোরা। এভাবে বখাটেপনার শিকার হয়ে ইলোরার দল ভারী করেছে সিমি,ফাহিমা, পিংকী ও তৃষ্ণারা। এর বাইরে আরো জঘন্য অনেক কাজ হয়েছে। এসব কাজের হোতাদের বখাটে নয় নরপশু বলাই শ্রেয়। যারা দলবেঁধে ১৫ বছরের মেয়েকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। যাদের পাশবিক লালসা চার বছরের এমনকি আড়াই বছরের কন্যাকেও ছাড়েনি।আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য দিয়ে গত ৭ মার্চ একটি জাতীয় দৈনিকে প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০০৯ সালে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ১৯৪ জনকে। গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৫৮ জন আর ধর্ষণের মামলা হয়েছে ২৪৪ টি। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের তথ্যানুযায়ী গত দশ মাসে ৬০০ জন নারী ভয়াবহ সহিংসতার শিকার।নারীর প্রতি এসব সহিংসতা যেমন বাড়ছে সাথে সাথে আইন শৃংখলারও অবনতি ঘটছে। ২০ এপ্রিল রাজধানীতে সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়েছেন পুলিশের এস আই গৌতম। এর আগেও ঘটেছে অনেক হত্যাকান্ড। এরপরও আমাদের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য- দেশের আইন-শৃংখলা ঠিকই আছে। দেশে যখন সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হচ্ছে মানুষ, একের পর নারীরা হচ্ছেন ধর্ষণের শিকার। এরপরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর এ বক্তব্যে একজন নাগরিকের মন্তব্য এরকম- ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একজন মহিলা। মহিলাদের প্রতি সহিংসতা, নির্যাতন, ধর্ষণ মারাতœক আকার ধারণ করেছে। এ অবস্থায়ও যদি আইন-শৃংখলা ঠিক থাকে, তাহলে ঠিক কত নারী ধর্র্র্ষিতা হলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলবেন এবার আইন শৃংখলার অবনতি হয়েছে’।বর্তমান এ সামাজিক অবক্ষয়ের স্বরূপ অন্বেষণে সম্প্রতি রাজধানীতে গোলটেবিল বৈঠক করেছে একটি সংগঠন। “সামাজিক অবক্ষয়: আমাদের নতুন প্রজন্ম ’ শীর্ষক এ গোলটেবিল বৈঠকে বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় যেটা বের হয়ে এসেছে সেটা হলো- ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার অভাব। ঠিক এ বিষয়টির সমর্থণ পাওয়া যায় পাশ্চাত্যের একজন মনীষীর কথা থেকে- (বাংলায় সেটি) ‘ যদি তোমার শিশুকে তিনটা আর (জ) শেখাও রিডিং (পড়া), রাইটিং (লেখা), এরিথমেটিক (গনিত শাস্ত্র) এবং চতুর্থ আর ((জ) রিলিজিয়ন তথা ধর্মকে ছেড়ে দাও ( না শেখাও), তবে অনিবার্যভাবে পঞ্চম আর পাবে সেটা হলো রাসক্যালিটি তথা বদমাইশি।” ধর্মীয় শিক্ষা মানুষের মূল্যবোধকে জাগ্রত করে এটি ছাড়া অবক্ষয় যে অবশ্যম্ভাবী সে বিষয়টিই এ মনীষী তুলে ধরেছেন।এটাকে প্রধান কারণ ধরে আনুষঙ্গিক আরো কারণ বের করা যায়। অনেকে মিডিয়ার প্রভাবের কথা বলেছেন। অনেকে বলেছেন নেশা জাতীয় দ্রব্য তথা মদ, গাঁজা, ফেন্সিডিল ইত্যাদিও অবাধ ব্যবহার। ছেলে মেয়ের অবাধ মেলামেশা কিংবা মেয়েদের অশালীন পোশাককেও দায়ী করেছেন অনেকে। অনেকে আবার ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে , ধর্মকে বাস্তব জীবনে পালন না করার বিষয়টিও বলছেন। কারণ প্রত্যেক ধর্মেই অনৈতিক, সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ নিষিদ্ধ।এসব ঠিকই আছে, তবে আমাদের সমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে অবশ্যই জোর দিতে হবে শিক্ষার উপ্র। যে বিষয়টি প্রথমেই উল্লেখ করা হয়েছে। আমাদের শিক্ষা হবে জানা এবং মানার জন্য। পরীক্ষায় পাশ কিংবা চাকরির চিন্তা থাকবেই কিন্তু সেটাই একমাত্র লক্ষ্য হবে না। একজন মনীষীকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো- শিক্ষিত কারা, উত্তরটা ছিলো যে জানে এবং সেটা বাস্তব জীবনে পালন করে। সুতরাং জানার নাম শিক্ষা নয়, মানার নাম শিক্ষা।এক্ষেত্রে নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্বারোপ আবশ্যক। এবারের শিক্ষানীতিও সে বিষয়টি প্রাধান্য পেয়েছে। ধর্ম এবং নৈতিক শিক্ষা নামে শিক্ষানীতিতে উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে- ‘শিক্ষার্থীদের বাংলাদেশের মূল চারটি ধর্ম সম্পর্কে পরিচিতি, আচরণগত উৎকর্ষ সাধন এবং জীবন ও সমাজে নৈতিক মানসিকতা সৃষ্টি একং চরিত্র গঠন’।নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আমাদের রাষ্ট্রীয় আইন আছে। কঠোর আইন। গত বছর প্রণীত এ আইনে বলা হয়েছে, কোন নারীর প্রতি একনাগারে তাকিয়ে থাকাও নারী নির্যাতনের অন্তর্ভূক্ত আর ইভটিজিং তো বটেই। এসব কঠোর আইন থাকা স্বত্ত্বেও কিন্তু বন্ধ হয়নি নারী নির্যাতন। অর্থাৎ আইন করে নারী নির্যাতন বন্ধ কারা সম্ভব নয়। স্কুলের সামনে সাদা পুলিশ মোতায়েন করেও নয়। এটি বন্ধে প্রয়োজন মানুষের মাঝে নৈতিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা। সেজন্যই শিক্ষার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদই বটে, যেখানে আমাদেরও প্রধানমন্ত্রী নারী, বিরোধী দলীয় নেত্রী নারী, স্বরাষ্ট্র, পররাষ্ট্র মন্ত্রীসহ অনেক মন্ত্রী ও এমপি নারী। নারীর ক্ষমতায়নের দিক দিয়ে এক অবিস্মরণীয় কাল চললেও নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধ হয়নি একটুও।মূল্যবোধ শিক্ষাই আমাদের এ সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটাতে পারবে। শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই এ মূল্যবোধ জাগিয়ে তুলতে হবে। শিক্ষার প্রতিটা স্তরে মূল্যবোধ তা নৈতিক শিক্ষাকে আবশ্যক করে একে কার্যকরভাবে শ্রেণীতে উপস্থাপন করা দরকার। এ মূল্যবোধ শিক্ষা নিশ্চয় শিক্ষার্থীকে একদিকে যেমন দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ জাগ্রত করবে অন্যদিকে সামাজিক অবক্ষয়মূলক কাজ হতে বিরত রাখবে।
 (দৈনিক ডেসটিনি ২৯ এপ্রিল ২০১০)
ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।