সাক্ষাৎকার: অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ
ড. মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) অধ্যাপক। সম্প্রতি তিনি ইউনিভার্সিটি ব্রুনাই দারুসসালামে পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে আন্তর্জাতিক ও তুলনামূলক শিক্ষা বিষয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি সরকারি শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গেও কাজ করেছেন। ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার মনাশ ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মনিনুর রশিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইইআর থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক
সমকাল: এ বছর আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের প্রতিপাদ্য, ‘বহু ভাষায় শিক্ষার প্রসার: পারস্পরিক সমঝোতা ও শান্তির জন্য সাক্ষরতা।’ এটি আমাদের জন্য কতটা প্রাসঙ্গিক?
মোহাম্মদ মনিনুর রশিদ: এ প্রতিপাদ্য আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমাদের দেশের সব শিশুর ভাষা বাংলা নয়। অন্য ভাষাভাষীদেরও নিজ নিজ ভাষায় সাক্ষরতা দিতে হবে। এর মাধ্যমেই আসলে সমঝোতা ও শান্তি নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ আমরা দেশের প্রতিটি নাগরিককে সমানভাবে দেখব। জাতি ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষ সবাই সমান এবং মানুষ হিসেবেই সবার সমান অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নিজ নিজ ভাষায় সাক্ষরতা দিতে হবে এবং সবাইকে সাক্ষরতার আওতায় আনতে হবে। কাউকে নিরক্ষর রাখা যাবে না।
সমকাল: আমাদের এখনও ২২-২৩ ভাগ নিরক্ষর। অথচ ২০১৪ সালের মধ্যেই শতভাগ সাক্ষরতা অর্জিত হওয়ার কথা ছিল। এর দশ বছর পরও কেন এখনও শতভাগ সাক্ষর হলো না?
মনিনুর রশিদ: কেন হলো না, সেটা আসলে গবেষণার বিষয়। তবে ২০১৪ সালের মধ্যে বিগত সরকার শতভাগ সাক্ষরতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিল। প্রথম কথা হলো, সরকার অনেক পরিকল্পনাই নেয়, অনেক সময় রাজনৈতিক কারণেও প্রকল্প গ্রহণ করে। তার সফলতা না পাওয়ার ক্ষেত্রে সদিচ্ছা কিংবা অগ্রাধিকারের বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। এটাও বলা দরকার যে, সাক্ষরতার হার যতটা দেখানো হচ্ছে, সেটার যথার্থতা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
সমকাল: তার মানে কি সাক্ষরতার হার যা দেখানো হচ্ছে, সেটা যথার্থ নয় এবং বাস্তবে এ হার আরও কম?
মনিনুর রশিদ: সাক্ষরতার পরিসর আসলে অনেক বিস্তৃত। আমরা মনে করছি, কেবল স্বাক্ষর দিতে পারলে আর লিখতে পারলেই বুঝি সাক্ষর হয়ে গেল। আসলে তা নয়। পড়তে লিখতে পারার পাশাপাশি হিসাবনিকাশ ও সচেতনতার বিষয়টিও এর অন্তর্ভুক্ত। সেটা ক’জনের আছে? সেজন্য দেখা যাবে, ইউনেস্কো সাক্ষরতার হারের চেয়ে সরকারের হিসাবে বেশি আছে।
সমকাল: ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাদের অংশগ্রহণে শতভাগ সাক্ষরতা কতটা সম্ভব?
মনিনুর রশিদ: ছাত্রদের মাধ্যমে নিরক্ষর মানুষকে সাক্ষরতা দেওয়া যেতে পারে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকেই যে সেটা করতে হবে এমন নয়। যে কোনো শিক্ষার্থী সামাজিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এটা করতে পারে। তার নিজস্ব এলাকায়ও সাক্ষরতার কাজটি করতে পারে।
সমকাল: এমনটা কি হতে পারে, দুই মাসের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে সব শিক্ষার্থীকে এই সাক্ষরতা অর্জনে সহায়তা করবে?
মনিনুর রশিদ: আমি মনে করি না, বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা কলেজ বন্ধ করতে হবে। ভ্যাকেশন বা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের সময়েই এই ক্যাম্পেইন হতে পারে। যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জুন মাসজুড়ে বন্ধ থাকে। আবার ডিসেম্বরেও ছুটি থাকে। এই সময়টা কাজে লাগানো যায়। পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণত ৯ মাস শিক্ষা কার্যক্রম চলে। যা হোক, আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধের সময়ই দুই সপ্তাহব্যাপী এ কর্মসূচি নেওয়া যেতে পারে।
সমকাল: এর জন্য কি সম্মানী দরকার আছে?
মনিনুর রশিদ: না, সম্মানী দিলে বিষয়টা অন্যরকম দাঁড়াবে। শিক্ষা কার্যক্রমের অংশ হিসেবেই সামাজিক কর্ম হিসেবে এটি করা উচিত। জীবনবৃত্তান্তে বা সিভিতে এই কাজ অন্তর্ভুক্ত থাকলে শিক্ষার্থী চাকরির ক্ষেত্রে লাভবান হবে। তবে তাদের যাতায়াত খরচ, খাতা-কলমসহ অন্যান্য রিসোর্স যা দরকার সেগুলো দিতে হবে। সাক্ষরতা প্রদানের এই কাজে অবসরপ্রাপ্ত মানুষদেরও যুক্ত করা যেতে পারে।
সমকাল: সাক্ষরতা দিবসে আমরা দেখি প্রতিবছর উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরোর পক্ষ থেকে অর্থ বরাদ্দ দিয়ে নানা কর্মসূচি নেওয়া হয় সারাদেশে। সেগুলো কতটা কার্যকর?
মনিনুর রশিদ: অর্থ খরচ করে টি-শার্ট পরে, ব্যানার নিয়ে মার্চ কর্মসূচি আমরা দেখি। সেগুলোর কার্যকারিতা নিয়ে আমার প্রশ্ন আছে। এটা এক ধরনের শো অপ বা লোক দেখানো বিষয়। এটা না করে এই অর্থ শিক্ষার্থীদের সাক্ষরতা কর্মসূচিতে কাজে লাগানো যায়। তবে দেশব্যাপী ক্যাম্পেইনের আগে কোন এলাকায় কত মানুষ নিরক্ষর আছে, তাদের বয়সগ্রুপ কত সেটা নিরূপণ করে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ অনুযায়ী, অর্থাৎ যে যেই বয়সের মানুষকে শিক্ষা দিতে আগ্রহী তাঁকে তাদের জন্য নিয়োজিত করা যেতে পারে।
সমকাল: সাক্ষরতার পর তা টেকসই করার জন্য কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়?
মনিনুর রশিদ: সাক্ষরতার উদ্দেশ্য হলো, ব্যক্তির জীবন পরিচালনা সহজ করা। অস্ট্রেলিয়াতে যেমন, সবাইকে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দিতে হয়। সেখানে কী লেখা আছে তা তো আপনাকে পড়তে হবে। আপনি গ্রামে ধরুন জায়গা-জমির কাজ করেন, তা বেচাকেনায় দলিল যাতে ব্যক্তি পড়তে পারে। হাসপাতালে গেলে ব্যক্তি যখন অপারেশন করবে তার আগের শর্ত তিনি যাতে পড়ে সম্মতি দেন। এই পড়ার বিষয়টি বা বুঝে সম্মতি দেওয়ার বিষয়টি সবখানে থাকলে সাক্ষর ব্যক্তি তা ভুলতে পারবে না। বরং এসবের কারণেই তিনি নিরক্ষর থাকলেও সাক্ষরতায় আগ্রহী হবেন। সিস্টেমটাই এমন হবে যাতে সবাইকে পড়তে হবে। সেটা এমন ডিজিটালিও হতে পারে। সামাজিক মাধ্যম পরিচালনায়ও এই সাক্ষরতা দরকার। গুজব প্রতিরোধেও ডিজিটাল লিটারেসি গুরুত্বপূর্ণ।
সমকাল: সাক্ষরতা কি শতভাগই জরুরি?
মনিনুর রশিদ: মানুষের মধ্যকার বৈষম্য ঘুচাতে শতভাগ সাক্ষরতার লক্ষ্যে এগোতে হবে, এটা সত্য। কিন্তু কাছাকাছিও সেটা হতে পারে। যেমন অনেকে হয়তো একেবারে বৃদ্ধ, তাদের পড়ার মতো অবস্থা নেই। তবে তাদের জন্যও বিকল্প রাখতে হবে। যেমন অস্ট্রেলিয়াতে ‘ইন্টারপ্রেটার’ এর ব্যবস্থা আছে। এভাবে পড়ার বিপরীতে শোনার ব্যবস্থাও রাখা যেতে পারে। শতভাগ মানে জোর করে শতভাগকেই সাক্ষর বানাতে হবে ব্যাপারটা এমন নয়। অনেক সময় জনতুষ্টির জন্য সরকার শতভাগের কথা বললেও সেটা করা হয় না। বাস্তবে আমাদেরও তেমনই হয়েছে।
সমকাল: বাস্তবতার আলোকে তাহলে সবার সাক্ষরতা নিশ্চিত করা যায় কীভাবে?
মনিনুর রশিদ: এ লক্ষ্যে আমাদের বাস্তবতার আলোকে পরিকল্পনা করতে হবে। মানুষের প্রয়োজন ও বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ীই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সংশ্লিষ্ট অংশীজন নিয়েই এটা করতে হবে। এর সঙ্গে শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের বিষয়টিও আমরা আলোচনা করেছি। তাছাড়া শিক্ষায় পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ দেওয়াটা জরুরি। আমরা মুখে মুখে বলি শিক্ষায় অগ্রাধিকার দিচ্ছি, অথচ বাজেট দিচ্ছি নগণ্য, তা দিয়ে সাক্ষরতা ও শিক্ষা কোনোটাই নিশ্চিত হবে না। বাস্তবোচিত প্রকল্প গ্রহণ করে তার যথাযথ বাস্তবায়ন জরুরি। আমরা দেখেছি, সাক্ষরতার প্রকল্পের নামে কীভাবে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয় হয়েছে। কিংবা যারা যোগ্য না তাদেরও কাজ দেওয়া হয়েছে।
সমকাল: সাক্ষরতার জন্য নিবেদিত প্রতিষ্ঠান উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো। সাক্ষরতা প্রকল্পের সচ্ছতা তো তাদেরই নিশ্চিত করা উচিত?
মনিনুর রশিদ: অবশ্যই। প্রকল্পের দায়িত্বে যারা থাকবেন তারাই স্বচ্ছতা, তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করবেন। সাক্ষরতার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অনিয়ম হওয়ার অর্থ আমাদের দেশের মানবসম্পদ নিরক্ষর থেকে যাওয়া। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো সবাইকে নিয়ে যথাযথভাবে কাজ করলে দ্রুত শতভাগ সাক্ষরতার কাছে পৌঁছা খুব কঠিন হবে না।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মনিনুর রশিদ: আপনাকেও ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।