Mahfuzur Rahman Manik
উপমহাদেশ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদী বিভ্রান্তি
জুলাই 5, 2021
শিল্পীর আঁকা পলাশি যুদ্ধের চিত্র

মূল: অমর্ত্য সেন

ভারতে ব্রিটিশ শাসন শুরু হয় ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের মাধ্যমে। যুদ্ধটা ছিল সংক্ষিপ্ত, প্রত্যুষে শুরু হয়ে সূর্যাস্তের ক্ষণে শেষ। পলাশি অবস্থিত কলকাতা ও মুর্শিদাবাদের মাঝামাঝি পর্যায়ে। আম্রকাননে অনুষ্ঠিত ওই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী নবাব সিরাজউদ্দৌলা সেনাবাহিনীর মুখোমুখি হয় এবং তার বাহিনীকে পরাজিত করে। তারপর ব্রিটিশরা প্রায় দুইশ বছর রাজত্ব করে। এত দীর্ঘ সময়ে তারা ভারতে কী অর্জন করে? আর তাদের ব্যর্থতাই বা কী?

১৯৪০-এর দশকে আমি যখন পশ্চিমবঙ্গের একটি প্রাগ্রসর স্কুলের শিক্ষার্থী ছিলাম, তখন এসব প্রশ্ন আমাদের আলোচনায় এসেছিল। এখনও সে প্রশ্নের গুরুত্ব শেষ হয়ে যায়নি। কেবল এ কারণে নয় যে, ব্রিটিশ রাজত্ব প্রায়ই বৈশ্বিক সুশাসনের সফলতায় এ আলোচনা সামনে আনে বরং এ কারণেও যে আজ তারা আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিষয়টি দেখাতে চায়। কয়েক দশক আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতনের স্কুলে এসব আলোচনায় জটিল প্রশ্নে বিরক্তই হতাম। আমরা কীভাবে গত শতকের চল্লিশের দশকে চিন্তা করতে পারতাম যে, ভারতে কখনও ব্রিটিশ শাসন ছিল না? ১৭৫৭ সালে যখন ভারতে ব্রিটিশ শাসনের শুরু হয় তার সঙ্গে ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের যাওয়ার সময়কার ভারতের পার্থক্য ছিল সামান্যই। যদিও একেবারে পরিবর্তন হয়নি তা নয়। কিন্তু পরিবর্তনগুলোর জবাব আমরা কীভাবে দিতে পারি?

অতীতে ভারতের ইতিহাসে বড় অর্জন হলো- দর্শন, গণিত, সাহিত্য, কলা, স্থাপত্য, সংগীত, চিকিৎসাশাস্ত্র, ভাষা ও জ্যোতির্বিদ্যা। ঔপনিবেশিক শাসনের আগে ভারতের অর্থনৈতিক অর্জন বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটেছিল। ভারতের অর্থনৈতিক সম্পদের বিষয়টি অ্যাডাম স্মিথের মতো ব্রিটিশ পর্যবেক্ষকরাও স্বীকার করেছিলেন। এসব অর্জন সত্ত্বেও ইউরোপের যে অর্জন ছিল, আঠারোশ শতকের মধ্যভাগে ভারত তা থেকে পিছিয়েই ছিল। পিছিয়ে পড়ার ধরন ও তার তাৎপর্য আমাদের স্কুলের বিকেলে বিতর্কের বিষয় ছিল।

ভারতের ওপর লেখা কার্ল মার্ক্সের একটি রচনা আমাদের কয়েকজনের মনোযোগ আকর্ষণ করে। ১৮৫৩ সালের ওই রচনায় মার্ক্স ভারতের ব্রিটিশ শাসনের সংস্কারমূলক বিষয়ে নির্দেশ করে বলেছেন, ভারতের প্রয়োজন তা পুনরায় পরীক্ষা করে পুঙ্খানুপঙ্খভাবে দেখা। এটা সত্য যে, ভারতের জন্য পশ্চিমা যোগাযোগের প্রাথমিক মাধ্যম ছিল ব্রিটেন। আমরা দেখেছি, ভারতে বিশ্বায়নের যে সংস্কৃতি ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করে, সেটা কেবল ব্রিটিশদের লেখার জন্যই আসেনি বরং ইংরেজির বাইরেও ইউরোপিয়ান অন্যান্য ভাষার বই-পুস্তক ও নিবন্ধের মাধ্যমে আসে। এসবই এসেছে ব্রিটেনের মাধ্যমে।

বিশেষ ব্যক্তিত্ব যেমন কলকাতার দার্শনিক রাম মোহন রায়, যার জন্ম ১৭৭২ সালে, তিনি কেবল সংস্কৃত, আরবি, ফার্সির প্রচলিত জ্ঞানের দ্বারাই প্রভাবিত হননি, একই সঙ্গে ইংরেজি লেখায়ও প্রভাবক ভূমিকা পালন করেন। রাম মোহন রায়ের পর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময়কার কয়েক প্রজন্ম ও তাদের অনুসারীরাও আঠারোশ ও উনিশ শতকে ইউরোপে কী ঘটছিল তার আলোকে ভারতকে নিরীক্ষা করেছিল। তাদের মূল এবং প্রায়ই একমাত্র উৎস ছিল ইংরেজি লেখা বই। যেগুলো ব্রিটিশ শাসনে ভারতে প্রচার করেছিল, ব্রিটিশ শাসনকে ধন্যবাদ। ইউরোপীয় সংস্কৃতিসহ এই বুদ্ধিবৃত্তিক প্রভাব আজও দৃঢ়ভাবেই রয়ে গেছে। যদিও ব্রিটিশদের সামরিক বাহিনীসহ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি খুব দ্রুতই নিম্নমুখী হয়।

কার্ল মার্ক্সের গবেষণার ত্রুটি যেটা তিনি ধারণা করেছিলেন, সে সময় ব্রিটিশদের জয় ভারতের জন্য আধুনিক বিশ্বের একমাত্র দরজা ছিল। এটা সত্য, সে সময় ভারতের গঠনমূলক বিশ্বায়নের প্রয়োজন ছিল। সাম্রাজ্যবাদ নয়। পার্থক্যটা গুরুত্বপূর্ণ। দীর্ঘ ইতিহাসে ভারত বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে কেবল জ্ঞানের আদান-প্রদানই করেনি, একই সঙ্গে পণ্যও কেনাবেচা করেছে। ব্যবসায়ী, বহিরাগত বসবাসকারী, বিজ্ঞজন ভারত ও দূরপ্রাচ্যের দেশ- যেমন, চীন, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, কম্বোডিয়া, থাইল্যান্ড ও অন্যান্য দেশে ২০০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে যাতায়াত করছে। এমনকি ভারতের শুরুর দিকে পলাতকদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার ঘটনায় বৈশ্বিক বড় প্রভাব তৈরি করে। ভারতে ইহুদিদের আসা শুরু হয় প্রথম শতাব্দীতে জেরুজালেম পতনের পর এবং কয়েকশ বছর ধরে তাদের আগমন অব্যাহত রয়েছে। বাগদাদি ইহুদিরা এমনকি আঠারোশ শতকের শেষার্ধেও বড় সংখ্যায় ভারতে আসে। খ্রিষ্টানরা চতুর্থ শতাব্দীতে আসা শুরু করে।

পলাশির যুদ্ধের সময় ইউরোপীয় বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ব্যবসায়ী, বাণিজ্যগোষ্ঠীসহ অন্যান্য পেশার অনেকেই গঙ্গামুখের কাছে বাস করত। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদী শাসনই কেবল ভারতের জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিল না। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী তাত্ত্বিকরা ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করার ওপর জোর দেন। এ ক্ষেত্রে বলা দরকার, ব্রিটিশ শাসনের আগ পর্যন্ত ভারত ছিল খণ্ড খণ্ড রাজত্বের সম্মিলিত রূপ। আরও বলা হয়, আগে ভারত এক দেশ ছিল না। বরং তারা বিভক্ত ও বিচ্ছিন্ন ছিল। ব্রিটিশ শাসন ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করেছে, এ দাবি কি সত্য? এটা সত্য, যখন রবার্ট ক্লাইভের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৭৫৭ সালে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করে, ভারতে তখন ঐক্যবদ্ধ কোনো শাসন ছিল না। ব্রিটিশরাই ভারতে একটি শাসন কায়েম করে- বিষয়টি সেভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।

আমরা জানি এখানে প্রধান যেসব শাসক শাসন করেন, তাদের মধ্যে অশোক মৌর্য, গুপ্ত সম্রাট, আলাউদ্দিন খিলজি, মোগল এবং অন্যরা। ভারতের ইতিহাসে দেখা গেছে বড় কোনো সাম্রাজ্যের অধীনে ছোট ছোট রাজত্ব। ফলে আমাদের এ ধারণা করা ভুল হবে, আঠারোশ শতকের মধ্যভাগে ভারতের বিচ্ছিন্ন শাসন মানেই ভারতের ইতিহাসজুড়ে এমন বিচ্ছিন্নতা ছিল এবং ব্রিটিশরা এসে ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে।

যদিও ইতিহাসের বইয়ে ধারণা করা হয় ভারতে ব্রিটিশরা মোগলদের উত্তরসূরি। বরং গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ব্রিটিশরা কিন্তু মোগলদের কাছ থেকে শাসন ক্ষমতা নেয়নি। বরং ব্রিটিশদের ক্ষমতা তখনই শুরু হয়েছে যখন মোগলদের ক্ষমতা শেষ হয়ে যায়। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়, যাকে ব্রিটিশরা পরাজিত করে। অথচ নবাবরা তখনও মোগল সম্রাটের কাছে আনুগত্য বজায় রেখেছিলেন। ভারতে মোগলদের সাম্রাজ্য তখনও বিদ্যমান ছিল। যদিও শক্তিশালী কোনো সম্রাট ছিলেন না।

যখন ১৮৫৭ সালে তথাকথিত সিপাহি বিদ্রোহ ভারতে ব্রিটিশদের হুমকিতে ফেলে, তখন ব্রিটিশবিরোধী শক্তি ভারতের শাসক হিসেবে মোগল সম্রাটের সঙ্গে বিদ্রোহ করতে পারত। মোগল সম্রাট এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দিতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। এটি বিদ্রোহীদের দমাতে পারেনি। ৮২ বছর বয়সী মোগল রাজা দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ, যিনি জাফর নামে পরিচিত ছিলেন তিনি যুদ্ধে যোগ দেওয়া কিংবা ভারত শাসনের চেয়ে কবিতা পড়া ও লেখায় বেশি আগ্রহী ছিলেন। তিনি দিল্লির ১৪০০ নিরস্ত্র বেসামরিক নাগরিকের সাহায্যে তেমন কিছুই করতে পারতেন না, তাদের ব্রিটিশরা বিদ্রোহী হিসেবে হত্যা করে এবং শহর ধ্বংস করে। কবি ও সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে বার্মায় নির্বাসনে দেন, সেখানে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের প্রকাশিতব্য গ্রন্থ 'হোম ইন দ্য ওয়ার্ল্ড :আ মেমোয়ার' থেকে সংকলিত। দ্য গার্ডিয়ান থেকে অংশবিশেষ ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।