Mahfuzur Rahman Manik
কল্পনারা কেন অকল্পনীয় নির্যাতনের শিকার?
অক্টোবর 31, 2024
যেভাবে মেয়েটির চারটি দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছে; শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পোড়া ক্ষত আছে এবং সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় ইনফেকশন হয়ে গেছে; তার সুস্থ হতে কয়েক মাস লাগবে। ইতোমধ্যে নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি যথার্থই বলেছেন, কিশোরী গৃহকর্মীকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে; একজন সুস্থ মানুষ এভাবে নির্যাতন করতে পারে না।

মাত্র ১৩ বছরের কল্পনার জীবন নিপীড়নের অকল্পনীয় উপাখ্যানকেও হার মানায়। গৃহকর্মী হওয়ার কারণে এই বয়সে মেয়েটি যে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তা অকল্পনীয়। গৃহকর্তা- কর্ত্রীর কাছে মানুষ হিসেবে গৃহকর্মী কল্পনার কতটুকু মর্যাদা ছিল, জানি না। তবে তিনি নিজের বিড়ালের প্রতি বেশ যত্নশীল। বস্তুত ক্ষত-বিক্ষত চেহারার কল্পনার মাধ্যমে অসুস্থ বিড়ালকে চিকিৎসকের কাছে পাঠানোর পরই নির্যাতনের বিষয়টি জনসমক্ষে আসে। ওই চিকিৎসকের সহায়তায় সাংবাদিক ও পুলিশের মাধ্যমে কল্পনাকে উদ্ধার করা হয়। জীবে দয়া করা মহৎ গুণ। সে জন্য বিড়ালের যত্ন নিশ্চয় দরকার। কিন্তু মানুষের প্রতি চূড়ান্ত অমানবিকতা করে বিড়ালের প্রতি দরদ প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য।

ইংরেজ আমলে লাট সাহেবের কুকুরের পায়ের মূল্য কেমন ছিল; সৈয়দ মুজতবা আলীর অভিজ্ঞতায় আমরা শুনেছি। সেখানে স্কুলের পণ্ডিত মশাই বেতন পেতেন ২৫ টাকা। আর লাট সাহেবের তিন ঠেঙে কুকুরের জন্য ব্যয় হতো মাসে ৭৫ টাকা। কল্পনাকে নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী দিনাত জাহান তাঁর আদরের বিড়ালের পেছনে কত টাকা ব্যয় করতেন, জানি না। কিন্তু বিড়ালের চিকিৎসা যে কল্পনার চিকিৎসার চেয়ে অগ্রাধিকার ছিল– সেটা স্পষ্ট। অবশ্য যেখানে কল্পনার চারটি দাঁত ভেঙে ফেলা হয়; শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ছ্যাঁকা দেওয়া হয়; সেখানে কল্পনার চিকিৎসার প্রশ্নই বা কোথা থেকে আসে?

কল্পনাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করানোর পর চিকিৎসকরা বলছেন, যেভাবে মেয়েটির চারটি দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছে; শরীরের বিভিন্ন জায়গায় পোড়া ক্ষত আছে এবং সময়মতো চিকিৎসা না পাওয়ায় ইনফেকশন হয়ে গেছে; তার সুস্থ হতে কয়েক মাস লাগবে। ইতোমধ্যে নির্যাতনকারী গৃহকর্ত্রী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাঁকে রিমান্ডেও নেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া মেয়েটিকে দেখতে হাসপাতালে গেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। তিনি যথার্থই বলেছেন, কিশোরী গৃহকর্মীকে যেভাবে নির্যাতন করা হয়েছে; একজন সুস্থ মানুষ এভাবে নির্যাতন করতে পারে না।

গৃহকর্তারা গৃহকর্মীদের এভাবে নিপীড়ন করতে পারেন তাদের দুর্বল ভেবে। একে তো অধিকাংশই শিশু-কিশোর। অন্যদিকে সামাজিক, রাজনৈতিক কিংবা অর্থনৈতিক কোনো দিক থেকেই তাদের ক্ষমতা নেই। সে জন্য এ সংক্রান্ত যত খবর আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখি, অধিকাংশই নির্যাতনের। গৃহকর্মীদের ওপর গৃহকর্তা বা গৃহকর্ত্রীরা নিপীড়ন চালান। অনেক ক্ষেত্রে সমাজে যারা প্রভাবশালী তাদের বাড়িতে অনেকেই দুর্বল এই শ্রেণিকে নিশানা করেন। খুন্তি গরম করে শরীরে ছ্যাঁকা দেওয়ার মতো বিভীষিকার খবর আমাদের দেখতে হয়। নির্যাতন সইতে না পেরে অনেক বাসা থেকে গৃহকর্মীদের পলায়নের ঘটনা ঘটে। পালাতে গিয়ে বহুতল ভবন থেকে পড়ে মারাও যায়। এমনকি গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধারের খবর পাওয়া যায়। গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক এক যুগ্ম সচিবের গৃহকর্মী হত্যার ঘটনা প্রকাশ হয়। ইতি আক্তার নামে ১২ বছরের মেয়েটি গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে ‘লজ্জায়-অপমানে’ আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি আছে কাগজ-কলমে। গৃহকর্মীর অধিকার ও কল্যাণে করা হয়েছিল ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’। তারপর ৯ বছর পেরিয়ে গেলেও এ নীতি বাস্তবায়িত হয়নি। এমনকি গৃহকর্মীরা নিজেরা তো বটেই; নিয়োগকর্তা এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এ নীতি সম্পর্কে কতটা অবগত– সে সংশয় রয়েই গেছে। সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, জেলা প্রশাসক এবং ইউএনওদের নেতৃত্বে যেসব মনিটরিং সেল গঠন করার কথা ছিল, তা গঠনই করা হয়নি। অথচ গৃহকর্মীর সংখ্যা কম নয়। কীভাবে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত হবে?

মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কল্পনাকে দেখতে গিয়ে বলেছেন, আমাদের দেশে প্রায় পাঁচ লাখ শিশু রয়েছে, যারা দেশের বিভিন্ন জায়গা বা পরিবারে শ্রমিকের কাজ করছে। বাস্তব সংখ্যা যে আরও বেশি, তা বলাই বাহুল্য। এভাবে গৃহকর্মে যুক্ত লাখ লাখ শিশু দরিদ্র পরিবারের সামান্য আয়ের উপলক্ষ হিসেবে কাজ করছে। আরও ঝুঁকিপূর্ণ অনেক পেশায়ও তারা কাজ করছে। যে সময়ে শিশুদের শ্রেণিকক্ষে থাকার কথা; পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা; সে সময় তারা অন্যের ফরমায়েশ খাটছে। কাজ করতে গিয়ে সামান্য ভুল হলে তাদের ওপর নেমে আসে নিপীড়নের খড়্গ।

গৃহকর্মীসহ শিশুদের কাজ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নেওয়া জরুরি। জাতীয় শিশুশ্রম নিরসন নীতি-২০১০ থাকলেও বাস্তবে শিশুশ্রম কতটা কমেছে? সব শিশুর শিক্ষা নিশ্চিতে সমাজ থেকে দারিদ্র্য বিদায় করা চাই। দরিদ্র পরিবারগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা (সামান্য উপবৃত্তি নয়) নিশ্চিত করা এবং তাদের মধ্যে শিশুর শিক্ষার গুরুত্ব বোঝাতে পারলে সুফল পাওয়া যেতে পারে। সব শিশুর শিক্ষা এবং সবার সাক্ষরতা নিশ্চিতে রাষ্ট্রের বিনিয়োগ জরুরি।

তার আগে কল্পনার মতো যারা গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করছে, তাদের সুরক্ষায় ব্যবস্থা নিতে হবে। ধনী পরিবার যেমন তার থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করবে, তেমনি শিক্ষার ব্যবস্থাও করতে পারে। ইচ্ছা থাকলে কাজের পাশাপাশি তা অসম্ভব নয়। তাও সম্ভব না হলে অন্তত কল্পনাদের অধিকার সমাজকে অনুধাবন করতে হবে। শ্রমের বিনিময়ে তারা যথাযথ মজুরি, খাদ্য, বাসস্থান পাচ্ছে কিনা, নিশ্চিত করতে হবে। নির্যাতনের শিকার হলে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।

বড় প্রশ্ন, গৃহকর্তা বা কর্ত্রীদের হুঁশ হবে কবে? তাদের মধ্যে ন্যূনতম মানবিকতাবোধ জাগ্রত না হলে অবস্থার পরিবর্তন হবে না। যে কল্পনাকে নির্মমভাবে নিপীড়ন করা হলো, সে তো কারও মেয়ে, কারও বোন।

আমরা তাদের নিজ সন্তান না হোক, মানুষ তো মনে করতে পারি!

সমকালে প্রকাশ: ২৪ অক্টোবর ২০২৪

ট্যাগঃ ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।