ফেরদৌস আজিম, কনক মনি দীক্ষিত লক্ষ্মণ গুনাসেকারা, মনজুর হাসান ও সুশীল পিয়াকুরেল
ভাষান্তর- মাহফুজুর রহমান মানিক
আমরা দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশ বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার পাঁচ নাগরিক। বাংলাদেশের মোড় ঘুরানো পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে আমাদের দাবি, ভারত সরকার যেন আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকে। দিল্লির রাজনৈতিক, আমলাতান্ত্রিক ও গোয়েন্দা বিভাগের হস্তক্ষেপ কয়েক দশক ধরে বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা ও নেপালে অনিঃশেষ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতায় ভূমিকা রেখেছে। এই হস্তক্ষেপ আমাদের দেশগুলোয় কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ক্ষমতাবান করেছে।
ভারতের হস্তক্ষেপ প্রতিবেশী দেশগুলোর গণতন্ত্র দুর্বল করে দিচ্ছে এবং আর্থসামাজিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত করছে। একসময় ভারত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে ‘পঞ্চশীল নীতি’ প্রচার করেছে এবং নরেন্দ্র মোদি সরকার যে ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতির বহুল প্রচার করেছে, তার সঙ্গে তা সাংঘর্ষিক। অধিকন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শান্তি বজায় রাখা ভারতের নিজস্ব স্বার্থের জন্যই উপকারী। এর ফলে ভারতের অর্থনীতি লাভবান হবে এবং দেশটির আন্তর্জাতিক অবস্থান সুসংহত হবে।
বাংলাদেশের নাগরিকরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতার জন্য ভারতের কাছে কৃতজ্ঞ। কিন্তু এর পরের কয়েক দশকে নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেছে ভারত। উজানে অবস্থানকারী হিসেবে নদীর পানির হিস্যা না দেওয়া, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোয় চলাচল এবং বাংলাদেশকে ভারতীয় পণ্যের বড় বাজার হিসেবে ব্যবহার করা। গত দেড় দশক নয়াদিল্লি বাংলাদেশে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দিয়েছে এবং বিনিময়ে বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুবিধা আদায় করেছে।
শ্রীলঙ্কায় ভারতের হস্তক্ষেপ শুরু হয় আশির দশকের শেষের দিকে, ভারতীয় শান্তিরক্ষী বাহিনী (আইপিকেএফ) মোতায়েনের মাধ্যমে। শ্রীলঙ্কায় তামিল বিদ্রোহের মধ্যে এই বাহিনীর প্রথম ও প্রধান কাজই ছিল ভারতের স্বার্থ সুরক্ষা। শ্রীলঙ্কায় আইপিকেএফ মোতায়েনের আগে ও পরে দেশটিকে বারবারই নিজেদের রাজনীতিতে ভারতের হস্তক্ষেপ মোকাবিলা করতে হয়েছে। পরে দিল্লি প্রশাসন শ্রীলঙ্কায় ভারতীয় ব্যবসায়ীদের পাঠাতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে।
নেপালে রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিকদের মাধ্যমে একসময় হস্তক্ষেপ করত ভারত। এখন তারা একই কাজ করছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা ও আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী কর্মীদের মাধ্যমে। নেপালের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপের মাধ্যমে ভারত দেশটির পানিসম্পদের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে। ২০১৫ সালে ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত নেপালের বিরুদ্ধে অবরোধ জারি করে ভারত। সে সময় নেপালের নতুন সংবিধান প্রণয়নের বিষয়টিকে দিল্লি ভালোভাবে নেয়নি বলেই অবরোধ দেওয়া হয়েছিল।
আমাদের প্রতিটি দেশেই এমন রাজনৈতিক দল ও রাজনীতিবিদ আছেন, যারা জাতীয় প্রয়োজনের আগে নিজের স্বার্থচিন্তা এবং দিল্লির হস্তক্ষেপ বিষয়ে ইতিবাচক ধারণা পোষণ করেন। আমরা বরং ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের বিষয়ে হতাশ। তারা এ সত্য উপলব্ধি করতে অক্ষম– এ ধরনের হস্তক্ষেপ বরং ভারতের বিরুদ্ধে এমন শত্রুতা তৈরি করে, যা সহজে শেষ হওয়ার নয়। যেমনটা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটেছে। এ ধরনের হস্তক্ষেপ শেষ পর্যন্ত কাজে আসে না, কিন্তু নয়াদিল্লির এ হস্তক্ষেপ চলতে থাকে।
ভারতের একাডেমিয়ার বিশেষজ্ঞরা এবং সংবাদমাধ্যম সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ও তৎপরতায় নজর রাখে না বলেই দেশটির প্রতিবেশী নীতিতে ভুলের পুনরাবৃত্তি হয়। তারা প্রশ্নাতীতভাবে ভারতের পররাষ্ট্র ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ অনুসরণ করে। ভারতের দক্ষিণ এশিয়ানীতির নির্মোহ ও ব্যাপক গবেষণা প্রয়েজন। যেখানে অতীতের অলৌকিক স্বপ্নের মূল্যায়নও হতে হবে। এর মাধ্যমে ভারত এবং গোটা উপমহাদেশ উপকৃত হবে। নয়াদিল্লি প্রতিবেশী দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব সীমানা, মানুষ ও অর্থনীতির চোখ দিয়ে দেখলে ভারতের আঞ্চলিক উপস্থিতি আরও সংযত হতে বাধ্য।
আমাদের প্রতিটি দেশের যে ভৌগোলিক অবস্থান, সেখানে নয়াদিল্লির নাজুকতা স্পষ্ট। ভারত মহাসাগরে অবস্থিত শ্রীলঙ্কার কৌশলগত অবস্থান ভারতের দক্ষিণে। হিমালয় বরাবর নেপালের অবস্থান এবং ভারতের মূল ভূখণ্ড ও উত্তর-পূর্ব অংশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান। প্রতিবেশী দেশগুলোর এসব কৌশলগত অবস্থানসৃষ্ট সংকট তখনই সমস্যা হিসেবে দেখা দেবে না, যখন দিল্লির নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পারেন যে, আমাদের সমাজ ভারত সরকার ও তার জনগণের শুভাকাঙ্ক্ষী। ভারত নিয়ে আমাদের জনসাধারণের যে ক্ষোভ আছে, তার বেশির ভাগই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দিল্লির হস্তক্ষেপের প্রতিক্রিয়া মাত্র।
ভারত নিশ্চয় এ আশঙ্কা করছে, আমাদের দেশগুলোয় চীন তৎপর হবে; চীনের যেন ভারতকে ঘিরে ফেলার সমন্বিত পরিকল্পনা আছে। এ ক্ষেত্রে শুরুতেই বলে নেওয়া ভালো, ভারতকে চীনের সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে আগেই তার প্রতিটি প্রতিবেশী দেশের সার্বভৌম অধিকার মেনে নিতে হবে। যেমন সার্বভৌমত্বের স্বাধীনতা দিল্লি নিজে ভোগ করে। চীন যেখানে ভারতের বৃহত্তম বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে, সেখানে দিল্লি কীভাবে তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে বেইজিংয়ের সম্পর্ক রোধ করতে চায়? আমরা জোর দিয়ে বলছি, বাংলাদেশ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কা তথা দক্ষিণ এশিয়া চীন, ভারত বা অন্য কোনো শক্তির হস্তক্ষেপের ক্ষেত্র নয় এবং তাদের প্রভাব এসব দেশে থাকা উচিত নয়। নয়াদিল্লি যদি তেমনটা চায়, সেটি ভুল এবং চীনের ক্ষেত্রেও তার আশঙ্কা ঠিক নয়।
আমরা দেখেছি, মালদ্বীপ ও ভুটানও ভারতের হস্তক্ষেপের বাইরে নয়। দেশ দুটি তাদের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক বিষয়ে দিল্লির হস্তক্ষেপের কারণে সংকটে আছে। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যে বৈরিতা বিদ্যমান, তার প্রভাব ভয়াবহ এবং এটি কেবল দক্ষিণ এশিয়ার দুটি বৃহত্তম দেশের সমাজ ও অর্থনীতিকেই প্রভাবিত করছে না বরং আমাদের প্রতিবেশী দেশের উন্নতির পথও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ভারত তার প্রতিবেশী দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রকাশ্য ও গোপন হস্তক্ষেপের বদলে দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও দীর্ঘস্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় এবং তাদের ভবিষ্যতের জন্য নিজস্ব পথ রচনায় বরং ভারতের ভূমিকা রাখা উচিত।
ফেরদৌস আজিম: বাংলাদেশের নারীবাদী সংগঠন নারীপক্ষের সদস্য এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক; কনক মনি দীক্ষিত: লেখক ও নেপালের ‘হিমাল সাউথ এশিয়ান’ সাময়িকীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক; লক্ষ্মণ গুনাসেকারা: শ্রীলঙ্কার সাংবাদিক ও সমাজকর্মী; মঞ্জুর হাসান: ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড জাস্টিসের নির্বাহী পরিচালক; সুশীল পিয়াকুরেল: নেপালের ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশনের সাবেক কমিশনার।