আগে বলা হতো, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা হচ্ছে। এখন বলা হচ্ছে, ‘মূল্যায়ন উৎসব’ চলছে। এ মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলছে। নতুন যে কোনো ব্যবস্থা দাঁড়াতে স্বাভাবিকভাবেই সময় লাগে। তবে ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ বলে একটি কথা আছে। সে অনুসারে, মূল্যায়নের প্রশ্ন আগের রাতে সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশ হওয়ার বিষয় নিঃসন্দেহে বিস্ময়কর। প্রশ্ন কাঠামো, পরিবেশ, শিক্ষকদের দক্ষতা ইত্যাদি নিয়ে যেসব প্রশ্ন উঠছে, সেগুলোও ফেলনা নয়।
নতুন শিক্ষাক্রম চালুর দেড় বছরের বেশি সময় পার হলেও মূল্যায়ন নিয়ে এক রকম ধোঁয়াশা ছিল। অবশেষে ১ জুলাই মূল্যায়নের চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। তার দুই দিন পর বুধবার থেকে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন উৎসব। তবে ধোঁয়াশা কতটা কেটেছে, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। সামাজিক মাধ্যমে একজন অভিভাবক লিখেছেন, ‘এক দিন আগেও শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক কেউই মূল্যায়নের ব্যাপারে ক্লিয়ার ধারণা পায় নাই।’ তারপরও ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন উৎসবের একটা চিত্র পাওয়া গেল সামাজিক মাধ্যম, সংবাদমাধ্যম ও অংশীজনের সঙ্গে কথা বলে। সেই বর্ণনা দেওয়ার আগে মূল্যায়ন বিষয়ে আসা যাক।
প্রথমত, একে বলা হচ্ছে সামষ্টিক মূল্যায়ন, যেখানে লিখিত ৬৫ শতাংশ, বাকি ৩৫ শতাংশ ব্যবহারিক। যদিও কয়েক মাস আগে এপ্রিলে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করার লক্ষ্যে গঠিত কমিটি ৫০ শতাংশ লিখিত এবং অর্ধেকটা ব্যবহারিকের প্রস্তাব দিয়েছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, লিখিত ১৫ শতাংশ বেড়েছে এবং সে অনুপাতে ব্যবহারিক কমেছে। ফল প্রকাশের ধরনেও পরিবর্তন আসছে। জিপিএর পরিবর্তে রিপোর্ট কার্ডে সাতটি স্কেলের ঘরে আলাদা ইংরেজি বর্ণ লেখা হবে। যদিও শিক্ষা কাঠামোর খসড়ায় বলা হয়েছিল, শিক্ষার্থীর নির্ধারিত পারদর্শিতা অনুযায়ী সাতটি সূচকের সর্বোচ্চ ‘অনন্য’ এবং সর্বনিম্ন ‘প্রারম্ভিক’ হিসেবে লেখা হবে। অর্থাৎ মূল্যায়ন প্রকাশেও কিছুটা পরিবর্তন আসছে।
এর আলোকেই ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণির ষাণ্মাসিক মূল্যায়ন চলমান। প্রশ্নের মধ্যেও পরীক্ষার পরিবর্তে লেখা আছে ‘মূল্যায়ন’। শিক্ষার্থীরা দলে দলে গোল হয়ে বসে পরীক্ষা দিয়েছে। লিখিত মূল্যায়নকালেই নিজেদের মধ্যে আলাপ করার সুযোগ পেয়েছে। তাদের সঙ্গে বইও আছে। ষাণ্মাসিক এই সামষ্টিক মূল্যায়ন কার্যক্রম পরিচালনায় জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) ১৩টি নির্দেশনা দিয়েছিল। সেখানে শিক্ষার্থীরা কী উপকরণ আনবে কিংবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে কী উপকরণ সরবরাহ করবে, তা বলা আছে।
প্রসঙ্গত, যখনই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে উপকরণ সরবরাহের কথা বলা হচ্ছে, তখনই শিক্ষার্থীর ওপর পরীক্ষার ফির চাপ বাড়ছে। নির্দেশনায় অল্প ফির কথা বলা হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো একে সুযোগ হিসেবে নিয়ে বাড়তি ফি দাবি করবে। সে জন্য শিক্ষা খাতে অধিক বরাদ্দ দিয়ে শিক্ষা বিভাগ থেকেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এ শিক্ষা উপকরণের খরচ নিশ্চিত করা গুরুত্বপূর্ণ।
দ্বিতীয়ত, পরীক্ষার আগের রাতে প্রশ্ন ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি সাংবাদিকরা যখন এনসিটিবির চেয়ারম্যানের কাছে জানতে চান, এমনটি হওয়ার কথা নয় বলে তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কেউ হাতে পেলেই যে উত্তর করতে পারবে, এমন নয়। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীকে দক্ষতা অর্জন করতেই হবে।’ কিন্তু অনেকে তো স্মার্টফোন খুলেও লিখেছে বলে ছবি প্রকাশ হয়েছে। যেন ‘ওপেন বুক’ বা উন্মুক্ত পরীক্ষা। ওপেন বুক পরীক্ষা সাধারণত উচ্চশিক্ষায় স্নাতক পর্যায়ে দেখা যায়। মাধ্যমিকে অপরিপক্ব বয়সে কেন? নিঃসন্দেহে এভাবেও মূল্যায়ন হতে পারে, বিশেষত শিক্ষার্থীর বিশ্লেষণের ক্ষমতা পরখ করা যায়। কিন্তু যথাযথ মূল্যায়নের জন্য অন্য যেসব দিক রয়েছে, বিশেষ করে ব্লুমসের ট্যাক্সোনমি অনুযায়ী জ্ঞানমূলক, অনুভূতিমূলক ও মনোপেশিজ বিষয়– যেখানে জ্ঞান, অনুধাবন, প্রয়োগ, বিশ্লেষণ, সংশ্লেষণ ও মূল্যায়নের সন্নিবেশ ঘটাতে হয়। ষাণ্মাসিক মূল্যায়নে এগুলোর প্রয়োগ কতটা ঘটেছে?
তৃতীয়ত, শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করছেন শিক্ষকরা। মূল্যায়নের লক্ষ্যে শিক্ষা বিভাগ চালু করেছে ‘নৈপুণ্য’ অ্যাপ। কিন্তু এ অ্যাপের নানা কারিগরি জটিলতায় শিক্ষকরাই নাজেহাল। এ অ্যাপ নিয়ে শিক্ষকদের সারাক্ষণ যেভাবে ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়, তার মধ্যে তাদের ক্লাসের প্রস্তুতির সময় কোথায়? অ্যাপ ব্যবহারের জন্য স্মার্টফোন লাগে; সেটাই বা আছে কতজন শিক্ষকের? তাই মূল্যায়নকে অ্যাপের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বিকল্প অফলাইনেও করার ব্যবস্থা নেওয়া যায়। কাজটা যদি শুধু অ্যাপেই করতে হয়, তাহলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি শিক্ষকদের জন্য উপযুক্ত কম্পিউটার ও ডিভাইস সরবরাহ করতে হবে। কারিগরি জটিলতা নিরসনে কেন্দ্রীয়ভাবে একটি কল সেন্টার জাতীয় কিছু থাকাও জরুরি, যাতে সমস্যায় পড়লে শিক্ষকরা বিশেষজ্ঞের সহায়তা নিতে পারেন। তা ছাড়া ধারাবাহিক তথা শিখনকালীন ও চূড়ান্ত মূল্যায়নের যে কথা বলা হচ্ছে, ষাণ্মাসিক মূল্যায়নে যেন দুটিই একসঙ্গে হচ্ছে। অথচ ধারাবাহিক মূল্যায়ন শ্রেণিকক্ষে হয়ে যাওয়ার কথা।
চতুর্থত, নতুন শিক্ষাক্রমের অন্যতম উদ্দেশ্য নোট-গাইড কিংবা কোচিং সেন্টারের বিলোপ সাধন। কিন্তু ৩ জুলাই প্রকাশিত ডেইলি স্টারের প্রতিবেদন বলছে, বাজারে নোট-গাইডের চাহিদা কমেনি। বইয়ের দোকানগুলোতে অভিভাবকরা আগের মতোই সেগুলো খুঁজছেন; প্রকাশকরাও নতুন শিক্ষাক্রম অনুযায়ী গাইড বই ছাপছেন। বস্তুত নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সহজে না বুঝলে গাইডের প্রতি নির্ভরশীলতা আরও বাড়তে পারে। সেই সঙ্গে এখন ইউটিউব কিংবা সামাজিক মাধ্যমেও তার সমাধান খোঁজার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
মোট কথা, তড়িঘড়ি করে যথাযথ প্রস্তুতির অভাবে নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতিতে এক প্রকার হযবরল অবস্থাই দেখা যাচ্ছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন তোলা যায়, ‘নূতন মূল্যায়ন পদ্ধতি লইয়া আমরা কী করিব?’ মনে রাখতে হবে, শিক্ষার সঙ্গে মূল্যায়ন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যথাযথ মূল্যায়ন পদ্ধতির মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মেধা, আত্মস্থ করার ক্ষমতা এবং শিখন প্রক্রিয়ার যথার্থতা সঠিকভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়।
শুধু শিক্ষক-শিক্ষার্থীই নয়; নতুন মূল্যায়ন পদ্ধতি প্রণেতাদেরও চলমান ষাণ্মাষিক মূল্যায়ন থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের চিন্তা করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সারাদেশে বিদ্যমান অবকাঠামো, দেশীয় পরিবেশ, শিক্ষার্থীর বয়স, প্রবণতা ও ধারণক্ষমতা, শিক্ষকের দক্ষতার মতো বিষয় মাথায় রাখতে হবে।
সমকালে প্রকাশ: ৬ জুলাই ২০২৪– এই ‘মূল্যায়ন’ লইয়া আমরা কী করিব? (samakal.com)