প্রতিবছর বাজেটের আগে শিক্ষা খাতের প্রত্যাশা নিয়ে আলাপ-আলোচনা, পরামর্শ কম হয় না। বাস্তবে তার প্রতিফলন কমই দেখা যায়। বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ গত অর্থবছরের তুলনায় বেড়েছে; কিন্তু শিক্ষা খাতের গুরুত্ব ও প্রয়োজনের তুলনায় শিক্ষা খাত গুরুত্ব পায়নি। এমনকি গত কয়েকটি বাজেটের তুলনায় এবার গুরুত্ব বলা চলে কমেছে। যদিও অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় খাতভিত্তিক আলোচনা ও বরাদ্দের তালিকার শুরুতেই আছে শিক্ষা খাত। ৭ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার প্রস্তাবিত বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দের পরিমাণ ৯৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা।
কোন খাতে কত বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে, তার চাইতে বাজেট বক্তৃতার যে বিষয়টি আমি উপভোগ করি, তা হলো ওই খাতের হালনাগাদ সব তথ্য। যেমন শিক্ষাব্যবস্থায় বর্তমানে কী ঘটছে, সেটি অর্থমন্ত্রীর বাজেট বক্তৃতায় রয়েছে। বস্তুত প্রতিটি বিভাগের হালনাগাদ তথ্য পরিবেশনের পরই বরাদ্দের পরিমাণটা বলা হয়। বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষা খাতকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে: প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা। শিক্ষা খাতে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নের বিষয়টি জোর দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষার আলোচনায় অর্থমন্ত্রী শুরুতেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, প্রাথমিকেই একটি শিশুর জ্ঞানের ভিত তৈরি হয়। এ আলোচনায় অবশ্য সরকার কেবল গত অর্থবছরে প্রাথমিক পর্যায়ে কী করেছে, সেটিই আসেনি, একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের পদক্ষেপও আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, শিক্ষক নিয়োগ, মাল্টিমিডিয়া শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ ইত্যাদি। প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে প্রাথমিক ও গণশিক্ষায় ৩৮ হাজার ৮১৯ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা চলমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৩৪ হাজার ৭২২ কোটি টাকা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে বিশেষ করে নতুন শিক্ষাক্রমের বিষয়টি এসেছে। এ পর্যায়ে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ প্রদান, উচ্চশিক্ষার উন্নয়নে প্রকল্প, অটিজমসহ বিশেষ শিশুদের গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট থেকে উপবৃত্তির বিষয়ও এসেছে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় ৪৪ হাজার ১০৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী, যা চলমান ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ৪২ হাজার ৮৩৯ কোটি টাকা।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগে এসে বাজেট বক্তৃতায় শিক্ষামন্ত্রী কারিগরি শিক্ষায় ভর্তির হার বাড়ার বিষয়টি জোর দিয়ে বলেছেন। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, ব্যাপক কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা অবদান রাখবে। কারিগরি শিক্ষার উন্নয়নের পাশাপাশি মাদ্রাসা শিক্ষার উন্নয়ন ও আধুনিকায়নে সরকারের ভূমিকার বিষয়টি এসেছে বাজেট বক্তৃতায়। এ খাতে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য ১১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ১০ হাজার ৬০২ কোটি টাকা।
বাজেট বক্তৃতার আলোচনা যাই হোক, প্রতিটি বিভাগে বরাদ্দ কিন্তু গত অর্থবছরের তুলনায় কিছু বেশি থাকছে। প্রবণতা এমন যে, কিছু বরাদ্দ বেশি দেখানো এবং সেই নিরিখে যাতে অন্যরা গুরুত্বটা বোঝে। কিন্তু সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান হলো, কিছু বিভাগে বিশেষ কারণে অনেক বেশি বরাদ্দ যেমন হতে পারে, তেমনি অবস্থার আলোকে কিছুটা কমতেও পারে। যদিও কমার সুযোগ সামান্যই। কারণ বাজেটে শিক্ষা খাতে যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা খুবই সামান্য।
আমরা দেখে আসছি, প্রতিবছর আগের বছরের তুলনায় মোট বাজেটের আকার যেমন বাড়ে, তেমনি শিক্ষা খাতেও কিছু বরাদ্দ বাড়ানো হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। কিন্তু শিক্ষা-সংশ্লিষ্টরা যেভাবে বাজেটে জিডিপির ৪ থেকে ৬ শতাংশ অথবা মোট বাজেটের ২০ শতাংশ অর্থ বরাদ্দ দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছেন, তার প্রতিফলন নেই। এবারের বরাদ্দ জিডিপির মাত্র ১.৭ শতাংশ। বস্তুত কয়েক বছর ধরেই জিডিপির হিসেবে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ কমছে।
শিক্ষা খাতে জিডিপি অনুপাতে বরাদ্দের দিক থেকে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ পিছিয়ে। ভুটান ২০২২ সালে তার জিডিপির ৮.১৪ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। মালদ্বীপের বরাদ্দ ৪.৫৮ শতাংশ, নেপাল ৩.৬৫ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দিচ্ছে। শিক্ষা খাতে বাজেটে আমাদের যে প্রবণতা, তাতে অগ্রাধিকারের কথা বলা হলেও বরাদ্দ এমনই থাকবে। এমনকি জিডিপির হিসাবে তা কমতে থাকাও বিস্ময়কর নয়।
এবারের শিক্ষা বাজেটে নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় বিষয়টি এসেছে বটে, কিন্তু নতুন শিক্ষাক্রমের জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ নিয়ে অনেক প্রশ্ন রয়েছে। ভালোভাবে প্রশিক্ষণ না দিলে শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন কঠিন। শিক্ষকদের বেতন-ভাতাও কম। প্রাথমিক তো বটেই, অন্যান্য স্তরে একই অবস্থা। বাজেটে প্রত্যাশিত বরাদ্দ হলে শিক্ষকদের জীবনমান উন্নয়ন করা সম্ভব হবে এবং শিক্ষার মান উন্নয়নে সেদিকেই জোর দেওয়া দরকার।
শিক্ষা বাজেটের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের স্বস্তি দেওয়াও অগ্রাধিকারে থাকা উচিত। গত বছরের বাজেটে কলমের ওপর ভ্যাট বসানো হয়েছিল। এখনও প্রায় সব শিক্ষা উপকরণের দাম বাড়তি। কয়েক বছর ধরেই সব উপকরণের দাম ঊর্ধ্বমুখী। কাগজ, খাতা, পেন্সিল, ব্যবহারিক খাতা ইত্যাদি পণ্যের দাম বেড়েছে। এগুলো কমানোর ক্ষেত্রে বাজেটে দিকনির্দেশনা থাকলে শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট সবাই স্বস্তি পেত।
অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য অনুসারে, সাক্ষরতার হার এখন ৭৬.৮ শতাংশ। এখনও যে বিপুল জনগোষ্ঠী নিরক্ষর রয়ে গেছে, তাদের জন্য বিশেষভাবে দ্রুত সাক্ষরতার আলোয় আলোকিত করতে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সে জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেওয়া দরকার।
সবশেষ বিষয়, অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সরকার শিক্ষায় গুরুত্ব দিয়েছে। মানবসম্পদ উন্নয়নে শিক্ষার গুরুত্ব আমরা যেমন অনুধাবন করছি, তেমনি যথাযথ বরাদ্দের মাধ্যমে তা প্রমাণ করা চাই। বাজেটে গতানুগতিকভাবে কেবল বরাদ্দ বাড়ালেই গুরুত্ব সেভাবে দেওয়া হয় না।