সাক্ষাৎকার: কামরুল হাসান মামুন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসান মামুন স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৯৬ সালে লন্ডনের ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ওআরএস স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করেন। ২০০১ সালে জার্মানির বিখ্যাত হামবোল্ট ফেলোশিপ নিয়ে বার্লিনের পটসডাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট ডক্টরাল গবেষক হিসেবে কাজ করেন। তাঁর শিক্ষকতা শুরু ১৯৯২ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে; ১৯৯৯-এ যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৬৬ সালে কিশোরগঞ্জ জেলার বাজিতপুরে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক
সমকাল: বাজেট সামনে রেখে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শিক্ষা খাতে আপনি জিডিপির সাড়ে ৫ শতাংশ বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন। এর কারণ কী?
কামরুল হাসান মামুন: বর্তমানে জিডিপির ২ শতাংশ বা তার নিচে শিক্ষায় বরাদ্দ হয়। এমন বাজেট দিয়ে পৃথিবীতে কোনো জাতির সুশিক্ষিত বা সভ্য হওয়ার নজির নেই। তাই আমি বলছি, এ বরাদ্দ হতে হবে কমপক্ষে জিডিপির ৫ দশমিক ৫ শতাংশ। এর ২ শতাংশ বর্তমানে যেভাবে খরচ হয়, সেভাবে খরচ হবে। বাকি ৩ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষকদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও ছাত্রদের স্কলারশিপ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধি এবং উন্নত লেখাপড়ার পরিবেশ সৃষ্টিতে ব্যয় হবে। এর ফলে ভালো মানের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (মেডিকেল কলেজসহ) হবে। অনেক ছেলেমেয়ে বিদেশে না গিয়ে দেশেই লেখাপড়া করবে, চিকিৎসা করাবে; ডলার বাঁচবে, ব্রেইন ড্রেইন বা মেধা পাচার কমবে। দেশে উন্নতমানের মানুষের সংখ্যা বাড়লে তার প্রতিফলন সর্বত্র পাওয়া যাবে। উন্নতমানের মানুষ দিয়েই কেবল উন্নত দেশ গড়া সম্ভব।
সমকাল: কিন্তু কয়েক দিন আগে খবরে দেখলাম, এবারের শিক্ষা বাজেটে বরাদ্দের বড় অংশ অব্যবহৃত থাকছে।
কামরুল হাসান মামুন: জিডিপির মাত্র ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ বরাদ্দও ব্যবহার করতে না পারা আমি মনে করি ইচ্ছাকৃত। অজুহাত তৈরি করে আগামীবারও শিক্ষায় কম বরাদ্দ দেওয়ার ফন্দি আছে এখানে।
সমকাল: আমাদের শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ কতটা?
কামরুল হাসান মামুন: যতটুকু আমরা ভাবতে পারি, শিক্ষার মান নিয়ে উদ্বেগ তার চেয়েও বেশি ও গভীর। একটি বীজ বপন করলেই গাছ হয়ে যায় এখানে। এমন একটি উর্বর দেশে শিক্ষায় প্রত্যাশিত বরাদ্দ দিলে নিঃসন্দেহে আমরা এর ফল পেতাম। আজকে যদি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া যায়, তাহলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই হার্ভার্ড হয়ে যাবে। তার মানে, মানুষ দরকার আগে। আর মানুষ তৈরি হয় শিক্ষার মাধ্যমে। মানসম্মত শিক্ষক এবং যথাযথ অবকাঠামোর মাধ্যমে শিক্ষার মান নিশ্চিত হতে পারে। প্রাথমিক বিদ্যালয় আমাদের শিক্ষার সূতিকাগার। মানুষ তৈরির কাজটা সেখান থেকেই হয় এবং শিক্ষার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর। পড়াশোনার পাশাপাশি নাগরিক দায়িত্ববোধও সেখানে শেখানো হয়। সেগুলো আমাদের কারিকুলামে কতটা আছে, তা নিয়েও প্রশ্ন আছে।
সমকাল: সরকার বলেছে, শিক্ষার মানোন্নয়নে কারিকুলাম সংশোধন, মূল্যায়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন, লাগসই প্রযুক্তি ব্যবহার ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন– সব দিক থেকে কাজ চলছে। আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
কামরুল হাসান মামুন: মানসম্পন্ন শিক্ষা নিশ্চিত করতে গৃহীত আমাদের পদক্ষেপের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত জনগোষ্ঠীর উন্নয়ন। কিন্তু সরকারের উদ্দেশ্য হলো প্রকল্প করা। দু’দিন পরপর নতুন প্রকল্প বানানো, বই পরিবর্তন, সিস্টেমের পরিবর্তন। নতুন সিস্টেম চালুর আগে যে পরিমাণ হোমওয়ার্ক করতে হয়, গবেষণা করতে হয়, আমরা কি সেটা করছি? তারপরও শিক্ষাবিদরা রিপোর্ট দেন। কিন্তু তা কি বাস্তবায়ন হচ্ছে? মন্ত্রী ও আমলারা যেন শিক্ষাবিদদের চেয়েও বেশি বোঝেন। সে জন্য এত কমিশন হওয়ার পরও কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি। তার মানে উদ্দেশ্যেই গলদ। সৎ উদ্দেশ্য থাকলে শিক্ষায় এত বিভাজন থাকত না। যেমন আমার সন্তান ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে দুধেভাতে থাকবে। সুতরাং সেখানে হাত দেওয়া যাবে না। সব পরিবর্তন আনছে বাংলা মিডিয়ামে। কী পরিবর্তন করা হলো? কারিকুলামকে কারিগরি মাধ্যমের দিকে শিফট করা হলো। আমাদের একটি আলাদা কারিগরি বোর্ড থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার মূলধারাকে কেন কারিগরি শিক্ষার দিকে শিফট করা হলো? কারণ সরকার চায় নিম্নবিত্ত ও নিম্ন-মধ্যবিত্তের পরিবারের ছেলেমেয়ে স্কিল্ড হোক, কর্মী হোক। অথচ মানুষের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো চিন্তক হওয়া। নতুন কারিকুলাম পড়ে কেউ আর চিন্তক, লেখক, গবেষক হতে পারবে না।
সমকাল: শিক্ষায় বিভাজন কেমন দেখছেন?
কামরুল হাসান মামুন: শিক্ষায় অন্তহীন বিভাজন। আমাদের হতদরিদ্রের জন্য কওমি মাদ্রাসা, দরিদ্রের জন্য মাদ্রাসা, নিম্ন-মধ্যবিত্তের জন্য বাংলা মিডিয়াম, আরেকটু বড়লোকের জন্য ইংলিশ ভার্সন; বেশি বড়লোকের জন্য ইংলিশ মিডিয়াম। উদ্বেগের বিষয়, এদের মধ্যে যোগাযোগ বা বোঝাপড়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। আরেকটি বিষয়ও বলা দরকার।
সমকাল: কোনটা?
কামরুল হাসান মামুন: প্রযুক্তির বিষয়ে খুব জোর দেওয়া হচ্ছে। অথচ স্কুল পর্যায়ে প্রযুক্তির আগে বিজ্ঞানের গুরুত্ব বেশি। বিজ্ঞানকে কমিয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতেই তথ্যপ্রযুক্তি ঢোকানোর মানে হলো টেকনিশিয়ান বানানো; বিজ্ঞানী বানানো নয়। অর্থাৎ অন্যের প্রযুক্তি– ইউরোপ, আমেরিকা যে প্রযুক্তি বানায়, তার ব্যবহারকারী মাত্র। নতুন শিক্ষাক্রমও সেভাবে প্রণীত।
সমকাল: প্রাথমিক শিক্ষার মানের ওপর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অধিকাংশ শিক্ষার্থী গণিতে দুর্বল। বিষয়টি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
কামরুল হাসান মামুন: গণিত ও বিজ্ঞানে দুর্বলতার কারণ স্পষ্ট। এ বিষয়গুলো পড়ার যে মজা, সেভাবে পড়ানোর মতো শিক্ষক নেই। তা ছাড়া বর্তমানে প্রযুক্তির ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। অন্যদিকে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন ও অন্যান্য সুবিধার দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন, তারা কতটা অবহেলিত। বেতন কাঠামো ও মর্যাদার প্রশ্নে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে, যেন পারতপক্ষে এ পেশায় আসার কথা কেউ কল্পনাও না করেন। বাংলাদেশের স্কুলের শিক্ষকদের বেতন ও সম্মান দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে কম। অথচ প্রাথমিকের বয়সটা ছেলেমেয়েদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়ে ভালো মানের শিক্ষকদের সান্নিধ্যে এলে জীবন পাল্টে যেতে পারে। আমাদের স্কুলে ভালো মানের ইংরেজির শিক্ষক নিয়োগ দিই না। ফলে ২০ বছর ইংরেজি পড়ার পরও দুটো কথা ইংরেজিতে বলতে বা লিখতে পারি না। যারা পড়ান, তারাই তো পারেন না। তাহলে আগে কারিকুলাম বদলাবেন, নাকি ভালো মানের শিক্ষক নিয়োগ দেবেন?
সমকাল: মাধ্যমিকে দেড় দশক আগে সৃজনশীল প্রশ্ন পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। দীর্ঘ সময়েও এ পদ্ধতি শিক্ষার্থী দূরের কথা, শিক্ষকদের বড় অংশই ঠিকমতো রপ্ত করতে পারেনি। জরিপে দেখা গেছে, ঠিকমতো প্রশ্নও করতে পারেননি অনেক শিক্ষক।
কামরুল হাসান মামুন: এ জন্য আগে সৃজনশীল শিক্ষকের প্রয়োজন ছিল। সৃজনশীল শিক্ষক পেতে হলে তাদেরকে এমন বেতন-ভাতা দিতে হবে, যাতে শ্রেণির সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থী শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। সেই স্বপ্নবান শিক্ষার্থী যখন শিক্ষক হবে এবং প্রত্যাশিত বেতন পাবে তখন সে সৃজনশীল শিক্ষক হবে। আর সৃজনশীল পদ্ধতি না থাকলেও এমনিতেই শিক্ষকরা সৃজনশীল হয়ে যাবে।
সমকাল: নতুন শিক্ষাক্রমে একমুখী শিক্ষার বিষয়টি এসেছে। এ সিদ্ধান্ত কতটা যথার্থ?
কামরুল হাসান মামুন: একটি দেশে অর্থনৈতিক কারণে শিক্ষা ধনী, গরিব, হতদরিদ্রের জন্য আলাদা হতে পারে না। সবার জন্য এক রকম শিক্ষাকে আমরা বলেছি একমুখী শিক্ষা। অথচ নতুন শিক্ষাক্রমে সায়েন্স, আর্টস, কমার্স বাদ দিয়ে একমুখী করা হলো। আমরা তো এমনটি চাইনি। আমরা বৈচিত্র্য চাই; বৈষম্য নয়। ইংলিশ মিডিয়ামে বিষয় উন্মুক্ত। পছন্দ অনুসারে যে কেউ বিষয় নিতে পারে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী আগে ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, বায়োলজি, গণিত ও উচ্চতর গণিত পড়ত। এখন উচ্চতর গণিত বাদ দেওয়া হয়েছে। উচ্চতর গণিত ছাড়া কীভাবে সে গণিতবিদ, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার হবে? সেখানে আবার পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে।
সমকাল: পরীক্ষার মাধ্যমে ৫০ শতাংশ মূল্যায়ন হবে।
কামরুল হাসান মামুন: ভালো শিক্ষকের মাধ্যমে পরীক্ষাটা আনন্দদায়ক করা জরুরি। অ্যাসাইনমেন্ট, কুইজ এগুলো পরীক্ষা তথা মূল্যায়নের অংশ। পরীক্ষা সময় ব্যবস্থাপনা ও শৃঙ্খলা শেখায়। নতুন শিক্ষাক্রমে শিক্ষকদের ওপর মূল্যায়নের ভার দেওয়া হচ্ছে। আমাদের সময়ে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে যে ল্যাব পরীক্ষা হতো, সম্ভবত এখনও হয়। সেটা কি ঠিকমতো হতো বা হয়? সেখানে টাকার বাণিজ্যের কথা আমরা জানি। সেটাই এখন আমরা বিস্তৃত করলাম। শিক্ষকদের আর্থিকভাবে ক্ষমতায়ন না করেই তাদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করার অর্থ কী? তিনি এ ক্ষমতাকে অর্থ উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে যেমন প্রাইভেট কিংবা কোচিং পড়ানোয় ব্যবহার করবেন। তা ছাড়া এই শিক্ষকদের পক্ষে এলাকার এমপি, চেয়ারম্যান বা প্রভাবশালী কারও ছেলেমেয়েকে যৌক্তিকভাবে কম নম্বর দেওয়া সম্ভব? আজ যদি শিক্ষককে ১ লাখ টাকা বেতন দিতাম এবং তাঁর মেরুদণ্ড শক্ত থাকত, তবে এমনটা হতে পারত? কিন্তু মেরুদণ্ড ভাঙা এবং ক্ষমতাহীন শিক্ষককে ‘কন্টিনিউয়াস অ্যাসেসমেন্ট’ দেওয়া হলে তা যেমন বাণিজ্যের কারণ হতে পারে, তেমনি অনৈতিকতা ও অসততার চাষাবাদের আশঙ্কাও বাড়তে পারে।
সমকাল: উচ্চশিক্ষার মান নিয়ে আপনি লেখালেখি করেছেন। সেখানে ঘাটতিটা কোথায়?
কামরুল হাসান মামুন: প্রাথমিক, মাধ্যমিক কিংবা উচ্চশিক্ষা; যা-ই বলি, প্রথম সমস্যা বাজেট বরাদ্দ। বিষয়টা শুরুতেই বলেছি। ইউনেস্কো যেখানে বলছে, জিডিপির সাড়ে ৫ বা ৬ শতাংশ শিক্ষায় বরাদ্দ দিতে হবে; সেখানে আমাদের বরাদ্দ ২ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অন্যদিকে ভিয়েতনাম ৪ শতাংশের ওপরে শিক্ষায় বরাদ্দ দিয়ে আসছে, যার সুফল দেশটি পাচ্ছে। ভিয়েতনামের বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্বের সেরা ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে প্রবেশ করেছে। প্রতিবছর দেশটির ২২ থেকে ২৪ হাজার শিক্ষার্থী আমেরিকায় পড়াশোনা করতে যায়। আর বাংলাদেশ থেকে যায় ১২ থেকে ১৩ হাজার শিক্ষার্থী। অথচ তাদের জনসংখ্যা বাংলাদেশের প্রায় অর্ধেক। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অভাব নেই, কিন্তু সেগুলোর মান নেই। কারণ মানসম্মত শিক্ষক আমরা নিয়োগ দিতে পারিনি। তার ওপর শিক্ষকরা রাজনীতিতে জড়িত বলে যতটা ভালো ফল পাওয়া যেত, সেটাও পাচ্ছি না।
সমকাল: শিক্ষকদের বেতন নিয়ে এত সোচ্চার কেন আপনি?
কামরুল হাসান মামুন: প্রতিষ্ঠাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চেয়ে ৩০০ রুপি বেশি ছিল। তখন এটি অনেক টাকা। যে কারণে তখন কলকাতা থেকে অনেক শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। তখন আমরা সত্যেন বোসকে পেয়েছিলাম; জ্ঞান ঘোষ, রমেশ মজুমদারের মতো শিক্ষকও পেয়েছি। আজকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের দ্বিগুণেরও বেশি। মানসম্মত শিক্ষক পেতে হলে তো আপনাকে ভালো বেতন দিতে হবে। তা নেই বলেই এখন আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাপক শিক্ষক মাইগ্রেটেড হচ্ছেন। কেউ যাচ্ছেন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে, কেউ বিদেশে; কেউ বিসিএস দিয়ে প্রশাসন, পুলিশ কিংবা ট্যাক্স ক্যাডারে চলে যাচ্ছেন। এই মাইগ্রেশনই প্রমাণ করে– শিক্ষকতা পেশা আর আকর্ষণীয় নেই। কেউ কোথাও চাকরি না পেলে এ পেশায় আসছেন। যে দেশের বড় বড় স্কলার, সংস্কৃতিকর্মী, কবি, সাহিত্যিক, লেখক, বিত্তবান মানুষ দলে দলে মাইগ্রেট করে, সে দেশ কীভাবে সুস্থ-সুন্দর থাকবে? এই মাইগ্রেশনের কারণ দূর না করলে এ দেশের উন্নয়ন কোনোদিন হবে না। কিছু কংক্রিটের দালানকোঠা হলেই তা উন্নয়ন নয়। যারা দালানকোঠাকে উন্নয়ন ভাবেন, তাদের জ্ঞান-বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন উঠবেই।
সমকাল: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বেশি বেতন দিচ্ছে?
কামরুল হাসান মামুন: হ্যাঁ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক যে বেতন পান, তার চার গুণ বেতন পান অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমাকে চার গুণ বা তারও বেশি বেতনের অফার দেওয়া হয়। শুধু আমাকে না; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষকই এমন অফার পান। তারপরও আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করি। এটি আমাদের একটি স্যাক্রিফাইস। অনেকে আবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশপাশি আরও দু-এক জায়গায় সময় দেন। তার মানে, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বঞ্চিত করছেন। কল্পনা করা যায়, ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্সের একজন সহকারী অধ্যাপক বেতন পান ১ লাখ ৮৬ হাজার রুপি, যা ২ লাখ টাকার চেয়েও বেশি! আর আমাদের দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সহকারী অধ্যাপক পান টেনেটুনে ৫০ হাজার টাকা।
সমকাল: বেতনের দিক থেকে প্রাথমিক শিক্ষকদের অবস্থা তো আরও করুণ…
কামরুল হাসান মামুন: সেখানকার শিক্ষকদের বেতন আমার ড্রাইভারের বেতনের চেয়েও কম। তাদের স্কেল রাষ্ট্রের তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারীর সমতুল্য। এই শিক্ষকের সম্মান কীভাবে বজায় থাকবে আর কীভাবেই বা বাড়বে শিক্ষার মান? শিক্ষকদের তো অন্তত জীবন ধারণের জন্য ন্যূনতম বেতন দিতে হবে। প্রত্যাশিত বেতন না পেয়েই শিক্ষক শ্রেণিকক্ষে ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট-কোচিংয়ে ব্যস্ত থাকেন।
সমকাল: উপযুক্ত শিক্ষার পরিবেশ কি আছে?
কামরুল হাসান মামুন: উচ্চশিক্ষার কথা যদি বলি, এক সময় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও গবেষণার পরিবেশ ছিল। শিক্ষকরা ভাবতেন, সুযোগ-সুবিধা কম থাকলেও অন্তত পরিবেশ আছে। এখন রাজনীতি এমনভাবে ঢুকে পড়েছে যে, সেই পরিবেশও নেই।
সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।
কামরুল হাসান মামুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।