Mahfuzur Rahman Manik
জলোচ্ছ্বাস তো উপকূলে, ঢাকায় কেন জলাবদ্ধতা

রিমাল উপকূলে আঘাত হানলেও তার প্রভাব পড়েছে রাজধানীসহ প্রায় সারাদেশে। রোববার মধ্যরাত থেকেই ঢাকায় বৃষ্টি ঝরেছে। অনবরত বৃষ্টির কারণে সোমবার কর্মদিবসে সকাল থেকেই রাজধানীর অফিসগামী মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়।

অফিসে নিয়মিত যাতায়াতে দুই চাকার যান সাইকেলই আমার ভরসা। বৃষ্টিতে ভেজার জন্য ছাদহীন এই যান আদর্শ হতে পারে। কিন্তু তুমুল বৃষ্টির মধ্যে সাইকেলে অফিসে যাওয়া মুশকিল। সোমবারের পরিস্থিতিতে তাই বিকল্প চিন্তা করছিলাম। অফিসে যাওয়ার জন্য প্রথমে শেওড়াপাড়া যেতে হয়। সেখান থেকে অন্তত ফার্মগেট পর্যন্ত যেতে পারলে বাকিটুকু রিকশায় যাওয়া সম্ভব। ঢাকায় বৃষ্টির দিনে সিএনজি কিংবা পাবলিক বাসের ভোগান্তির অভিজ্ঞতায় সেগুলোর কথা চিন্তা করতে পারিনি। এর বাইরে থাকে মেট্রোরেল। সামাজিক মাধ্যম থেকে জানা গেল, সেটাও যান্ত্রিক ত্রুটিতে বন্ধ হয়ে আছে।
ভাবতে ভাবতে দেখলাম, বৃষ্টি কিছুটা কমেছে। তাই সাইকেল ও রেইনকোট নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। বাসা থেকে বেরিয়ে গলির মধ্যেই দেখি হাঁটুপানি। এর মধ্যে অন্যান্য যানবাহন চলছে, আমিও চললাম। ওপরে বৃষ্টি, নিচে পানিতে সাইকেল চালানো এতটা সহজ নয়। তাও গাড়ির জন্য অপেক্ষমাণ মানুষের যে দুর্ভোগ দেখেছি, তার চেয়ে নিজেকে ভাগ্যবানই বলতে হবে।

বৃষ্টি হলেই ঢাকার জলাবদ্ধতার খবর বেশ পুরোনো। তবে প্রতিবার বৃষ্টির পর তা নতুন খবর হিসেবে সামনে আসে। সামান্য বৃষ্টিতে ঢাকার অনেক মূল সড়কসহ অলিগলিতে পানি উঠে যায়। মঙ্গলবার সমকালের প্রতিবেদন অবশ্য বলছে, সোমবার সারাদিনে ১৪৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এতে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার সড়ক যেমন ডুবে যায়, তেমনি অনেক এলাকায় গাছের ডাল ভেঙেও যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। তবে জলাবদ্ধতার কারণে বহুবিধ সংকট তৈরি হয়। একদিকে পর্যাপ্ত যানবাহন পাওয়া যায় না, আবার মোটরচালিত যানবাহনে পানি ঢুকে সেগুলো বিকল হয়ে পড়ে। সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয় মানুষের হাঁটাচলায়। অনেকে হয়তো হেঁটেই অফিসে বা কাজে যান। সড়কও কারও কর্মক্ষেত্র। সেখানে ভ্রাম্যমাণ ভ্যানে নানা পণ্য বেচাকেনা হয়। বৃষ্টি হলে কিংবা সড়ক ডুবে গেলে তাদের সমস্যায় পড়তে হয়। তবে বৃষ্টির সময় ভ্যানে মানুষ পার করে কারও কারও উপার্জনের ব্যবস্থা হয় বটে। বিশেষ করে জলাবদ্ধতা যেখানে বেশি হয়।

জলাবদ্ধতা দ্রুত নিরসনে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) এলাকায় নাকি ৫ হাজার ৩০০ পরিচ্ছন্নতাকর্মী মাঠে নামানো হয়। ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছেন, ‘অল্প সময়ে অনেক বৃষ্টিপাত হয়েছে। তার পরও দীর্ঘ সময় পানি জমে থাকেনি। জলাবদ্ধতার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’ যদিও বাসায় যাওয়ার পথে রাত সাড়ে ৯টায় ভেতরের গলিতে সকালের চাইতে অধিক এলাকাজুড়ে আরও বেশি পানি দেখার অভিজ্ঞতা হয়।

এদিকে জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ৯১টি দল নাকি কাজ করেছে। তাদের দাবি অবিশ্বাস্য নয় হয়তো। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এগুলো জরুরি ও সাময়িক পদক্ষেপ। দীর্ঘ মেয়াদে জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল উদ্ধার, পয়ঃনিষ্কাশনে সুব্যবস্থাসহ যেসব সুপারিশ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা করছেন, দিন শেষে সেখানেই ফিরতে হবে।
ঘূর্ণিঝড় রিমালের কারণে উপকূলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ প্রকাশ হচ্ছে, আরও হবে। রিমালের প্রত্যক্ষ শিকার হিসেবে উপকূলীয় এলাকার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা হওয়া নিঃসন্দেহে জরুরি। কিন্তু দুর্যোগের বাইরের এলাকার মানুষও যদি প্রশাসনিক অব্যবস্থাপনার কারণে দুর্ভোগে পড়ে, সেটা দুঃখজনক। বিশেষ করে বর্ষা মোটামুটি দীর্ঘ মৌসুম। এ সময়ে বৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। প্রকৃতির স্বাভাবিক আচরণেই যদি এমন সংকট তৈরি হয়, তবে মানুষের এই ভোগান্তি দীর্ঘায়িত হতে বাধ্য।

রাজধানী ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিয়ে বছরের পর বছর এত আলোচনা, কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের পর আশ্বাস সত্ত্বেও বাস্তবে বৃষ্টি এলেই যেন সবকিছু ভেঙে পড়ে। প্রাকৃতিক এই অবস্থার কাছে প্রশাসন কেন অসহায়? বৃষ্টির সঙ্গে জলাবদ্ধতা কিংবা পরিবহন ভোগান্তি কেন একাকার হবে? নগরবাসীর একাংশের নতুন ভরসার জায়গা মেট্রোরেলই বা অল্পতে কেন বিকল হবে; ঘণ্টার পর ঘণ্টা বন্ধ থাকবে? বৃষ্টি এলেই হঠাৎ কেন সিএনজিওয়ালা বা রিকশার ভাড়া বেড়ে যাবে?

বৃষ্টি প্রভাবিত এসব সংকট অধিকাংশই ব্যবস্থাপনাগত। এ ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দিতে হবে জলাবদ্ধতা নিরসনে। এর সমাধান সিটি করপোরেশনের অজানা থাকার কথা নয়। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে হলেও স্থায়ী সমাধানে হাত দিতে হবে। সদিচ্ছা থাকলে যানবাহন সংকট সমাধানও কঠিন হতে পারে না। আর সংকটে সুযোগসন্ধানী মানসিকতা পরিহার করলে নগরবাসী অন্তত পরিবহন সংকটে এতটা ভুগবে না।

সমকালে প্রকাশ: ২৯ মে ২০২৪

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।