Mahfuzur Rahman Manik
জাহাজটি জলদস্যুমুক্ত করার কার্যকর বিকল্প ছিল
এপ্রিল 22, 2024

সাক্ষাৎকার: এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাহফুজুর রহমান মানিক

নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ ইশফাক ইলাহী চৌধুরী, এনডিসি, পিএসসি ৩৫ বছর বিমানবাহিনীর কর্মজীবন শেষে ২০০৩ সালে এয়ার কমডোর হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। তিনি স্টাফ কলেজ ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজেও দীর্ঘদিন প্রশিক্ষক ছিলেন। ১৯৬৮ সালে তৎকালীন পাকিস্তান এয়ারফোর্সে কমিশন্ড অফিসার হিসেবে যোগ দেওয়ার পর তিনি ১৯৭৫ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ১৯৮৬ সালে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করেন। এ ছাড়া ডিফেন্স স্টাডিজে স্নাতকোত্তর এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজে এমফিল ডিগ্রি লাভ করেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সমকালের জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক মাহফুজুর রহমান মানিক।

সমকাল: ভারত মহাসাগর থেকে বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহকে ছিনতাইয়ের এক মাস পর ১৩ এপ্রিল সোমালিয়ার জলদস্যুরা নাবিকসহ মুক্তি দিয়েছে। বিষয়টা কীভাবে দেখছেন?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: জিম্মিদশায় নাবিকরা নিশ্চয় নানাভাবে কষ্ট পেয়েছেন। তবে সবাই অক্ষত এবং ছাড়া পেয়ে দেশে আসছেন, এটা আমাদের সবার জন্য স্বস্তির বিষয়। তবে যেভাবে তারা জিম্মিদশায় পড়েছেন এবং তাদের মুক্তিতে যে প্রক্রিয়া গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে আমার কিছু পর্যবেক্ষণ আছে।

সমকাল: পর্যবেক্ষণগুলো যদি বলেন।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: নাবিকদের মুক্তিপণ দিয়ে মুক্ত করা হয়েছে। কিন্তু এর বাইরে কি মুক্তির পথ খোলা ছিল না? জাহাজের মালিকরা যেভাবে বিভিন্ন পরিস্থিতি তুলে ধরছিলেন, তাদের ব্যাখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। বিশেষ করে নিরাপত্তা বিষয়ে তাদের ব্যাখ্যা সন্তোষজনক নয়।

সমকাল: জলদস্যুদের আক্রমণ থেকে নাবিকদের সুরক্ষায় জাহাজটিতে অনেক দিক থেকেই নিরাপত্তার ঘাটতি ছিল। সেটাই বলছেন?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: নিরাপত্তা ঘাটতির বিষয়টি খুবই স্পষ্ট। বস্তুত জাহাজে কোনো ধরনের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। যদিও কোম্পানি বলছিল, তাদের জাহাজ এত দূর দিয়ে চলছিল যে, তাতে জলদস্যুদের হামলার মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কা ছিল না। বাস্তবে সেটা হয়নি। জাহাজ অরক্ষিত রাখার ক্ষেত্রে কোম্পানির যুক্তি গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
সমকাল: জাহাজ সুরক্ষায় কী করা প্রয়োজন ছিল?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: ভারত মহাসাগরে পূর্ব আফ্রিকা উপকূলের সমুদ্রপথটি যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। এ রুটসহ সাগরে জলদস্যুতা প্রতিরোধ এবং সামুদ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কাজ করে যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড কিংডম মেরিটাইম ট্রেড অপারেশনস- ইউকেএমটিও। তারা জাহাজ সুরক্ষায় বেশ কিছু নির্দেশনা দিয়ে থাকে। ইউকেএমটিওর নির্দেশনায় আর্মড গার্ড তথা অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগের বিষয়টি অন্যতম। অথচ এমভি আবদুল্লাহতে কোনো অস্ত্রধারী নিরাপত্তারক্ষী ছিলেন না। নিরাপত্তারক্ষীরা তাদের বাধা দিলে জলদস্যুরা জাহাজে ঘেঁষতেই
পারত না।

সমকাল: নিরপত্তারক্ষীদের খরচ কে বহন করবে?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: স্বাভাবিকভাবেই নিরাপত্তারক্ষীদের খরচ কোম্পানিই বহন করবে। কোম্পানির জাহাজ সুরক্ষায় এটি তেমন কোনো ব্যয়সাপেক্ষ বিষয় নয়। তা ছাড়া এসব জাহাজের নিজস্ব একটা ওয়াটার পাম্প সিস্টেম থাকে। জলদস্যুরা জাহাজের কাছে এলে জোরে পানির স্প্রে করলে তারা জাহাজে উঠতে পারবে না। এটা কোনো খরচেরই ব্যাপার নয়।

সমকাল: তার মানে, প্রাথমিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাই জাহাজটিতে ছিল না?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: না, একদম ছিল না। এমনকি জলদস্যুরা অতি সহজে যেভাবে জাহাজে উঠে গেল এবং নাবিকরা যেভাবে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করলেন, সেটা বিস্ময়কর। এর পর জলদস্যুরা জাহাজটি সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যায়। সেখানে অনেক দিন জাহাজটি স্থির ছিল। তখনও দস্যুদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।

সমকাল: সেখানে দস্যুদের বিরুদ্ধে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যেত? এমন নজির কি আছে?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: সোমালিয়া সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেখানকার সরকারও জলদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত। এমনকি ওই এলাকায় যেসব যুদ্ধজাহাজ টহল দিচ্ছিল, তাদেরও সাহায্য নেওয়া যেত। তা ছাড়া নাবিকদের নিরাপত্তার জন্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। অথচ জলদস্যুদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে অনেক জাহাজ ও নাবিক মুক্তির ঘটনা আছে। এতে হতাহতের তেমন ঘটনাও ঘটেনি। শুধু একটা ঘটনায় একজন নাবিক আহত হয়েছিলেন। প্রশিক্ষিত নৌ কমান্ডোদের মাধ্যমে এসব নিরাপদ অপারেশন চালানো হয়ে থাকে। আমাদের ক্ষেত্রে সেটা হয়নি।

সমকাল: এমন অপারেশনে না গিয়ে মুক্তিপণের মাধ্যমে মুক্তি আপনি কীভাবে দেখছেন?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: মুক্তিপণের মাধ্যমে মুক্তি কোনো ভালো নজির নয়। যদিও ইতোপূর্বে এ কোম্পানিই মুক্তিপণ দিয়ে জাহাজ ও নাবিকদের মুক্ত করেছিল। এখন জলদস্যুরা কাকতালীয়ভাবে একই কোম্পানিকে নিশানা করল এবং তারা আবার মুক্তিপণ দিল। নীতিগতভাবে দস্যুদের কাছে এমন আত্মসমর্পণ সমর্থনযোগ্য নয়। এর মাধ্যমে বার্তা পরিষ্কার– যেখানে এই কোম্পানির কিংবা বাংলাদেশি পতাকাবাহী অন্যান্য জাহাজও আক্রমণের শিকার হতে পারে।

সমকাল: অন্য দেশের অভিজ্ঞতা কী বলে?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: অন্যান্য দেশ জাহাজ চলাচলের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তা ছাড়া যদি তারা জলদস্যু কর্তৃক আক্রান্ত হয়ও, সেখানে যে টাস্কফোর্স কাজ করছে, তাদের সহায়তায় তারা নাবিকদের উদ্ধার করে। যে কারণে ওইসব দেশের জাহাজে সহজে জলদস্যুরা আক্রমণ করে
না। আমরাও যদি একইভাবে নাবিকদের ফিরিয়ে আনতে পারতাম, তবে একই ধরনের কঠোর বার্তা জলদস্যুরা পেত।

সমকাল: নাবিকদের মুক্তির পর নৌ প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এত অল্প সময়ে নাবিকদের মুক্তির ঘটনা নজিরবিহীন। আপনার মন্তব্য কী?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: কোনো কোনো ঘটনায় নাবিকদের মুক্তিতে দেরি হয়ে থাকতে পারে। কিন্তু যেসব ঘটনায় বল প্রয়োগ করা হয়েছে, সেখানে দ্রুতই মুক্তি পাওয়ার কথা।

সমকাল: গাজায় ইসরায়েলি হামলার কারণে সুয়েজ খাল, লোহিত সাগর এবং এর আশপাশ অঞ্চলে আমরা হুতিদের তৎপরতা দেখছি। সেটি পশ্চিমাদের কাছে অগ্রাধিকার পাওয়ায় অন্য রুটগুলো কি নাজুক হয়ে পড়েছে?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: সেখানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার হওয়া মানে অন্য রুটগুলো নাজুক হবে– এমনটা ভাবার কারণ নেই। জলদস্যুদের বিরুদ্ধে সমুদ্র নিরাপত্তায় এয়ারক্রাফটের প্রয়োজন নেই। সেখানে ছোট প্যাট্রোল বোট চললেই যথেষ্ট। সারা পৃথিবীতে কোন জাহাজ কোথায় চলছে, তা মোবাইল ফোনের অ্যাপসের মাধ্যমেও দেখা যায়। প্রত্যেকে প্রত্যেকের অবস্থান জানে। কোনো জাহাজ আক্রান্ত হলে আন্তর্জাতিক নির্দিষ্ট চ্যানেলের মাধ্যমে জানানোর ব্যবস্থা আছে। সাহায্য চেয়ে আবেদন করলে আশপাশ থেকে নিরাপত্তা বাহিনী ছুটে আশার কথা। এভাবে অন্যান্য জাহাজ মুক্ত করা হয়েছে। অথচ আমাদের জাহাজ ছিনতাই হওয়ার পরও জলদস্যুদের কথামতো সোমালিয়ার দিকে তা নিয়ে যাওয়া হলো।

সমকাল: এমভি আবদুল্লাহ আক্রান্ত হওয়ার পর নাবিকরা কি তেমন আবেদন করেননি?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: তা আমি জানি না। কিন্তু বিষয়টা সংশ্লিষ্টদের জানার কথা। কোম্পানির মাধ্যমে তাদের সুরক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। দেখুন, জাহাজ শুধু জলদস্যুদের কবলে পড়াই নয়, অন্য বিপদও তো হতে পারে। আগুন লাগতে পারে। তখন বিপদে পড়লে সংশ্লিষ্ট চ্যানেলে জানানোই স্বাভাবিক। বিমানের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটে থাকে। কোনো জাহাজের আন্তর্জাতিক রুটে চলার সময় পোর্টের সঙ্গে, কোম্পানির সঙ্গে কিংবা রুটের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগ থাকাই উচিত। এর মধ্যে একটা জাহাজ কীভাবে ছিনতাই করে নিয়ে যায়?

সমকাল: জলদস্যুতা প্রতিরোধ ও জাহাজ সুরক্ষায় বাংলাদেশের করণীয় কী?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: অন্যান্য দেশের তুলনায় সমুদ্রে বাংলাদেশি জাহাজ চলাচল অনেক কম। এর পরও আমাদের যেসব জাহাজ আন্তর্জাতিক রুটে চলাচল করে, সেগুলোর সুরক্ষায় ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। আমাদের নিজস্ব নেভাল কমান্ডো আছে, কোস্টগার্ড কমান্ডো আছে। তাদের আমরা জাহাজে নিয়োজিত করতে পারি। তা ছাড়া সংশ্লিষ্ট এলাকায় যে টাস্কফোর্স কাজ করছে, তাদের সঙ্গে সহযোগিতা ও যোগাযোগের বিষয়ও জরুরি। সংশ্লিষ্ট এলাকায় চলা জাহাজগুলোর সঙ্গেও সমন্বয় করা যেতে পারে। তা ছাড়া প্রাথমিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করতেই হবে। যেমন– এই জাহাজেই আমরা দেখলাম, নাবিকদের মুক্তির পর চারদিকে কাঁটাতারের নিরাপত্তা বেষ্টনী লাগানো হয়েছে। প্রস্তুত করে রাখা হয়েছে ফায়ার হোস (যেটি দিয়ে জোরে পানি ছিটানো হয়)। কোম্পানি সংবাদমাধ্যমকে বলেছে, কাঁটাতার ও ফায়ার হোস জাহাজের মধ্যেই ছিল।

সমকাল: তার মানে, সুরক্ষাসহ জাহাজ ছিনতাই ঘটনাটি মোকাবিলায় পেশাদারিত্ব আমরা দেখাতে পারিনি?

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: আমি আগেই বলেছি, নাবিকদের ফেরা আমাদের জন্য স্বস্তির। কিন্তু সাধারণ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ না করার মধ্যে আমরা যেমন অবহেলা দেখছি; তেমনি মুক্তিপণের মাধ্যমে নাবিকদের মুক্তির বিষয়টি বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্যও ভালো নয়। মুক্তিপণের মাধ্যমে যেন আমরা জলদস্যুদের কাছে নতি স্বীকার করেছি।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী: আপনাকেও ধন্যবাদ।

ট্যাগঃ , , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।