Mahfuzur Rahman Manik
শিশুটি মরিয়া প্রমাণ করিল…
জানুয়ারী 4, 2024
student-suicide-rate-rising in Bangladesh

ইতির পরিচয় যতটা না গৃহকর্মী, তার চেয়ে বেশি শিশু। শিশু হলেও তার লজ্জা আছে; অপমান বোঝে। কিন্তু সে অসহায়। এ অসহায়ত্ব অবশ্য গৃহকর্মী হওয়ার কারণেই। তার কষ্ট কাউকে বলতে পারেনি। গৃহকর্তার পাশবিকতার শিকার হয়ে মেয়েটি ট্রমা নিয়ে বাঁচতেও চায়নি। ১২ বছরেই জীবনের ইতি ঘটিয়েছে ইতি। আত্মহননের পথ বেছে নিয়ে প্রমাণ করেছে– সে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল।

সেই প্রমাণ অবশ্য আমরা পেয়েছি প্রায় দুই বছর পর। এতদিন জানতাম, ইতির অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। এখন পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, মৃত্যুর আগে ধর্ষণের শিকার হয় শিশুটি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক যুগ্ম সচিব কামাল উদ্দিন আহমেদের বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করত ইতি আক্তার। তাঁরই লালসার শিকার ইতি। সাবেক এই যুগ্ম সচিবও পগারপার। অস্ট্রেলিয়া থেকে যখন তিনি খবরটি দেখবেন, তাঁর কী অনুভূতি হবে? ইতি চলে গেছে, কিন্তু ইতির মতো কত গৃহকর্মী এমন বেদনা বয়ে বেড়াচ্ছে– আমরা জানি না। গৃহশ্রমিকরা দুর্বল। একে তো অধিকাংশই শিশু, অন্যদিক সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক; কোনোদিক থেকেই তাদের ক্ষমতা নেই। সে জন্য তাদের নিয়ে যত খবর আমরা সংবাদমাধ্যমে দেখি, তার অধিকাংশেই নির্যাতন জড়িত।

গৃহকর্মীদের ওপর গৃহকর্তা-কর্ত্রীরা নিপীড়ন চালান। অনেক ক্ষেত্রে সমাজে যারা প্রভাবশালী, বাড়িতে তারা অনেকেই দুর্বল এই শ্রেণিকে নিশানা করেন। খুন্তি গরম করে শরীরে ছ্যাঁকা দেওয়ার মতো বিভীষিকার খবর আমাদের দেখতে হয়। এমনকি নির্যাতন সইতে না পেরে অনেক বাসা থেকে গৃহকর্মীদের পলায়নের ঘটনাও ঘটে। এমনিভাবে ২০১১ সালের এপ্রিলে আরেক যুগ্ম সচিবের বাসা থেকে গৃহকর্মীর লাশ উদ্ধারের খবর প্রকাশ হয়। ১০ বছর বয়সী তানিয়া পাঁচতলার ছাদ থেকে দেয়াল বেয়ে নামার সময় পা পিছলে পড়ে মারা যায়। এর আগেও তানিয়া ওই বাসা থেকে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল।

ইতির ঘটনায় মামলা করেছিল তার মা। ২০২২ সালের ২৯ জানুয়ারি ইতির মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তখন অবশ্য মামলা হয়েছিল অস্বাভাবিক মৃত্যু হিসেবে। পরে একই বছরের নভেম্বরে সন্দেহ থেকেই মা মামলাটি করেছিলেন। তিনি এজাহারে উল্লেখ করেন, ঘটনার আগের দিন ইতি তাঁকে ফোনে জানায়, সে আর ওই বাসায় কাজ করবে না। সেখানে তার ওপর নির্যাতন করা হয়। মা তাঁর মেয়েকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন বলে আশ্বস্ত করেন। কিন্তু পরদিনই তিনি মেয়ের মৃত্যুর খবর পান।

ইতির মতো শিশুরাই গ্রাম থেকে এসে শহরে ধনীদের বাসায় কাজ করে। দরিদ্র পরিবারগুলো পরিস্থিতির কারণে আদরের সন্তানকে কাজ করতে পাঠায়। ভাবে, হয়তো মেয়েটি আরেকটু ভালো থাকবে। সেখানে তাদের এমন পরিণতি কীভাবে আমরা মেনে নেব!

গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতি আছে কাগজ-কলমে। গৃহকর্মীর অধিকার ও কল্যাণ নিশ্চিতে করা হয়েছিল ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫’। এর পর আট বছর পেরিয়ে গেলেও এ নীতি বাস্তবায়ন হয়নি। গৃহকর্মী নিজেরা তো বটেই, নিয়োগকর্তা এমনকি আইন প্রয়োগকারী সংস্থাও এ নীতি সম্পর্কে কতটা অবগত– সে সংশয় রয়েই গেছে। সিটি করপোরেশন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে নির্বাহী কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে যেসব মনিটরিং সেল গঠন করার কথা ছিল, তা গঠনই হয়নি। অথচ গৃহকর্মীর সংখ্যা সংশ্লিষ্টরা বলছেন ২০ লাখ। ইতির মতো হতভাগাদের পাশে সমাজের জাগরণ জরুরি। আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে।

এটি ভালো যে, প্রায় দুই বছর পর হলেও ইতির ‘অস্বাভাবিক’ মৃত্যুর কারণ জানা যাচ্ছে। ইতিকে মরে যেভাবে তা প্রমাণ করতে হলো, এমনটা যেন কোনো শিশুর বেলায় না ঘটে।

সমকালে প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৩

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।