ঢেঁকি যেমন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে; পাপিয়ারা তেমনি কারাগারে গেলেও বেপরোয়া থাকেন। ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে স্বামীসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে জেলেই আছেন শামীমা নূর পাপিয়া। তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে অবৈধ অস্ত্র, মাদক, চোরাচালান ও জাল নোটের ব্যবসা, চাঁদাবাজি, তদবির বাণিজ্য, জায়গা-জমি দখল করে অনৈতিক ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে বিপুল অর্থবিত্তের মালিক হওয়ার অভিযোগে মামলা চলছে। নরসিংদী জেলা যুব মহিলা লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালনকারী পাপিয়া রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে এসব অপকর্ম চালাতেন। গ্রেপ্তারের পর অবশ্য দল থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। তবে জেলখানায়ও পাপিয়া বদলাননি। ২৭ বছরের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদি পাপিয়া গাজীপুরের কাশিমপুর মহিলা কেন্দ্রীয় কারাগারে সম্প্রতি হাজতি এক নারীকে নির্যাতন করেন। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, নথি চুরির একটি মামলায় গ্রেপ্তার শিক্ষানবিশ আইনজীবী রুনা লায়লাকে গত ১৭ জুন কাশিমপুর মহিলা কারাগারে আনা হয়। সাধারণ ওয়ার্ডে নেওয়ার পর তাঁর দেহ তল্লাশি করে কর্তব্যরত মেট্রন তাঁর কাছে ৭ হাজার ৪০০ টাকা পান। ওই টাকা ছিনিয়ে নিতে পাপিয়া ও তাঁর সমর্থক কয়েদিরা পিটিয়ে রক্তাক্ত অবস্থায় রুনাকে মেঝেতে ফেলে রাখেন।
কারাগারকে বলা হয় সংশোধনাগার। কিন্তু বাংলাদেশের কারাগারের চিত্রটা উল্টো। এখানে অপরাধী আরও বড় অপরাধী হয়ে যায়। ফলে পাপিয়ার মতো অপরাধীদের এখান থেকে সংশোধনের দীক্ষা গ্রহণ করার সুযোগ সামান্যই। তার চেয়ে বেশি সুযোগ রয়েছে পেশিশক্তি ব্যবহার করে জেলখানায় নিজের প্রভাব বিস্তারের; বিশেষ করে নতুন হাজতিদের নিপীড়নের সুযোগ সেখানে অবারিত।
জেলখানায় হাজতিদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের সুযোগ আছে। যারা লেখাপড়া জানে তারা সেখানে অফিসে রাইটারের কাজ করে। শামীমা নূর পাপিয়াও তেমনি রাইটারের কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু এই সুযোগে এবং অবশ্যই জেল কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অথবা নজরদারির অনুপস্থিতিতে তিনি সেখানে সমমনা হাজতিদের নিয়ে অপরাধের আরেকটা সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন। তাঁর প্রভাব এত ব্যাপক ছিল যে, কোনো হাজতি নির্যাতনের ঘটনায় অন্য হাজতিরা প্রতিবাদ পর্যন্ত জানানোর সাহস পেতেন না।
পশ্চিমবঙ্গের বলাগড়ের তৃণমূলের বিধায়ক মনোরঞ্জন বেপারি বছরদুয়েক আগে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি জেলের রাইটার হতে চেয়েছিলেন। কারণ তাঁর কাছে ‘জেল হচ্ছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে না গেলে অক্ষরজ্ঞান হতো না। তিন বেলা খাবারের চিন্তা করতে হতো না। যে চিন্তা জেলের বাইরে করতে হতো।’ মনোরঞ্জন বেপারি জেলখানায় এক মাস্টার পেয়েছিলেন এবং পড়াশোনাও শিখেছেন। সে জন্য তাঁর কাছে রাইটার পদটি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিন্তু যেনতেন উপায়ে টাকা কামানো যার নেশা ও পেশা, তার পক্ষে বেপারির মতো ওই মনোভাব ধারণ সম্ভব নয়। ফলে জেলবিধি অনুযায়ী ‘রাইটার’ পদ চলে যায় পাপিয়ার। উক্ত অপরাধের শাস্তিস্বরূপ তাঁকে কাশিমপুর কারাগার থেকে কুমিল্লা কারাগারে স্থানান্তর করা হয়েছে; আর কাজ পেয়েছেন ঝাড়ুদারের। জগতে কোনো কাজই ছোট নয়। অর্পিত দায়িত্ব আন্তরিকতার সঙ্গে পালন করলে যে কোনো কাজ করেই সমাজে সম্মানের আসনে বসা যায়। দেখা যাক, পাপিয়া সে শিক্ষা নিতে পারেন কিনা, যদিও কথায় আছে– স্বভাব যায় না মলে, ইল্লত যায় না ধুলে।