Mahfuzur Rahman Manik
শিশুর শারীরিক শাস্তির দেশীয় ট্র্যাজেডি
এপ্রিল 30, 2023

শিশুর শারীরিক শাস্তি বিষয়ে ২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সমকালে লিখেছিলাম– উপমহাদেশীয় ট্র্যাজেডি। ভারতে এক মা তাঁর সন্তানকে পড়ানোর সময়কার শাসানি আর মারের এক ভিডিও তখন ভাইরাল হয়। সেটিই ছিল ওই লেখার উপলক্ষ। তবে আজকের বিষয় দেশীয় ট্র্যাজেডি। বাড়িতে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কিংবা কর্মস্থলে এমনকি রাস্তাঘাটেও আমাদের কোমলমতি শিশুরা যেভাবে শারীরিক শাস্তির শিকার হয় সেটি এক ট্র্যাজেডিই বটে। এ প্রেক্ষাপটেই শিশুর শারীরিক শাস্তির বিলোপ সাধনে প্রতি বছর ৩০ এপ্রিল পালিত হয় ‘ইন্টারন্যাশনাল ডে টু এন্ড করপোরাল পানিশমেন্ট’।

অস্বীকার করা যাবে না, সরকারি পরিপত্র ছাড়াও এ নিয়ে নানা মহল সোচ্চার থাকায়, আমাদের দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিশুকে শাস্তি দেওয়ার হার ও প্রবণতা উভয়ই কিছুটা কমেছে। ২১ এপ্রিল ২০১১-এ প্রকাশিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে শারীরিক ও মানসিক শাস্তির বিষয়গুলো স্পষ্টভাবে বলা আছে। সেখানে বিশেষ করে ১১ ধরনের শারীরিক শাস্তি এবং ২ ধরনের মানসিক শাস্তি যেভাবে বলা আছে তাতে বলা চলে সব বিষয়ই এসেছে। এরপর দেখা গেছে, শিক্ষক অনেক ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের নিপীড়নমূলক শাস্তি দিলে, তা খবর হিসেবে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়। প্রশাসন তৎপর হয় এবং অনেক শিক্ষকের গ্রেপ্তারের খবরও আমরা দেখেছি।

এটা সত্য, একটা সময় অভিভাবকরাই চাইতেন শিক্ষক যেন তাঁর সন্তানকে পিটিয়ে ‘মানুষ’ করেন। তবে অভিভাবকদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন এসেছে। এখন কোনো শিক্ষক সন্তানকে পেটালে অভিভাবকরাই এর প্রতিবাদ জানান। তারপরও দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এখনও অনেক শিক্ষক অসচেতন। এখনও অনেক অভিভাবকের মধ্যেও পুরোনো সেই ধ্যান-ধারণা রয়ে গেছে। যে কারণে শিশুর নির্যাতনের ব্যাপারে বিভিন্ন জরিপে যেসব তথ্য উঠে এসেছে সেগুলো ভয়াবহতারই ইঙ্গিত দিচ্ছে। গত বছরের মাঝামাঝিতে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন (এমজেএফ) ও ইনসিডিন বাংলাদেশ পরিচালিত জরিপের তথ্য সমকালে প্রকাশ হয়। সেখানে দেখানো হয়েছে, শতকরা ৯৫ দশমিক ৮ ভাগ শিশু ঘরেই নানাভাবে নির্যাতিত হয়। এর মধ্যে বাবা-মা ও অভিভাবক দ্বারা সবচেয়ে বেশি নিপীড়নের শিকার হয় শিশুরা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও ইউনিসেফের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে ২০১৯’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের এক থেকে ১৪ বছর বয়সী ৮৯ শতাংশ শিশু জরিপ পূর্ববর্তী এক মাসের মধ্যে শারীরিক শাস্তির শিকার হয়েছে। অর্থাৎ ঘরেবাইরে কোথাও আমাদের শিশুরা নিরাপদ নয়। শিশুরা এভাবে সর্বত্র নিপীড়নের শিকার হওয়ার মানে হলো আমাদের শিশুরা সুস্থভাবে বেড়ে উঠছে না এবং তাদের বিকাশ ব্যাহত হওয়ার ঝুঁকি স্পষ্ট। সব ক্রিয়ার যেখানে প্রতিক্রিয়া রয়েছে, সেখানে শিশুকে শারীরিকভাবে শাস্তিতে কিছু হবে না, এমনটি ভাবা ভুল। ইতোমধ্যে শিক্ষকের বেত্রাঘাতে তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীর চোখ হারানোর শঙ্কার খবর আমরা দেখেছি। শারীরিক নির্যাতনের প্রভাবে শিশুর প্রতিবন্ধিতা, ক্যান্সার, হৃদরোগ কিংবা মাইগ্রেনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাছাড়া মানসিকভাবে শিশু হতাশা ও বিষণ্নতায় ভুগতে পারে, যা তাকে আত্মহত্যার দিকেও ঠেলে দিতে পারে।

বলা হয়, ঝিকে মেরে বউকে বোঝানো। সেটা প্রবাদের কথা। কিন্তু বাস্তবে ঝি, সন্তান কিংবা কাজের মেয়েকেও আপনি মারতে পারেন না। তবে ইতিবাচক বিষয়ে শিশুকে যুক্ত করে যদি স্ত্রী বা বড়দের বোঝানো যায় সেটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। শিশু বলে তাদের মারা মানে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা এবং এটি শিশু অধিকারেরও লঙ্ঘন। বাস্তবেও অভিযোগ রয়েছে, অভিভাবক কিংবা শিক্ষকরা নানা চাপে থাকেন বলে তার ক্রোধ শিক্ষার্থী বা সন্তানের ওপর ঝাড়েন। এটা কতটা ভয়াবহ তা অকল্পনীয়। অসহায় বলে শিশুদের শাস্তি দিয়ে যখন আপনি রাগ প্রকাশ করতে চাইছেন, সেটা বড় দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে এবং আপনার সন্তান কিংবা শিশু শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নষ্টেরও কারণ হতে পারে।

কোনো অভিভাবক কিংবা শিক্ষক নিশ্চয়ই বলবেন না, শিশুদের তাঁরা ভালোবাসেন না। তাঁরা যদি শিশুদের ভালোবাসেন এবং তাদের ভালো চান তবে তাদের সঙ্গে আচরণও সেরূপ হওয়া প্রয়োজন। শিশুদের শেখানোর জন্য তাই মারধর কিংবা বকাঝকার চেয়ে ভালোবাসা দিয়েই তাদের জয় করার দিকে মনোযোগী হওয়া জরুরি। মার খাওয়ার ভয়ে যখন শিশু কোনো কিছু শিখবে, তখন সে শিখন কতটা স্থায়ী হবে? অথচ আদর দিয়ে যদি শিশুকে বোঝানো যায়, এটি শেখা জরুরি এবং শিশুটি যদি সেই উপলব্ধি থেকে মনোযোগ দিয়ে বুঝে শেখে, তা নিঃসন্দেহে স্থায়ী হবে। শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতার কথা বলে শিশুর ওপর শারীরিক নিপীড়ন কিংবা মানসিক আঘাত দেওয়া যাবে না।

বলাবাহুল্য, ৬৫টি দেশ আইন করে সব ক্ষেত্রে শিশুদের শাস্তি নিষিদ্ধ করেছে। সেখানে কেউ শিশুর ওপর চড়াও হলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। সেটা শিক্ষক কিংবা মা-বাবা যেই হোন। তবে এ বছর শিশুর শারীরিক শাস্তি বিলোপে পালিত দিবসটির দুই দিন আগে অর্থাৎ ২৮ এপ্রিল প্রকাশিত সেভ দ্য চিলড্রেনের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বিশ্বব্যাপী মাত্র ১৪ শতাংশ শিশু শারীরিক শাস্তি থেকে আইনগতভাবে সুরক্ষিত। এর মধ্যে যে বাংলাদেশ নেই, তা স্পষ্ট। বাংলাদেশে ‘শিশুরাই সব’ নামের প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আইনত নিষিদ্ধ হলে শারীরিক শাস্তি কমতে থাকে। এ ক্ষেত্রে সুইডেনের উদাহরণ দিয়েছে তারা। সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সবক্ষেত্রে শিশুর ওপর শাস্তি নিষিদ্ধ করা চাই। একই সঙ্গে শিশুকে শাস্তি দেওয়ার ব্যাপারে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গিরও পরিবর্তন জরুরি। শিশুকে শাস্তি দিলে সে যে কষ্ট পায় তা যে আমরা অনুভব করি। শিক্ষক যাঁরা পড়ান, তাঁদের শিশুদের সঙ্গে আচরণে বিস্তর প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে অভিভাবক ও সমাজের জনসচেতনতার জন্যও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া চাই। শিশুরা আমাদের ভবিষ্যৎ। তাদের সুরক্ষিত রাখা এবং সুন্দর পরিবেশে বেড়ে ওঠার দায়িত্ব আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে।

সমকালে প্রকাশ: ৩০ এপ্রিল ২০২৩

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।