Mahfuzur Rahman Manik
নদী বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে
মার্চ 24, 2010


নদী বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে
মাহফুজুর রহমান মানিক
ঢাকার সাথে বুড়িগঙ্গার সম্পর্ক ওতপ্রোতভাবে জড়িত। চারশ বছরের ঢাকা বুড়িগঙ্গাকে নিয়েই। ঢাকা বাংলাদেশের রাজধানী-এ বাক্যটির সাথে আরেকটি বাক্য চলে আসে-ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। বুড়িগঙ্গার সাথে ঢাকা, এটি বাস্তব। এখন যদি বলা হয় দশ বছর পর এটি হবে ইতিহাস। (অর্থাৎ তখন বলা হবে দশ বছর আগে ঢাকা বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত ছিলো। এখন যেমন বলে এক সময়ের প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। অর্থাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এখন আর প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নয়, আগে ছিলো।) কেউ বিশ্বাস করবে? আমার মনে হয় বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচালের আগে, কথাটি শুনে আতকে ওঠবেন। আতকে ওঠারই কথা। কারণ আমরা চাই না বুড়িগঙ্গা হারিয়ে যাক। এটি স্থান নিক ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু বাস্তবতা অত্যন্ত করুন। এই মুহূর্তে কেউ বুড়িগঙ্গা দেখতে যান। সনাক্তই করতে পারবেন না এটি নদী না অন্য কিছূ। বিশেষ করে কামরাঙ্গীর চরে বুড়িগঙ্গার তীরে প্রথম কেউ গেলে ভাববে এটি হয়তো খাল নয়তো নর্দমা। একদিকে এর সীমানা সংকীর্ণ হয়ে গেছে, দখলদাররা এর তীরে তাদের প্রভূত্ব স্থাপন করেছে। অন্যদিকে এর পানি দূষিত হয়ে কুচকুচে কালো হয়ে গেছে, চারদিকে ভীষণ দূর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। অর্থাৎ নদী বলার মতো দৃশ্য বিদ্যমান নেই। এ মৃতপ্রায় বুড়িগঙ্গাকে বাঁচাতে অনেকদিন ধরে আন্দোলন করছেন পরিবেশবাদীরা। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বুড়িগঙ্গা বাঁচাও আন্দোলনের অন্যতম। বুড়িগঙ্গা বাঁচানোর আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে। গত বছর এ নিয়ে গণমাধ্যম এবং সুশীল সমাজে আলোচনার ঝড় উঠে। শুধু দাবী দাওয়া পেশ আর মানব বন্ধনই নয়, আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে এটি। অবশেষে টনক নড়ে সরকারের। শুধু বুড়িগঙ্গাই নয়, ঢাকার চারপাশে অবস্থিত অন্যান্য নদী তুরাগ, বালুও শীতলক্ষাকে বাঁচাতে উদ্যোগ নেয়। প্রাথমিক অবস্থায় নদীকে দখলমুক্ত করতে চেষ্টা করে। সে ধারাবাহিকতায় এ বছরের ৬ জানুয়ারি বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে বর্জ্য ও পলিথিন অপসারণের কাজ শুরু হয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে বুড়িগঙ্গা নদীর বাদামতলীর দ্বিতীয় বুড়িগঙ্গা সেতু হতে শ্যামবাজার পর্যন্ত ৪ কিলোমিটার এলাকার বর্জ্য অপসারণের কাজ চলছে। ৬ জানুয়ারি চার মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী ও বিশিষ্ট নাগরিকদের উপস্থিতিতে এ কাজ শুরু হয়। সেদিন বুড়িগঙ্গা ছিলো উতসবের নগরী। হাজার হাজার মানুষ এ কাজকে স্বাগত জানাতে নদীর তীরে ভীড় করে। কেউ অবার নৌকায় যোগ দেয় নদীর মাঝখানে। এভাবে সকলের হাততালির মাধ্যমে কাজের উদ্বোধন হয়। তিন মাসের প্রজেক্টে এ কাজ চলছে। এর আগে অদালতের নির্দেশে বলা চলে সরকার নদীর তীরের অবৈধ দখলদারিত্ব উচ্ছেদে ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলো। সে কার্যক্রম কতটা সফল হয়েছে বলা যায় না। তবে বাস্তবতা দেখে সে কার্যক্রম মুখথুবড়ে পড়েছে বললেও অত–্যক্তি হবে না। সেখানে অবৈধ দখলদারিত্বতো উচ্ছেদ হয়নি, বরং নির্মিত হয়েছে স্থায়ী অস্থায়ী দোকানপাট গুদামসহ অনেক কিছু। এখনো বুড়িগঙ্গাসহ অন্যান্য নদীর তীর ঘিরে রয়েছে নানা স্থাপনা, প্রতিষ্ঠান। শিল্প প্রতিষ্ঠান, কারখানা, দোকান, বসত বাড়ি এমনকি মসজিদ মদ্রাসাও। বুড়িগঙ্গার সীমানায় অনেকেই নিজের জমি দাবী করে সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছে। কেউ আবার বুড়িগঙ্গা ভরাট ও করছে এবং সেখানে স্থাপনাও তুলছে। এ অবস্থায় নদী কতটা অত্যাচারিত তা সহজেই অনুমেয়।সরকার বুড়িগঙ্গার তলদেশ থেকে বর্জ্য উত্তোলনের পদক্ষেপ নিয়েছে। ভালো কথা। এর মাধ্যমে এ বর্জ্যরে স্থায়ী সমান হবে কী-না। একেতো এ বর্জ্য উত্তোলনের ভালো ড্রেজার আমাদের নেই, তার ওপর আবার উত্তোলিত বর্জ্য কোথায় রাখবে তা নিয়ে রয়েছে টানা হেঁচড়া। আবার কোটি কোটি টাকা খরচ করে যে বর্জ্য উঠানো হচ্ছে, সে বর্জ্য যে আবার বুড়িগঙ্গায় পড়বে না তার নিশ্চয়তা কী। অর্থাৎ যে সমস্ত কারণে বুড়িগঙ্গার পানির এ দৈন্য দশা সেগুলো চিহ্নিত করে তার কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা না নিলে এ কার্যক্রম কোন কাজ দেবে না।বুড়িগঙ্গা এতোদিন পরিণত হয়েছে বর্জ্য ফেলার ভাগাড়ে। এটি ব্যবহৃত হচ্ছে ঢাকার প্রধান স্যুয়ারেজ বর্জ্যরে আউটলেট হিসেবে। শিল্প কারখানার বর্জ্য, মেডিকেলের বর্জ্য, ট্যানারির বর্জ্য, রাসায়নিক পদার্থ, হাটবাজারের পরিত্যক্ত সামগ্রী, শিশি, বোতল, পলিথিন ইত্যাদি ফেলার স্থান হিসেবে বুড়িগঙ্গা ব্যবহৃত হচ্ছে। এর ফলে নাব্যতা হারিয়েছে বুড়িগঙ্গা, পানি হয়েছে সীমাহীন দূষিত। এগুলো শক্ত হয়ে জমাট বেধে কয়েক স্তর তৈরি করেছে নদীর তলদেশে। নানা প্রকার রাসায়নিক পদার্থও ভর করেছে বুড়িগঙ্গায়। বর্তমানে সেখানে মাছ দূরে থাক, সামুদ্রিক কোন প্রাণী এমনকি উদ্ভিদও নেই। এ অবস্থায় বর্জ্য উত্তোলন আর নদী খননের কাজ সময়ের দাবী, অত্যন্ত আশাপ্রদ কার্যক্রম। এ বর্জ্য উত্তোলন আর নদী খননের কাজকে ফলপ্রসু করতে, স্রোতস্বীনী বুড়িগঙ্গার আসল চেহারা ফিরিয়ে দিতে কিছু কাজ করা জরুরী। প্রথম কাজটি হবে নদী দখল মুক্তকরণ। শুধু বুড়িগঙ্গার নয় ঢাকার চারপাশের অন্যান্য নদীর তীরে গড়ে ওঠা অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদকরণ। এ ব্যাপারে গত বছর যে কাজ হয়েছিলো তা থমকে দাঁড়ায়। ক্ষমতাবানরা তাদের আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে, বিশেষ করে রাজনৈতিক মদদপুষ্ট এসব শক্তিমানদের বিষয়ে অনেক সময় নাক গলাতে সরকার ও নারাজ। এ ব্যাপারে কঠোর পদক্ষেপ জরুরী। তাই প্রথমে নদীর সীমানা নির্ধারণ করে, সে সীমানায় অবস্থিত সকল অবৈধ স্থাপনা সরাতে হবে। এরপর এখন সরকার যে কাজটি করছে, অর্থাৎ বর্জ্য উত্তোলন। নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনতে এটি আবশ্যক। এ কাজের সফলতার জন্য, যে সব শিল্প কারখানার কারণে নদী দূষিত হচ্ছে, সেগুলোর প্রত্যেককে বর্জ্য ফেলার জন্য ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট তথা ইটিপি স্থাপনের জন্য বাধ্য করতে হবে। আজকের বুড়িগঙ্গা হাজারী বাগের যে চামঢ়া শিল্পের জন্য সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত-এ শিল্প কে দ্রুত সাভারে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। এ ছাড়া বর্জ্য ফেলার জন্য ডাম্পিং স্টেশন নির্মাণ করা, মহানগরীর মানুষের জন্য বিকল্প পানি ও পয়ঃনিস্কাশনের ব্যবস্থা করা জরুরী।এসব বিষয়ের বন্দোবস্ত না করে শুধু বর্জ্য উত্তোলন করে নদীর নাব্যতা ফিরিয়ে আনা কতটা সম্ভব তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। অবশ্য আশাপ্রদ, চমকপ্রদ খবর হলো প্রধানমন্ত্রী গত বছর পরিবেশ দিবসে ও সংসদে নদীর ব্যাপারে বিশেষ নজর দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। পরিবেশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মাথা ব্যথা যে কতটা তীব্র তা আমরা ডিসেম্বরের কোপেনহেগেন সম্মেলন থেকে ধরে নিতে পারি। যদিও অবশেষে সে সম্মেলন নোপেনহেগেন এ পরিণত হয়েছিলো। প্রধানমন্ত্রীর সে নজর আছে বলেই এখন কার্যক্রম চলছে এবং নদী রক্ষায় সরকারের অনেক কার্যক্রম হাতে রয়েছে। নদীর বিষয়ে রয়েছে শক্তিশালী টাস্কফোর্স। যারা নদীর সমস্যা নির্ধারণ করে তা হতে উত্তরণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে। বর্জ্য উত্তোলনের কাজ এ টাস্কফোর্সো নির্দেশ।বাংলাদেশকে বলা হয় নদীমাতৃক দেশ। অথচ শুধু ঢাকা শহরের নদীই নয়, গোটা দেশের নদীগুলোর অবস্থা শোচনীয়। দেশে মোট নদীর সংখ্যা ২১০টি। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক নদী ৫৪টি। একদিকে দেশের নদীগুলো আমাদের দ্বারাই দখল আর দূষণে যায যায় অবস্থা। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক নদীগুলোর পানি চুক্তি নিয়ে নিয়মিত দর কষাকষি করতে হচ্ছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সাথে। কিছুদিন ধরে তিস্তা পানি বন্টন বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর প্রাকক্কালে, গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। তিস্তা পানি বন্টনের দীর্ঘদিনের ঝুলন্ত বিষয়টির একটা দফারফা হওয়ার দিকে সবাই তাকিয়ে ছিল। কিন্তু এর পরেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানিয়ে দিলেন এ সফরে তিস্তা পানি বন্টন নিয়ে কিছু হচ্ছে না। ঢাকার সাথে যেমন নদীর সম্পর্ক তেমনি বিশ্বের অন্যান্য শহরের সাথে নদীর সম্পর্কে ও আমরা জানি। অবশ্য চীনের দুঃখ হোয়াংহোকে বাদ দিয়ে ল-নের কথা বললে সাথে সাথে আসবে এক সৌন্দর্য্যের আধার টেমস নদীর কথা। কানাডার টরেন্টোর কথা বললে আসবে চোখ জুড়ানো লেক অন্টারিওর কথা। আমেরিকার নিউইয়র্ক আর শিকাগো শহরের কথা বললে হার্ডসন নদী আর লেক মিশিগানের কথা বলতে কেউ ভুলবে না। অস্টোলিয়ার সিডনির মারো ডার্লিং নদীর কথা ও আমরা জানি। এগুলোর সাথে ঢাকার কথা বলরে বুড়িগঙ্গা আসবে ঠিকই কিন্তু সেটা আর নায়াগ্রার মত চোখ ধাঁধাঁনো হবে না। তুরাগ শীতলক্ষা আর বালুর কথা আসবে ঠিকই সেটি আর হবে না পর্যটক আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।আজকে সীমাহীন সংকটে মেগাসিটি ঢাকা। জানযট, জনসংখ্যা আর গাড়ির চাপে ঢাকা একদিকে যেমন ন্যুব্জ। আবার গ্যাস, বিদ্যুৎ আর পানির সংকটে সংকটাপন্ন। সে অবস্থায় নদীগুলো যদি নাগরিকদের শান্তি দিতো স্বস্তিতে দাড়ানোর পথ করে দিতো তাও সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত মানুষ একটু শান্তি পেত। অথচ বাস্তবতা হল এ নদীগুলো আজ বিলুপ্তির পথে। একশ্রেণীর মানুষের অত্যাচারে নদীগুলোর প্রাণ যায় যায়। ঢাকাকে জেনেছে এমন একজন পর্যটককে ধরি যিনি ঢাকার সাথে বুড়িগঙ্গাকে জেনে এসেছে, ঢাকায় আসার পর। বুড়িগঙ্গা দেখার পর তার কাছে বুড়িগঙ্গাকে ডাস্টবিন ছাড়া অন্য কিছু মনে হওয়ার কথা না। বুড়িগঙ্গার পানিকে আমরা যতই কুচকুচে কালো ও দুর্গন্ধময় কিংবা ব্যবহারের অযোগ্য বলি না কেন একশ্রেণীর মানুষ এ পানি দিয়ে জীবন ধারণ করছে। গোসল, খাওয়া হতে শুরু করে কাপড় ধোওয়া পর্যন্ত সকল আজ এ বুড়িগঙ্গার পানি দ্বারাই সম্পন্ন করছে। ফলে এ সব মানুষ যারা বুড়িগঙ্গার তীরে বাস করেন, সারা বছরই তারা নানা রকম রোগে ভুগে থাকে। খোঁচ পাচড়া, চামড়ার নানা রোগসহ পেটের পীড়ায় ভুগছেন। এদের বুড়িগঙ্গা ছাড়া কোন পথ নেই। এ অবস্থায় বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার অন্যান্য নদীগুলো বাঁছানো অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। এমনিতে বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ শিকার। তার উপর পরিবেশ বিপর্যয় আমাদের জন্য ভয়াবহ বিপদ ঢেকে আনতে পারে। সে পরিবেশ রক্ষায় নদীগুলো বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ঢাকার ক্ষেত্রে এটা চিরন্তন সত্য। ঢাকার নদীগুলো বাঁচলে ঢাকা বাঁচবে। ঢাকাকে বাঁচাতে সরকারের এ পদক্ষেপ গুলো অত্যন্ত ফরপ্রসু হওয়া চাই। এ ব্যাপারে স্থানীয় জনসাধারণের দায়িত্ব ও কম নয়। তাই ঢাকাকে বাঁচাতে মৃতপ্রায় নদীগুলো বাঁচাতে সকলকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে এগিয়ে আসতে হবে।
(দৈনিক ডেসিটিন ১৩ জানুয়ারি ২০১০)

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।