Mahfuzur Rahman Manik
তার 'আজিকার শিশু'
নভেম্বর 21, 2021

বেগম সুফিয়া কামালকে কেবল 'শিশুদের' ফ্রেমে আবদ্ধ করা কঠিন। কারণ, তিনি শিশু-কিশোরসহ সবার জন্য লিখেছেন। সে কাজের ব্যাপ্তিও ছিল অনেক বিস্তৃত। তারপরও তিনি শিশুদের। কারণ সবাই চাইলেও শিশুদের হয়ে উঠতে পারেন না। তিনি পেরেছেন। তবে বেগম সুফিয়া কামালের প্রতিভা ও তার যাপিত জীবন ছিল বিস্ময়কর। শতবর্ষেরও আগে (১৯১১) জন্ম নেওয়া এ মহিয়সী নারীর নিবিড় সাহিত্য চর্চা, সামাজিক আন্দোলনে ভূমিকা আর নারী জাগরণের অবদানও নিঃসন্দেহে গবেষণার বিষয়। ১৯৯৯ সালের এই দিনে মৃত্যু পর্যন্ত এক দীর্ঘ জীবনের সদ্ব্যবহার করে গেছেন বেগম সুফিয়া কামাল। তিনি কেবল সময়ের তুলনায় এগিয়েই ছিলেন না, বরং সময়কেও এগিয়ে নিয়েছেন।

এটা স্বতঃসিদ্ধ যে, শিশুদের নিয়ে লেখা কঠিন কাজ। শিশুতোষ লেখার জন্য শব্দচয়ন, বাক্যগঠন ও বিন্যাসে বিশেষ মনোযোগী হওয়া জরুরি। আরও জরুরি শিশুর মনস্তত্ত্ব বোঝা। বেগম সুফিয়া কামালের শিশুতোষ রচনায় আমরা এর সবক'টির উপস্থিতি দেখি। তিনি একে একে বিখ্যাত সব শিশুতোষ ছড়া ও কবিতা লিখে গেছেন। ইতল বিতল, ছোটন ঘুমায়, প্রার্থনা প্রভৃতি ছড়া কবিতা আজও কেবল প্রাসঙ্গিকই নয়, বরং এখনও শিশু-কিশোরদের মুখে মুখে। তার হাত দিয়ে শিশুতোষ যেসব লেখা প্রকাশ হয়েছে, সেসব রচনা বেগম সুফিয়া কামালকে বাঁচিয়ে রাখবে। বলাবাহুল্য বেগম সুফিয়া কামালের লেখার মুনশিয়ানা এর বাইরেও বিস্তৃত সমানতালে। সাঁঝের মায়া, মায়া কাজল, মোর যাদুদের সমাধি পরে, কেয়ার কাঁটা, একাত্তরের ডাইরি ইত্যাদি বিখ্যাত গ্রন্থ তার হাতে সৃষ্টি।

বেগম সুফিয়া কামাল নবাবী ঐশ্বর্যের মাঝে জন্মগ্রহণ করলেও তিনি ছিলেন ব্যতিক্রম। তাদের পরিবারে বাংলা শিক্ষার ব্যবস্থা না থাকলেও মায়ের উৎসাহ ও সহায়তায় মামার প্রসিদ্ধ লাইব্রেরি থেকে বই পড়তেন এবং বাংলা শেখার চেষ্টা করেছেন। তার ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় তিন সফল। শিশুকাল থেকেই তিনি সকল বৈরী পরিবেশ উতরে এসেছেন। এমনকি ১৩ বছর বয়সে মামাতো ভাইয়ের সঙ্গে বিয়ের পরও তিনি দমে যাননি। বরং স্বামীর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণায় তিনি এগিয়ে গেছেন। তার লেখালেখিও চলেছে সমানতালে। তার জীবনে মাঝে মাঝেই সংকট এসেছে। স্বামী হারিয়েছেন। কিন্তু কাজ থেমে থাকেনি। তিনি তার যোগ্যতা ও কর্মগুণে যেমন শিক্ষকতার চাকরি পেয়েছিলেন, তেমনি পেয়েছিলেন ওই সময়ের বড় কবি-সাহিত্যিকদের সান্নিধ্য। কবি আব্দুল কাদির, কবি খান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন, কবি জসীমউদ্‌দীন, কাজী নজরুল ইসলাম, সাদত আলি আখন্দ, মাহবুব-উল-আলম, আবুল ফজল প্রমুখ কবি-সাহিত্যিকদের সান্ত্বনা ও উৎসাহ তাকে নতুন প্রেরণা ও পথ দেখিয়েছে।

বেগম সুফিয়া কামাল কথা ও কাজ উভয়ই করে দেখিয়েছেন। শিক্ষাবঞ্চিত অসহায় মা ও শিশুদের কল্যাণে তিনি নিজেকে যেমন নিয়োজিত করেন, তেমনি অনগ্রসর নারীকে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে তার কাজও অবিস্মরণীয়। তার চেয়ে স্মরণীয়, দাঙ্গার সময় মানবসেবার তার অবদান। দেশ বিভাগের পর ঢাকায় এসে তিনি এসব কাজে আরও অধিক পরিমাণে আত্মনিয়োগ করেন, যা আমরা দেখি বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে-পরেও।

বেগম সুফিয়া কামালের অনন্য কর্ম তাকে যেমন মহৎ বানিয়েছে, তেমনি শিশুদের জন্য তার কাজও অবিস্মরণীয়। শিশুদের লেখার কথা যেমন বলেছি, তেমনি শিশু আন্দোলনের ক্ষেত্রেও তার অনন্য অবদানের বিষয়টিও উপেক্ষা করা যায় না। অবিভক্ত বাংলার শিশু সংগঠন 'মুকুল ফৌজ'-এর আদলে ১৯৫৬ সালে তার বাসভবনেই গঠিত হয়েছিল শিশু সংগঠন 'কচি কাঁচার মেলা'। 'চাঁদের হাটে'র সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন।

কাকতাল বটে, তার চলে যাওয়ার এই দিন অর্থাৎ ২০ নভেম্বর জাতিসংঘের উদ্যোগে পালিত হয় বিশ্ব শিশু দিবস। এ বছর শিশু দিবসের প্রতিপাদ্য এ বেটার ফিউচার ফর এভরি চাইল্ড অর্থাৎ প্রতিটি শিশুর জন্য উন্নত ভবিষ্যৎ। শিশুদের ভালো ভবিষ্যৎ গড়ার দায় আমাদের সবার। এখানে সম্মিলিত প্রচেষ্টা জরুরি। আজকের শিশু যখন আগামীর ভবিষ্যৎ সেই শিশুদেরও সেভাবে গড়ার বিষয় রয়েছে। তবেই আমাদের ভালো ভবিষ্যৎ আসবে। বেগম সুফিয়া কামাল তার 'আজিকার শিশু' কবিতায় যথার্থই বলেছেন- 'তোমরা আনিবে ফুল ও ফসল পাখি-ডাকা রাঙা ভোর/জগৎ করিবে মধুময়, প্রাণে প্রাণে বাঁধি প্রীতিডোর'।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।