Mahfuzur Rahman Manik
ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি ‘সংঘর্ষ’ নাকি বর্বরতা
এপ্রিল 9, 2023

মূল: বেলেন ফার্নানদেজ

ভাষান্তর: মাহফুজুর রহমান মানিক

আবারও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অনিয়ন্ত্রিত বর্বরতা চালাচ্ছে ইসরায়েল। পশ্চিমা করপোরেট সংবাদমাধ্যম যদিও একে দেখছে ‘সংঘর্ষ’ হিসেবে। তথাকথিত এই সংঘর্ষের সর্বশেষ রাউন্ড ইসরায়েলি পুলিশ তখন ছুড়েছে, যখন জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনিরা মুসলিমদের পবিত্র রমজান মাসের ইবাদত করছে। তাদের আক্রমণে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ইসরায়েলি বাহিনীর আবারও রাবার বুলেট, লাঠিসোটা, গ্রেনেড এবং টিয়ার গ্যাসের আক্রমণে কয়েকশ ফিলিস্তিনি গ্রেপ্তার ও আহত হয়েছে। বিনিময়ে পুলিশ সামান্যতম আঘাতের শিকার হয়েছে।

রমজান মাসে গত বুধবার টানা দ্বিতীয় রাতের মতো পবিত্র আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে অভিযান চালায় ইসরায়েলি পুলিশ। অভিযানকালে তারা ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের লক্ষ্য করে শব্দবোমা ও রাবার বুলেট ছোড়ে। অভিযানকে কেন্দ্র করে ইসরায়েলি পুলিশের সঙ্গে ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের আবার সংঘর্ষ হয়।
ভিডিওতে দেখা যায়, নামাজ আদায়ের জন্য আসা ফিলিস্তিনি মুসল্লিদের জোর করে মসজিদ থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করছে ইসরায়েলের সশস্ত্র পুলিশ। ইসরায়েলি পুলিশের সর্বশেষ দফার এ অভিযানের ঘটনায় ছয় ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি রেড ক্রিসেন্ট। স্পষ্টত জেরুজালেমে কেবল সহিংসতা চালিয়েই সন্তুষ্ট নয় ইসরায়েল। তারা গাজা উপত্যকা এবং দক্ষিণ লেবাননে রকেট ছোড়ার পর বিমান হামলাও শুরু করেছে।

ইসরায়েলি-ফিলিস্তিনি সংঘর্ষের পূর্ববর্তী সব উদাহরণের মতো সংবাদমাধ্যমের এই ধরনের পরিভাষা ব্যবহারে সহিংসতার ক্ষেত্রে ইসরায়েলের একচেটিয়া দায় অগ্রাহ্য করে এবং এই সত্যটিও অস্বীকার করা হয় যে, ইসরায়েল সংঘর্ষে ফিলিস্তিনি প্রতিপক্ষের চেয়ে ব্যাপক হারে হত্যা, পঙ্গু ও আহত করে। এটি এই বাস্তবতাকেও অস্বীকার করে যে, ফিলিস্তিনিদের ওপর সহিংসতা, তাদের জাতিগত নির্মূল, ফিলিস্তিনি ভূমি দখল এবং গণহত্যার পর্যায়ক্রমিক অপরাধ প্রায় ৭৫ বছর বয়সী ইসরায়েলি দখলনীতির কারণেই ঘটছে। সমসাময়িক ইসরায়েলি সামরিক হামলা দেখলেই ইসরায়েলি বর্বরতা স্পষ্ট হবে। ২০১৪ সালে ‘অপারেশন প্রোটেক্টিভ এজ’ নামে ইসরায়েল ৫৫১ শিশুসহ গাজা উপত্যকায় ২ হাজার ২৫১ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া ২২ দিনের ‘অপারেশন কাস্ট লিড’-এ গাজায় প্রায় ১৪০০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। তখন মাত্র তিন ইসরায়েলি বেসামরিক ব্যক্তি মারা গেছে। ২০১৮ সালেও সংঘর্ষ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তখন গাজা সীমান্তে বিক্ষোভের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী কয়েকশ ফিলিস্তিনিকে হত্যা এবং হাজার হাজার আহত করে। ২০২১ সালের মে মাসে ‘অপারেশন গার্ডিয়ান অব দ্য ওয়াল’ নামে ১১ দিনের ইসরায়েলি তাণ্ডবে আড়াই শতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে প্রায় এক-চতুর্থাংশ ছিল শিশু। সর্বশেষ যে অপারেশনের শুরু হলো, সেটিকেও আল-আকসা মসজিদে ‘সংঘর্ষ’ হিসেবে দেখা হবে?

কিছু সংবাদমাধ্যম ইসরায়েলি এবং ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বর্তমান রক্তপাতের বিষয়টি যেভাবে চিত্রিত করছে, তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ রয়েছে। তাদের এই ভূমিকা শেষ পর্যন্ত রক্তপাতের ক্ষেত্রে ইসরায়েলের প্রধান ভূমিকাকে গৌণ করে তোলে। ইসরায়েলি বর্বরতাকে যেভাবে ‘সংঘর্ষ’ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে, সেটির ভাষাগত বা নৈতিকভাবে সমান প্রতিশব্দ খুঁজে পাওয়া কঠিন। কেউ একজন বন্দুক দিয়ে হরিণ শিকার করলে সে ঘটনা নিশ্চয় বন্দুকের সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’ হিসেবে গ্রহণযোগ্য হবে না। ঠিক যেমন একজন মানুষের ঘাড় এবং অস্ত্রের মধ্যকার ‘সংঘর্ষ’ গ্রহণযোগ্য নয়।

আফগানিস্তানের কুন্দুজে একটি হাসপাতালে ২০১৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাণঘাতী বোমা হামলাকে কেউ চিকিৎসা সুবিধাসংবলিত হাসপাতাল এবং একটি এসি-১৩০ গানশিপের মধ্যে ‘সংঘর্ষ’ হিসেবে বর্ণনা করবে না।

কিন্তু স্পষ্টতই অনৈতিক হলেও, ইসরায়েলকে বাঁচানো কিংবা তার দোষ ঢাকার মতো বর্ণনা পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমের নতুন কিছু নয়। এর বেশিরভাগই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তরিক সমর্থনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, বিশেষ করে ইসরায়েলি দৃষ্টিভঙ্গির জন্য, যেখানে নির্যাতিতদের শিকার হিসেবে এবং হত্যাকারীদের আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করা হয়। সম্ভবত ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা শেষ পর্যন্ত একটি বড় ‘সংঘর্ষ’ ছাড়া আর কিছুই ছিল না! যেটি হাজার হাজার ফিলিস্তিনির গণহত্যার কারণ এবং যে কারণে পাঁচ শতাধিক ফিলিস্তিনি গ্রাম ধ্বংস হয়েছে। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ফিলিস্তিনিদের সন্ত্রাসবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য ইসরায়েলের দীর্ঘমেয়াদি প্রচারণাকে সংবাদমাধ্যম যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে চলেছে।

দৃশ্যত এখনও ফিলিস্তিনিদের ইসরায়েলিদের মতো মানবতার সমান স্তরে তারা স্থান দিচ্ছে না। উদাহরণস্বরূপ, এই বছরের ফেব্রুয়ারিতে দ্য নিউ ইয়র্কার ম্যাগাজিনের লরেন্স রাইট একটি ভিডিও টুইট করেছেন, যেখানে ইসরায়েলি সৈন্যরা ফিলিস্তিনি শান্তিবাদী কর্মী ইসা আমরোকে ধাক্কা দিয়ে লাথি মারছে। যখন রাইট অধিকৃত পশ্চিম তীরের শহর হেব্রনে তাঁর সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন, তখন এ ঘটনা ঘটেছে। দ্য নিউ ইয়র্কার লেখক সেখানে বলেছেন: ‘আমি চিন্তা না করে পারি না, এই পেশাটিকে কতটা অমানবিক বানানো হচ্ছে, যেখানে অভিযুক্ত তরুণ সৈন্যরা তাদের ওপর চড়াও হচ্ছে।’

অন্য কথায়, ইসরায়েলি সৈন্যরা নৈতিক অবক্ষয় এবং অমানবিকতার শিকার যখন ফিলিস্তিনিরা আসলেই প্রথম সারির মানুষ হতে পারে না।

এখন, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী যেহেতু জেরুজালেম ও গাজায় অমানবিক আচরণ করছে। তাদের অমানবিক হওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ‘সংঘর্ষ’ ব্যবহারের মাধ্যমে কেবল এই ধারণাটিকেই বৈধতা দেয় যে, ইসরায়েল তার সহিংসতায় মৌলিকভাবে ন্যায্য। ন্যায্যভাবেই ইসরায়েল ‘ইট মারলে পাটকেল খেতে হয়’– এই নীতিতে আক্রমণ করছে এবং এটি দুটি সমান শক্তিসম্পন্ন পক্ষের মধ্যকার প্রতিযোগিতা মাত্র।

২০২২ সালের আগস্ট মাসে গাজায় ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর তিন দিনের আক্রমণে ১৬ শিশুসহ কমপক্ষে ৪৪ ফিলিস্তিনি নিহত হয়। ২০২১ সালের মে মাসে ‘অপারেশন গার্ডিয়ান অব দ্য ওয়াল’-এর পর থেকে এটি সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী পর্ব। আগস্টের ঘটনায় কোনো ইসরায়েলি নিহত হয়নি। তবুও পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম একে ‘সংঘর্ষ’ বলবে? এবং তারা নিজেদের কর্তব্যের অংশ হিসেবে এক শ্বাসরুদ্ধকর প্রতিবেদন দাঁড় করিয়ে ফেলেছিল। আমি সেই সময়ে আলজাজিরার জন্য একটি নিবন্ধে উল্লেখ করেছি, কেমব্রিজ অভিধানের অনলাইন সংস্করণ সন্ত্রাসবাদকে সংজ্ঞায়িত করেছে ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে হিংসাত্মক পদক্ষেপের হুমকি’ হিসেবে। যতবার আমরা নিজেদের মনে করিয়ে দিই যে, ইসরায়েল আক্ষরিক অর্থে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছে, সম্ভবত তত তাড়াতাড়ি আমরা ‘সংঘর্ষের’ এসব আলোচনা বন্ধ করতে পারি।

সমকালে প্রকাশ ৮ এপ্রিল ২০২৩

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।