Mahfuzur Rahman Manik
বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে চল্লিশের দশকের সাম্প্রদায়িকতা ফিরিয়ে আনতে চায়-অমর্ত্য সেন
জানুয়ারি 10, 2021

অমর্ত্য সেন নোবেল বিজয়ী বাঙালি অর্থনীতিবিদ। সম্প্রতি তিনি ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এনডিটিভির সঙ্গে অনলাইনে ও পিটিআইর সঙ্গে ই-মেইলে সাক্ষাৎকার প্রদান করেছেন। সেখানে তার বাড়ির সীমানা, পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন, বিজেপির রাজনীতি ও ভারতের কৃষক আন্দোলন নিয়ে কথা বলেন। সাক্ষাৎকার দুটি ঈষৎ সংক্ষেপে ইংরেজি থেকে ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

আপনার শান্তিনিকেতনের বাড়ি 'প্রতীচী'র সীমানায় বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি ঢুকে গেছে বলে সম্প্রতি অভিযোগ করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

অমর্ত্য সেন: আসলে এ ব্যাপারে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে একজন অর্থনীতিবিদ হিসেবে আমি অর্থনীতির কথা বলতে পারি। করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকট আমরা দেখছি। এর মধ্যে আমার বাড়ি নিয়ে কী বলব? ৮০ বছর আগে ওই জায়গাটি লিজ হিসেবে নেওয়া হয়েছিল। এখন এসে বলা হচ্ছে, লিজে সমস্যা আছে। লিজের বাইরেও আমার বাবা আরও কিছু প্লট কিনেছিলেন। তারা যে জনসমক্ষে বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছে, তার আগে আমাকে কোনো চিঠি দেয়নি। আমার সঙ্গে কোনো কথাও বলেনি।

তার মানে আপনি বলতে চাইছেন, আপনার বাড়ি 'প্রতীচী'র ব্যাপারে এত বছরেও বিশ্বভারতী কোনো লিগ্যাল নোটিশ বা চিঠি দেয়নি বা কোনোভাবে জানায়নি?

অমর্ত্য সেন: না। আমার বাবা মারা গেলেন। এর পর আমার মা। লিজ নিয়ে তাদের সঙ্গে অনেক আগে কথা হয়েছে। স্বাভাবিক কথাবার্তা। তারা মিডিয়াতে বলেছে, আমি আরও অনেক জমি নিয়েছি। জমির ব্যাপারে কোনো সমস্যা নেই। কারণ এর সব কাগজপত্র রয়েছে। কিন্তু তারা আমার সঙ্গে কথা না বলে মিডিয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করেছে। শান্তিনিকেতনের নিজস্ব ঐতিহ্য ও উপাচার্যের আচরণের মধ্যে বেশ পার্থক্য রয়েছে। আমি এ বিষয়ে মন্তব্য করতে পারতাম। কারণ, তিনি পশ্চিমবঙ্গের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণের অংশ হিসেবেই দিল্লির কেন্দ্রীয় সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায়িত হয়েছেন। বিজেপি আমাকে মানুষ হিসেবে নীচু করছে। সত্যটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ভালো করেই জানে। সামনে নির্বাচন আসছে। এর মধ্যে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিষবাষ্প ছড়ানোর এজেন্ডা থাকতে পারে। ১৯৪০-এর দশকে আমরা ঢাকা ও কলকাতায় বাংলার সাম্প্রদায়িকতার কদর্য রূপ দেখেছি।

আপনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া দেখেছেন। তিনি আপনাকে সমর্থন করেছেন। এমনকি আপনাকে একটি চিঠিও লিখেছেন।

অমর্ত্য সেন: যারা আমার প্রতি সমবেদনা প্রদর্শন করেছেন, তাদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আমার প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন। তিনি আমাকে যে চিঠি দিয়েছেন, তা আমাকে স্পর্শ করেছে। তাকে আমি ধন্যবাদ জানাই।

আপনি পশ্চিমবঙ্গের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছেন। সেখানে জয় পেতে বিজেপি কী না করছে! রাজ্য এবং রাজ্যের বাইরে যা হচ্ছে তার লক্ষ্য কিন্তু একটাই। ২০২১ সালের নির্বাচনে বিজেপি নিয়ন্ত্রণ চাইছে, আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও লড়াইয়ে রয়েছেন। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

অমর্ত্য সেন: হ্যাঁ, লড়াই আমরা দেখতে পাচ্ছি। বিজেপি ভারতের ক্ষমতাসীন দল। তারা পশ্চিমবঙ্গের নিয়ন্ত্রণ চাইছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে। বাংলায় আমরা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছি। কলকাতা দাঙ্গা ভয়ানক ছিল। এখন সেই সাম্প্রদায়িকতা নতুন করে ছোট আকারে শুরু হয়েছে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে অবিভক্ত বাংলার প্রাদেশিক আইনসভায় কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলেও তারা সরকার গঠন নিয়ে এক ধরনের সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িক আচরণ প্রদর্শন করে। ১৯৪৬ সালে হয় কলকাতার দাঙ্গা। এ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় অনেক হিন্দু-মুসলিম মারা যায়। সেখানে এতটাই রক্ত ঝরে, যা আমি আর দেখিনি। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পরই ১৯৫২ সালে সাম্প্রদায়িক কারণেই ভাষা আন্দোলনের মতো ঘটনা ঘটে। এগুলো সাম্প্রদায়িকতারই প্রকাশ। প্রশ্ন হলো বিজেপি নিয়ে। আমরা তাদের সাম্প্রদায়িক রূপ ইতোমধ্যে দেখেছি। ক্ষমতায় কারা আসবে, সেটা নয় বরং আমি মনে করি, কাদের মাধ্যমে এই সাম্প্রদায়িকতার অবসান ঘটবে- সেটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এখানেই আমাদের অগ্রাধিকার সেট করতে হবে।

আপনি সাম্প্রদায়িকতার কথা বলেছেন। লাভ জিহাদ নিয়ে আপনার মন্তব্য কী? 'লাভ জিহাদ' নামে বিয়ের মাধ্যমে হিন্দু মেয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিতকরণ বন্ধে কয়েকটি রাজ্যে আইন হয়েছে।

অমর্ত্য সেন: লাভ জিহাদ আইন হলো মানুষের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা। জীবনযাপনের অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। এ আইনে সেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমাদের দেশে যে কোনো মানুষ নিজের ধর্ম বদলে অন্য ধর্ম গ্রহণ করতে পারেন। সেটা সংবিধানস্বীকৃত। তাই আইনটি অসাংবিধানিক। অবিলম্বে এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপ চাওয়া উচিত। এ আইনকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করার জন্য সুপ্রিম কোর্টে মামলা করা উচিত। এটা খুবই বড় বিষয়। ভারতের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত নেই। আকবরের সময় নিয়ম হয়েছিল- যে কোনো ব্যক্তি যে কোনো ধর্ম গ্রহণ করতে পারেন এবং যে কোনো ধর্মে বিয়ে করতে পারেন। ফলে আমাদের দেশে সেই সংস্কৃৃতি রয়েছে। আমাদের সংবিধানে ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার কথা খুব স্পষ্টভাবে বলা আছে। ফলে এমন আইন সংবিধানকেই অপমান করে। ক্রিমিনাল অ্যাক্ট অব লাভ জিহাদ বলা হচ্ছে। লাভ বা প্রেমের মধ্যে কোনো 'জিহাদ' নেই। ভিন্ন ধর্মের কাউকে ভালোবেসে বিয়ে করলে তার মধ্যে কোনো 'জিহাদ' থাকতে পারে না। তেমনই একটি ধর্ম ছেড়ে অন্য কোনো ধর্ম গ্রহণ করলেও কোনো সমস্যা নেই। এটা একটা রাজনৈতিক দল করছে। এর ফলে ভারতকে অপমান করা হচ্ছে। এটা ভারতের সংস্কৃৃতি নয়। আমার বিশ্বাস, আদালত এর জবাব দেবেন।

ভারতে কৃষক আন্দোলন দেখছি আমরা। এক মাসের ওপর এ আন্দোলন চলছে। কৃষকদের সমাধান কী হতে পারে?

অমর্ত্য সেন: এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে কৃষকের জীবন জড়িত। কৃষকরা ভারতের অর্থনীতিতে ভালোভাবেই অবদান রাখছে। আমার মনে হয় না, খুব দ্রুত তাদের সমস্যার সমাধান হবে। এ জন্য যথেষ্ট ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। পুরো বিষয়টার সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের স্বার্থ জড়িত। তা সত্ত্বেও কৃষকদের সঙ্গে আলোচনার সময় বাস্তববাদী হওয়া উচিত সরকারের। কৃষকদের নামমাত্র ক্ষতিপূরণ দিয়ে আশা করা যায় না যে, তারা আলোচনার টেবিলে বসবে। কৃষি আইনগুলো অবশ্যই সংশোধন জরুরি। তার আগে এ নিয়ে সঠিকভাবে আলোচনা প্রয়োজন। এটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এর সঙ্গে ভারতের অর্থনীতি এবং মানুষের খাদ্যের বিষয়টি জড়িত।

আপনি অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির কথা বলছেন। তার স্বরূপ কেমন হবে?

অমর্ত্য সেন: রাজনৈতিক দলই নিজেদের জন্য কাজ করবে, তবে প্রত্যেককে অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতা বর্জন করতে হবে। তা না হলে আমরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিংবা নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর যথার্থ উত্তরাধিকার হতে পারব না। সেক্যুলার দলগুলো বিস্তারিত কর্মসূচির সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করতে পারে। তবে প্রত্যেকেরই অভিন্ন নীতিমালা হবে অসাম্প্রদায়িকতা প্রত্যাখ্যান করা। সেক্যুলার রাজ্য গড়ার অঙ্গীকারে তৃণমূল কংগ্রেসের চেয়ে বাম দলগুলো যেন কোনো অংশেই পিছিয়ে না থাকে। অতীতে পশ্চিমবঙ্গ সাম্প্রদায়িকতার কারণে অনেক ভুগেছে। আমাদের ঐক্যের প্রতীক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যসাগর, স্বামী বিবেকানন্দ। এরা সবাই বাঙালি সংস্কৃতি লালন করেছেন। তাদের চেতনায় এমন বিষয় নেই, যাতে সমাজে একে অন্যের ওপর চড়াও হয়। কাজী নজরুল ইসলামও বাঙালি সংস্কৃতির একজন বড় নেতা। অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে বাঙালি সাম্প্রদায়িকতাকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছে।

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।