Mahfuzur Rahman Manik
কিংস পার্টিগুলোর সান্ত্বনা পুরস্কার
জানুয়ারী 4, 2024
student politics in private university

কিংস পার্টি অর্থ রাজার দল। তবে আমাদের মতো দেশে রাজা অস্তিত্বহীন হলেও ‘কিংস পার্টি’ রয়ে গেছে। ধারণা করা হয়, ক্ষমতাসীন দল কিংবা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় এসব দল তৈরি হয়। এদের অবস্থা দাঁড়ায় যেমনে নাচাও তেমনে নাচি ধরনের। স্বাভাবিকভাবেই হঠাৎ গজিয়ে ওঠা দলগুলোর জনসমর্থন বা ভিত্তি নেই।

ক্ষমতাসীনদের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি না থাকায় এবারের নির্বাচনে কিংস পার্টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে বলে ধারণা করা হচ্ছিল। কিন্তু নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, কিংস পার্টি ততই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলের কাছ থেকে আসনের ব্যাপারে কোনো ছাড় না পওয়ায় পার্টিগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়বে বলে অনেকে মনে করছেন। সোমবারের সমকালের প্রতিবেদনে যথার্থই এসেছে– ‘ঘোল খেল’ তিন কিংস পার্টি। দলগুলোর নাম দেখলেও বোঝা যায়, এগুলো আসলে বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে গঠিত। তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট (বিএনএম) এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)। দলগুলো নিবন্ধন পেয়েছে, তাও বেশিদিন হয়নি। তৃণমূল বিএনপির বয়স সেদিক থেকে কিছুটা বেশিই বলতে হবে; নিবন্ধন পেয়েছে ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ; বিএনএম এবং বিএসপি নিবন্ধন পেয়েছে একই দিনে; এ বছরের ১০ আগস্ট।

রাজনীতির মাঠে এদের অজ্ঞাতকুলশীল বললে আদৌ ভুল হবে না। অথচ এমন কিছু দল আছে, যারা বহু বছর ধরে রাজনীতিতে সক্রিয় থাকলেও নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন পায়নি। নির্বাচনের তপশিল ঘোষণার পর বিশেষভাবে তৃণমূল বিএনপি, বিএনএম ও বিএসপি– তিন দল ৩০০ আসনে মনোনয়ন দেওয়ার কথা বললেও শেষ পর্যন্ত দেখা যায় তিন দল মিলেও পুরো ৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। এই পার্টিগুলো যে হঠাৎ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে; যাদের সঙ্গে জনমানুষের কোনো যোগাযোগ নেই, তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে হয়তো ক্ষমতাসীন দলের সিদ্ধান্তে। আওয়ামী লীগ তাদের জন্য আসন ছেড়ে না দেওয়ার অর্থ হলো, দলগুলো আরও অপাঙ্‌ক্তেয় হয়ে যাওয়া। এ অবস্থায় তারা এককভাবে নির্বাচন করলে জামানত বাজেয়াপ্ত হওয়ার শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

কিংস পার্টি কথাটা এখানে বিগত ১/১১ সরকারের সময় চালু হলেও, এর আগের প্রতিটা সামরিক শাসনের সময় এদের দেখা গেছে। তবে এ দফায় মূলত গত তিনটি জাতীয় নির্বাচনের আগে এ ধরনের কিংস পার্টির উদ্ভব ঘটেছে। শক্তিশালী বিভিন্ন দলের বর্জনের মধ্যে এরাই বিরোধী দল দেখানোর জন্য কিংবা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখানোর ভরসা জোগায়।
এবার যে কিংস পার্টিগুলো এমন ধাক্কা খেল, তার পেছনে অবশ্য আরেকটা কারণ আছে। এবার নির্বাচনী খেলায় আমাদের মূলধারার কিছু রাজনৈতিক দলই কিংস পার্টি হয়ে উঠছে। তাই এখন এমন প্রশ্নও উঠছে, বিরোধী দল তাহলে কে হবে?

কিংস পার্টিগুলো নির্বাচনের আগে কিছুদিনের ভেলকি হয়ে অনেককে বিনোদিত করে বটে। তার পরও অনেকের জন্য হতাশার বিষয়, এক সময়কার প্রভাবশালী রাজনীতিকরা দলছুট হয়ে কীভাবে পুতুলের মতো কাজ করতে পারেন। এবারের নির্বাচনের আগে আমরা শুধু কিংস পার্টিই দেখছি না; কিংস জোটও দেখছি। মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের দল কল্যাণ পার্টিও কিংস পার্টি। দলটি নিবন্ধন পেয়েছিল ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে; ১/১১ সরকারের আমলে। সম্প্রতি এ দলের চেয়ারম্যান ‘যুক্তফ্রন্ট’ নামে নতুন জোটের ঘোষণা দিয়েছেন। কল্যাণ পার্টি ছাড়াও এ জোটে আছে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ এবং বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (মতিন)।

বাংলাদেশের জন্য কিংস পার্টি দুঃখজনক বাস্তবতা। দিন দিন আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থা যে সংকটের দিকে গেছে, তারই প্রমাণ এই ভুঁইফোঁড় দলগুলো। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় দল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জনগণ তার কাঙ্ক্ষিত দলকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে। প্রতিটি দলের নিজস্ব দর্শন; নির্বাচনী ইশতেহার থাকে। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে মানুষের মধ্যে জনসমর্থন আদায় করে দলগুলো। শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত দলগুলো ক্ষমতায় এলে রাষ্ট্রেরও স্থিতিশীলতা তৈরি হয়। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও দাঁড়াতে পারেন; কিন্তু দলের ভূমিকা রাষ্ট্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ফলে আমরা যখন কিংস পার্টির মতো ভুঁইফোঁড় দল দেখছি, যারা হঠাৎ উদয় হয়, যাদের জনগণের সঙ্গে সম্পর্ক নেই, দেশের মাটির সঙ্গে সংযোগ নেই বরং অন্যের জন্য শুধু ভূমিকা পালন করে কিংবা ক্ষমতাসীনদের অনুকম্পায় নির্বাচনে জিততে চায়, তারা রাষ্ট্র্রের জন্য অশনিসংকেত।

অবশ্য স্বস্তির বিষয়, বাংলাদেশের রাজনীতিতে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা কিংস পার্টিগুলো হালে পানি পায়নি। সে জন্যই আমরা দেখেছি, গত মাসের শেষ সপ্তাহে বিএনএমের মহাসচিব সাংবাদিকদের অনুরোধ করেছেন বিএনএমকে কিংস পার্টি না বলতে। নামের সঙ্গে কিংস পার্টি জুড়ে দিলে তারা নাকি দুঃখ পান। বিএনএম মহাসচিব দাবি করেছিলেন, তারা সরকারের কোনো সহযোগিতা বা পৃষ্ঠপোষকতায় দল করেননি। তবে তারা ঠিক নির্বাচনের আগে আগে এত দ্রুত নিবন্ধন কীভাবে পেলেন? মহাখালীর ‘ছোট কক্ষ’ থেকে গুলশানের ‘আলিশান’ কার্যালয়েই বা গেলেন কীভাবে?

আসন না পেলেও কিংস পার্টির নেতারা অবশ্য প্রকাশ্যে কিছু বলছেন না। তবে বলেছেন একজন, তিনি ক্ষমতাসীনদের দীর্ঘদিনের মিত্র এবং সে কারণেই গত নির্বাচনে তিনি সংসদ সদস্য হতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভান্ডারী। তিনি বলেছেন, এবার তাঁকে আসন না দেওয়ায় তাঁর ওপর অবিচার ও অন্যায় হয়েছে। কিংস পার্টিগুলো অবশ্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ থেকে আসন না পেলেও সান্ত্বনা পুরস্কার হিসেবে আশ্বাস পেয়েছে বলে একটি সংবাদমাধ্যম বলছে। অর্থাৎ দু-একটি আসনে তাদের প্রার্থীদের জেতাতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সহায়তা করা হবে। এ সান্ত্বনা নিয়েই আপাতত তাদের থাকতে হবে। জনসমর্থন না থাকলে আর জনগণের রাজনীতি না করলে এতেই তো তাদের ‘আনন্দের আর সীমা নাই’ অবস্থা হওয়ার কথা।

সমকালে প্রকাশ: ১৯ ডিসেম্বর ২০২৩

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।