Mahfuzur Rahman Manik
প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষার গোড়ায় গলদ
মার্চ 8, 2023

এক শিক্ষার্থীর ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পাওয়ার খবর তাঁর বাবার ফেসবুকে দৃষ্টিগোচর হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবেই অনেকে অভিনন্দন জানাচ্ছিলেন। পিতা ও সন্তান যখন অভিনন্দনে সিক্ত, তখনই জানা গেল– বৃত্তির ফল স্থগিত। ইতোমধ্যে অনেকে ছেলেমেয়ের কৃতিত্বে মিষ্টিও বিতরণ করেছেন, ধারণা করা যায়। উদযাপনের ওই সময়ে ফল স্থগিতের খবর অনেকের কাছে আনন্দের বদলে বেদনা হিসেবে উপস্থিত। অবশেষে বুধবার রাতে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীর অধিকাংশের ফলে নড়চড় না হলেও অনেক শিশুই যে চূড়ান্ত ফলে বাদ পড়েছে; তাদের মন খারাপের দায় কে নেবে?

বস্তুত বৃত্তির ফলে যে সমস্যা ছিল– মঙ্গলবার ফল প্রকাশের পরই তা আঁচ করা যায়। ফেসবুকে মারফতেই জানা যায়, এক শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ না নিয়েই বৃত্তির জন্য মনোনীত হয়। বুধবার সমকালে প্রকাশিত প্রতিবেদনে আরও জানতে পারি, কোথাও শ্রেণিকক্ষের ১-১০ রোলধারী বৃত্তি না পেলেও অন্যরা পেয়েছে। অর্থাৎ যাদের বৃত্তি পাওয়ার কথা, তারাই পায়নি। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, কারিগরি ত্রুটির কারণে ফল স্থগিত করা হয়েছে। কোডিংয়ে ত্রুটির কারণে নাকি ফলে এই হযবরল অবস্থা। কারিগরি ত্রুটি কিংবা কোডিং যা-ই বলা হোক; এখানে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলা স্পষ্ট। শিশুদের এ পরীক্ষার বিষয়টি প্রশাসন গুরুত্বের সঙ্গে নিলে এমন ভুল হওয়ার কথা নয়। শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ না করেও কীভাবে বৃত্তিপ্রাপ্ত হলো? পরীক্ষায় অংশ না নিলে তার নাম উপস্থিতির শিটে আসার কথা নয়। তা ছাড়া ফল তৈরি হওয়ার পর অভ্যন্তরীণভাবে যাচাই-বাছাই করা ছাড়া প্রকাশের মধ্যেও দায়িত্বহীনতা স্পষ্ট।

মূলত শিশুদের এ বৃত্তি পরীক্ষার গোড়ায়ই রয়েছে গলদ। পিইসি বাদ হওয়ার পর গত বছরের ২৮ নভেম্বর হঠাৎ বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন। তখন আমি সমকালেই এক নিবন্ধে লিখেছিলাম– ‘হুটহাট সিদ্ধান্তের বৃত্তি পরীক্ষা’। সে সময় অনেকেই এই বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করেন। সে সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান কয়েকজন শিক্ষাবিদসহ ২৯ বিশিষ্ট নাগরিক।

২০০৯ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা (পিইসি) যেভাবে হঠাৎ চালু হয়, একই ঘটনা ঘটেছে এই বৃত্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে। পিইসির কালে তথা প্রায় এক যুগ ধরে বৃত্তি পরীক্ষা ছিল না। ওই সময়ে পিইসির ফলের আলোকে শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দেওয়া হতো। আর প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন ওই বৃত্তির মুলা দেখিয়েই এই বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নেয় এবং এক মাসের কম সময়ের নোটিশে পরীক্ষাটি নেওয়া হয়। যদিও বৃত্তি পরীক্ষাটির কোনো প্রয়োজনই ছিল না।

বৃত্তির যে যুক্তি প্রশাসন দেখিয়েছিল, সেটা পরীক্ষা ছাড়াই শিক্ষার্থীদের শ্রেণিকক্ষের মূল্যায়নের ভিত্তিতে দেওয়া যেত। এ বৃত্তি পরীক্ষার বিরোধিতার কারণ ছিল– একদিকে এটি শিশুদের জন্য অতিরিক্ত চাপ। তা ছাড়া বৃত্তির জন্য নোট, গাইড কিংবা কোচিং প্রসারের সুযোগ তৈরি হয়। আমরা দেখেছি, মাত্র ২০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে বাছাই করে এই বৃত্তি পরীক্ষা নেওয়া হয়েছিল। সেটিও শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। অন্যদিকে নতুন যে শিক্ষাক্রম এ বছর থেকে চালু হয়েছে, তার রূপরেখাও নির্দেশনার বিপরীত। নতুন শিক্ষাক্রমে শিশুবান্ধব শিক্ষা নিশ্চিত করতে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা নেই। তারই আলোকে শিশুদের শারীরিক ও মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী পিইসি ও জেএসসি বাদ দেওয়া হয়। তা ছাড়া শিক্ষায় যে সমন্বয়ের অভাব রয়েছে; অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পরীক্ষা না নিয়ে পঞ্চম শ্রেণির একতরফা বৃত্তির সিদ্ধান্তই তার প্রমাণ।

শিশুদের শারীরিক ও মানসিক চাপের উপলক্ষ হিসেবে অপ্রয়োজনীয় এ বৃত্তি পরীক্ষার বিরোধিতা সত্ত্বেও সবার পরামর্শ উপেক্ষা করে সেই পরীক্ষা গ্রহণ এবং ফল প্রকাশ সংক্রান্ত জটিলতায় শিক্ষার্থীর যে ক্ষতি হয়েছে, তা পরিমাপযোগ্য নয়। প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন বৃত্তি পরীক্ষাটি কতটা গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে, সেটাই বড় প্রশ্ন হিসেবে উপস্থিত। অন্তত মঙ্গলবার বৃত্তির ফল প্রকাশ এবং কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রত্যাহার সেটিই প্রমাণ করে।

প্রথমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ১০ শতাংশ শিক্ষার্থী, পরে ২০ শতাংশকে পরীক্ষার জন্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আবার ২৯ ডিসেম্বর পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও পরদিন তা অনুষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ শুরু থেকেই পরীক্ষাটি নিয়ে যে তাড়াহুড়ো ছিল এবং যে সিদ্ধান্তহীনতা লক্ষ্য করা গেছে; তা পরীক্ষার ফলেও আমরা দেখলাম। এই দায়িত্বহীনতা ও অবহেলার ঘটনা শিক্ষার অন্যান্য ক্ষেত্রেও ঘটেছে।

বৃত্তির ফলে সৃষ্ট সংকট সত্যিই হতাশাজনক। কারণ এর প্রধান শিকার সরাসরি শিশু। দায়সারাভাবে পরীক্ষাটি নেওয়ার ফলে এ অবস্থার উদ্ভব হয়েছে। এমনকি বৃত্তির জন্য শিক্ষার্থীদের কীভাবে মনোনীত করা হবে, সেটিও শিক্ষা প্রশাসন আগে ঠিক করেনি। যে কারণে গোঁজামিল দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার ফলের মতো এ বৃত্তি পরীক্ষার ফল তৈরি করতে গিয়েই কোডের সমস্যা হয়েছে।

এবার যেহেতু সরাসরি পরীক্ষা নিয়েছে, সেহেতু তারা অন্যভাবে মূল্যায়ন করতে পারত। তাড়াহুড়োর কারণেই হয়তো তারা সে পথে হাঁটেনি। যে পথ তারা নিয়েছে, তাতে অনেক শিশুর মন যে ভেঙে গেছে– বলাই বাহুল্য। যাঁদের ভুলের কারণে শিশুদের এই সংকটের মধ্যে পড়তে হয়েছে এবং শিক্ষা প্রশাসনের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাঁদের বিচারের আওতায় আনতেই হবে। তা না হলে শিক্ষায় এমন খামখেয়ালিপনা চলতেই থাকবে। বড় কাজ যেটা করতে হবে সেটা হলো, আগামী বছর থেকে প্রাথমিকের বৃত্তি বাতিল করা। গোড়ায় গলদ নিয়ে এ পরীক্ষা আর চলতে পারে না।

সমকালে প্রকাশ: ৩ মার্চ ২০২৩

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।


Warning: First parameter must either be an object or the name of an existing class in /home/mahfuzma/public_html/wp-content/plugins/bit-form/includes/Admin/Form/Helpers.php on line 119

Warning: First parameter must either be an object or the name of an existing class in /home/mahfuzma/public_html/wp-content/plugins/bit-form/includes/Admin/Form/Helpers.php on line 119

Warning: First parameter must either be an object or the name of an existing class in /home/mahfuzma/public_html/wp-content/plugins/bit-form/includes/Admin/Form/Helpers.php on line 119