Mahfuzur Rahman Manik
হুটহাট সিদ্ধান্তের বৃত্তি পরীক্ষা
ডিসেম্বর 9, 2022

দীর্ঘদিনের দাবির মুখে প্রাথমিক ও অষ্টম শ্রেণি সমাপনী পরীক্ষা বাতিল হওয়ার পর যখন শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি আমরা দেখছিলাম, তখনই প্রাথমিকে হঠাৎ এলো বৃত্তি পরীক্ষার ঘোষণা। ২৮ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এ-সংক্রান্ত সভার সিদ্ধান্ত ডিসেম্বরের প্রথম দিনে জানিয়েছে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর। এ সময়ে এসে হঠাৎ মন্ত্রণালয়ের এমন সিদ্ধান্তে স্বাভাবিকভাবেই হতবাক অভিভাবক ও শিক্ষকরা। বস্তুত প্রাথমিকে পড়ূয়া আমাদের শিশুদের ওপর অতীতে অনেক ক্ষেত্রে কোনো ধরনের গবেষণা, পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তুতি ছাড়াই যেভাবে হুটহাট সিদ্ধন্ত নেওয়া হয়েছে, এটি তারই ধারাবাহিকতা মাত্র।
২০০৯ সালে চালু হওয়া প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা-পিইসি চালু হয়েছিল হঠাৎ। ২০২০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর সমকালে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে ২০১০ সালে প্রণীত জাতীয় শিক্ষানীতির কো-চেয়ারম্যান ড. কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ বলেছিলেন, 'আগে পঞ্চম শ্রেণির পর একটি বৃত্তি পরীক্ষা হতো। বৃত্তি পরীক্ষার জন্য কিছু ভালো শিক্ষার্থীকে চিহ্নিত করে তাদের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া হতো। অন্যরা অবহেলিত থাকত। ২০১০ শিক্ষা প্রণয়ন কমিটি এটি বাতিল করে উপজেলা বা জেলাভিত্তিক অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার কথা বলে, যে পরীক্ষায় সংশ্নিষ্ট সব শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করবে। এই পরীক্ষার ভিত্তিতে বৃত্তি প্রদানের কথা বলা হয়। পরে সেই প্রস্তাবিত পরীক্ষাটি পঞ্চম শ্রেণি শেষে জাতীয় সমাপনী পরীক্ষা করা হয়।' ওই সাক্ষাৎকারে পিইসি পরীক্ষাটি বন্ধ হওয়ার ব্যাপারে তিনি জোরালো মত দিয়েছিলেন। হঠাৎ পিইসি পরীক্ষা চালু হওয়ার কারণে শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণসহ এর অংশীজনের মধ্যে যে ধরনের অসাধু প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল, তা আমরা দেখেছি।
হঠাৎ বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত নতুন শিক্ষাক্রমের সঙ্গেও সাংঘর্ষিক। আগামী বছর থেকে দেশে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হচ্ছে। সেখানে পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর মূল্যায়নকে অনুৎসাহিত করা হয়েছে বলেই এ বছরের মাঝামাঝিতে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। নতুন শিক্ষাক্রমের মাধ্যমে মুখস্থনির্ভর শিখন-শেখানো প্রক্রিয়া ও লিখিত পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে পরিবর্তনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক ও পারদর্শিতানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থায় রূপান্তর ঘটানোর কথা বলা হয়। নতুন শিক্ষাক্রমে যে নির্দেশিকা দেওয়া হয়েছে, সেটি বলা যায় বাস্তব চিন্তাপ্রসূত এবং দীর্ঘ পর্যবেক্ষণের ফল। যার মাধ্যমে বিদেশের মতো এখানেও তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিশুদের পরীক্ষা নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সত্যিকার অর্থে যদি তা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে শিক্ষায় ইতিবাচক পরিবর্তনের প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। কিন্তু আমরা দেখছি, প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসনের হঠাৎ হঠাৎ সিদ্ধান্ত নতুন শিক্ষাক্রম বাস্তবায়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। গত বছরের শেষদিকে আমরা দেখেছি, হঠাৎ বোর্ড করে পিইসি পরীক্ষাটি স্থায়ী করার আয়োজন করা হয়। পরে অবশ্য প্রতিবাদের মুখে প্রাথমিক শিক্ষা প্রশাসন ওই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
সম্প্রতি আমরা দেখেছি, বর্তমানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য ১৮ মাসের যে ডিপিএড কোর্স চালু রয়েছে, সেই কোর্সকে হঠাৎ ছয় মাসে রূপান্তর করার কর্মসূচি হাতে নেয় প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। প্রতিবাদের মুখে তা নিয়েও চুপ রয়েছে শিক্ষা প্রশাসন। অবকাঠামোগত প্রস্তুতি না থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ এক শিফটের প্রাথমিক শিক্ষা ও দুটি বিদ্যালয়কে একটি করার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষার সিদ্ধান্ত বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের বিজ্ঞপ্তিতে এটা স্পষ্ট, ২৮ নভেম্বর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকেই পরীক্ষার বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়। সেখানে শিক্ষার প্রশাসনিক দায়িত্বশীলরা শিক্ষার্থীর বয়স ও উপযোগিতা না ভেবে এক বৈঠকেই যেভাবে হুটহাট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাই স্বাভাবিক। মেধাবৃত্তি বিষয়ে যদি তাঁরা সময় নিতেন এবং এ নিয়ে শিক্ষা বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতেন তাহলে হয়তো ভিন্ন সিদ্ধান্ত আসত।
এমনিতেই শিক্ষার যে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় গবেষণা, বিশেষজ্ঞ মতামত কিংবা দীর্ঘ প্রস্তুতি প্রয়োজন। তার ওপর সিদ্ধান্তটি যদি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য হয় তখন সেটি আরও বেশি জরুরি। কারণ প্রাথমিক শিক্ষায় আমাদের কোমলমতি শিশুরা পড়াশোনা করছে। চাইলেই আমরা শিশুদের নিয়ে 'এক্সপেরিমেন্ট' করতে পারি না। হুটহাট সিদ্ধান্ত শিশুবান্ধব শিক্ষায় বড় বাধা। প্রাথমিকে বৃত্তি পরীক্ষার এবারের সিদ্ধান্তটি সেদিক থেকেই দেখা উচিত।
যেহেতু সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে বৃত্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, সেহেতু এটি বন্ধের সুযোগ এখনও রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় চাইলে ত্বরিত আরেকটি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে এ আয়োজন বন্ধের প্রক্রিয়া শুরু করতে পারে। না হলে এটি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য খারাপ দৃষ্টান্ত হিসেবেই দেখা হবে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, এটি শিক্ষার বাণিজ্যিকীকরণের পথ আরও প্রশস্ত করবে। এ পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে হয়তো শিগগির গাইড-নোট বেরিয়ে যাবে। কোচিংগুলোও তৎপর হয়ে উঠবে।

সমকালে প্রকাশ: ৮ ডিসেম্বর ২২

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।