মূল: বীরা প্রতীপচাইকুল
অনুবাদ: মাহফুজুর রহমান মানিক
মাদকদ্রব্যের সঙ্গে বন্দুকের যখন মেলবন্ধন ঘটে, তখন সেটি সহিংসতার জন্য বিপজ্জনক রসায়ন তৈরি করে। থাইল্যান্ডের নং বুয়া লাম্ম্ফু প্রদেশে শিশু হত্যার ঘটনাটি তারই সাক্ষ্য বহন করে। ৬ অক্টোবর পুলিশের এক সাবেক সদস্যের গুলিতে সেখানে ৩৭ জন নিহত হয়। এর মধ্যে অন্তত ২২টি শিশু। এর পর বন্দুকধারী আত্মহত্যা করেন এবং তার আগে তাঁর স্ত্রী-সন্তানকেও হত্যা করেন। পুলিশে চাকরিরত অবস্থায়ই তিনি মাদক গ্রহণ করতেন এবং সে জন্যই এ বছরের মাঝামাঝিতে তাঁর চাকরি চলে যায়।
এই গণহত্যা থেকে দুটি বিষয় উঠে এসেছে। প্রথমটি হলো, মানুষের বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর মধ্যে মাদকের অপব্যবহার। দ্বিতীয় বিষয়টি, থাইল্যান্ডে বন্দুকের অপব্যবহার। বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দিয়েছেন, থাই পুলিশকে মাদকমুক্ত করতে একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা জরুরি। একই সঙ্গে বন্দুকের মালিকানা নিয়েও আবার চিন্তা করা দরকার। পুলিশের মাদক ব্যবহার নিয়ে এটা বলা অত্যুক্তি হবে না যে, পুলিশের কতসংখ্যক সদস্য মাদক গ্রহণ করে, সে ব্যাপারে থাই পুলিশ প্রশাসনের তেমন ধারণা নেই। কারণ, নির্দিষ্ট সময় পরপর এর পরীক্ষার কোনো বাধ্যতামূলক ব্যবস্থা নেই। যেমন- প্রতি তিন মাসে প্রস্রাব পরীক্ষা করা।
পুলিশ সদস্য মানুষের একেবারে কাছাকাছি থাকে এবং কাজের সময় তারা সশস্ত্র অবস্থায় থাকে। মাদক গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজের সূত্রেই তারা মাদক পায়। ফলে কিছু অসাধু পুলিশ সদস্য বিক্রি বা ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণের জন্য মাদক গোপনে পকেটে নিয়ে থাকে। মাদকের অভ্যাসবশত নিয়মিত ব্যবহারে মস্তিস্ক আক্রান্ত হয় এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে তার প্রভাব পড়ে। মাদকের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের মধ্যে বিষণ্ণতা, ইতস্তত থাকা, ঘুম না আসা, মুড ঠিক না থাকা, আগ্রাসী আচরণ, মস্তিস্ক বিকৃতিসহ নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দেখা যায়।
এ ট্র্যাজেডির পর থাইল্যান্ড পুলিশপ্রধান বলেছেন, এমন গণহত্যা থেকে পুলিশের শিক্ষণীয় হলো এমন ব্যবস্থা গ্রহণ, যাতে এ ধরনের ভয়াবহ অঘটনের পুনরাবৃত্তি না হয়। সম্ভবত এটি শুধু প্রতিশ্রুতির মধ্যেই আটকে থাকবে এবং কিছুদিন পর সবকিছু আগের মতোই হয়ে যাবে। যেমনটা সব সময়ই হয়। পছন্দ করি না-করি, মাদক থেকে আমাদের মুক্তি প্রায় অসম্ভব। কারণ, গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল এলাকায় মাদক অবাধে উৎপাদন হয়, যেটি মিয়ানমারের ওয়া প্রদেশের সেনাবাহিনী তত্ত্বাবধান করে এবং এটি মিয়ানমার সরকারেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। থাই সেনাবাহিনীও ওয়াদের থামাতে কিচ্ছু করতে সক্ষম নয়। সর্বোচ্চ তারা ছিদ্রযুক্ত সীমান্তে মাদক বহন বন্ধ করতে পারে। যদিও সেটা আগের মতোই কষ্টসাধ্য।
আরকটি বিষয় নিয়ে কথা বলা দরকার- বন্দুকের মালিকানা। এ বিষয়ে আমরা সংকটের মুখোমুখি। ২০১৭ সালের ক্ষুদ্র অস্ত্র জরিপ প্রতিবেদন অনুসারে, থাইল্যান্ডে তখন প্রায় এক কোটি ব্যক্তিগত মালিকানার বন্দুক রয়েছে। এর মধ্যে ৬০ লাখ ছিল বৈধভাবে নিবন্ধিত। বাকি ৪০ লাখ অস্ত্রই অবৈধ। বর্তমানে সেই অস্ত্রের সংখ্যা যে বেড়েছে, তা বলা বাহুল্য। বন্দুক আমদানিতে কোটা পদ্ধতির মাধ্যমে এটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হচ্ছে। প্রতিটি বন্দুকের দোকান বছরে কতটি বন্দুক আমদানি করতে পারবে, তা নির্ধারণ করে দিয়ে বন্দুক নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা আসলে পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ, সরকার নিজেই বন্দুকের সবচেয়ে বড় আমদানিকারক। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রাদেশিক প্রশাসনিক বিভাগ বন্দুক কল্যাণ কর্মসূচির মাধ্যমে এটি আমদানি করে এবং তাদের কোনো নির্দিষ্ট সীমা নেই।
স্থানীয় প্রশাসনিক সংগঠনসহ রাষ্ট্রীয় যে কোনো সংস্থা তাদের কর্মকর্তাদের সুরক্ষা, খেলা অথবা পশু শিকারের জন্য প্রাদেশিক প্রশাসনিক বিভাগে বন্দুকের চাহিদা জানাতে পারে। বন্দুকের দোকানগুলো এই কর্মসূচি পছন্দ করছে। কারণ, তারা প্রাদেশিক প্রশাসনিক বিভাগের হয়ে প্রস্তুতকারকদের সঙ্গে বন্দুক ক্রয়ের অর্ডার করলে নিজেরা যেমন রাজস্ব পায়, তেমনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় বড় কর্তাব্যক্তিও তাতে লাভবান হন। এতে ক্রেতাদেরও লাভ। কারণ তাঁরা এভাবে বাজারমূল্যের চেয়েও কম দরে কিনতে পারেন। সবাই এতে লাভবান হচ্ছেন বলে সরকারের এ বন্দুক কর্মসূচি বাতিল হওয়ার কোনো কারণ নেই। এমনকি যে কেউ নিজের কোনো অপরাধের রেকর্ড না থাকলে এবং ব্যাংক অ্যাকাউন্টে পর্যাপ্ত অর্থ দেখাতে পারলে একাধিক বন্দুক কিনতে পারেন। এখানে কোনো সীমা নেই; ব্যক্তিগত সংগ্রহে রাখতে চাইলে যতটা ইচ্ছে বন্দুক কিনতে বাধা নেই। বন্দুকের মালিকানার ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কঠোর পদক্ষেপের কথা বলছেন অনেকেই। বন্দুক যাতে ভুল হাতে না যায়, সেটিও দেখা জরুরি।
বীরা প্রতীপচাইকুল: ব্যাংকক পোস্টের সাবেক সম্পাদক; থাইল্যান্ডের ব্যাংকক পোস্ট থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর