মূল: ইয়ারা হাওয়ারি
অনুবাদ: মাহফুজুর রহমান মানিক
গত সপ্তাহে (৭ আগস্ট ২০২২) ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠী আবারও ফিলিস্তিনের গাজা ভূখণ্ডে বোমাবর্ষণ করে। তিন দিনের বোমা হামলায় ১৭ শিশুসহ অন্তত ৪৯ ফিলিস্তিনি নিহত হন। আহত হন হাজারো মানুষ। ইসরায়েলের আচরণে মনে হয়, ১৫ বছরের ভয়ানক অবরোধ যথেষ্ট নয়। বছরের পর বছর ধরে গাজা ভূখণ্ডে ভয়াবহ 'অপারেশন' চালিয়ে আসছে ইসরায়েল। তাতে হাজারো ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন; আহত হয়েছেন লাখো মানুষ। সেখানকার গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
২০১২ সালে জাতিসংঘ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল- ২০২০ সালের মধ্যে গাজা বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠবে। অনেক কিছু বিবেচনায় বলা যায়, সে ভবিষ্যদ্বাণী সঠিক প্রমাণিত। যদিও এখন সেখানে ২০ লাখের অধিক ফিলিস্তিনি বাস করে আসছেন। বলা বাহুল্য, সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দাই তাঁদের পছন্দে সেখানে থাকছেন না। সাম্প্রতিক এক জরিপে উঠে এসেছে, গাজায় বসবাসরত প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ বলেছেন, সুযোগ থাকলে তাঁরা গাজা ত্যাগ করতেন। অনেকেরই ভবিষ্যতে গাজায় নিজেদের দেখতে না চাওয়ার বিষয়ে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অনেক বছর ধরেই গাজায় ফিলিস্তিনিদের বসবাস সহজ ছিল না। ইসরায়েলি নেতাদের প্রতিটি 'যুদ্ধ', 'অপারেশন' এবং আক্রমণের মাধ্যমে ফিলিস্তিনিদের অবস্থা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলছে, দীর্ঘ অবরোধের ফলে তাঁরা যেভাবে ভুগছেন, তাতে বিদ্যুৎ বিভ্রাট ও জেনারেটরের তেল সংকটের ফলে সেখানকার স্বাস্থ্যসেবা শিগগিরই সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সাম্প্রতিক বোমা হামলার পর ইসরায়েলি সরকার গাজার সব ক্রসিং বন্ধ করে রেখেছে এবং তারা গাজায় তেল ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য প্রবেশে বাধা দিচ্ছে।
গাজার বাসিন্দাদের নতুন হামলার ভয়ে থেকেই পুরোনো বোমা হামলার ঘা সারাতে তাদের সময় চলে যায়। শারীরিক ও মানসিক উভয় দিকের যে ক্ষত ফিলিস্তিনিদের তৈরি হয়েছে, তা থেকে উত্তরণের কোনো পথ নেই।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন এনজিও এবং জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠানগুলো গাজার অনন্ত যুদ্ধে মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নথি তৈরি করছে বটে। কিন্তু তারা যে পদ্ধতি ও তত্ত্বে তথ্য সংগ্রহ করছে, তা যথেষ্ট নয়। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মানসিক স্বাস্থ্য বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. সামাহ জাবির সম্প্রতি যেমনটা বলেছেন, এসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান পশ্চিমা ধারণার মাধ্যমে সংকট বুঝতে চেষ্টা করছে এবং সেভাবেই এর মোকাবিলা করছে। অথচ এই ধারণায় গাজার বাস্তবতা বোঝা সম্ভব নয়। উদাহরণস্বরূপ, দুর্ঘটনা-পরবর্তী মানসিক বৈকল্য বা পিটিএসডি ধারণা ফিলিস্তিনিদের জন্য প্রযোজ্য নয়। কারণ, ফিলিস্তিনিরা প্রতিনিয়ত হামলার শিকার এবং এই মানসিক চাপ ও ট্রমা গাজা এবং বৃহত্তর ফিলিস্তিনি প্রজন্মকেও ছাড়িয়ে গেছে।
গাজায় ফিলিস্তিনিদের ট্রমার যে নিদারুণ অভিজ্ঞতা তা গত সপ্তাহে, গত বছর কিংবা ২০০৬ সালেও শুরু হয়নি। এটি বরং শুরু হয়েছে কয়েক দশক আগে যখন ইহুদি আন্দোলন ফিলিস্তিনে নজর দেয় এবং সে ভূমিতে ঔপনিবেশিক প্রকল্প শুরু করে। এই প্রকল্পের ফলে ফিলিস্তিনের ব্যাপকসংখ্যক মানুষকে ধারাবাহিকভাবে তাঁদের ভূমি থেকে অপসারণ করা হয় এবং ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়। সেই ফিলিস্তিনিরা খোলা কারাগার হিসেবে আজকের গাজায় আশ্রয় নেন। গাজায় বসবাসকারী ২০ লাখের অধিক মানুষের মধ্যে প্রায় পনেরো লাখই ফিলিস্তিনের অন্য অংশের শরণার্থী। সে কারণে ২০১৮ সালে গাজায় বসবাসকারী ফিলিস্তিনিরা 'গ্রেট মার্চ অব রিটার্ন' আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁদের নিজ ভূমিতে ফেরত যাওয়ার আন্দোলন শুরু করেন। লাখো ফিলিস্তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ওই আন্দোলনে যোগ দেন। তখন ইসরায়েলি শাসকদের গুলিতে শত শত ফিলিস্তিনি মারা যান এবং আরও অনেকে পঙ্গু হয়ে যান।
ধারাবাহিক এই ট্রমার মধ্যেই গাজায় ইসরায়েলের সাম্প্রতিক বিধ্বংসী হামলা এবং ৪৯ ফিলিস্তিনি হত্যার পরও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আগের মতোই নির্বিকার। উল্টো তারা ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠীকে সম্পূর্ণ দায়মুক্তি দিয়েছে। অসংখ্য রাজনীতিবিদ ও কূটনীতিক এই তথাকথিত 'সহিংসতা বৃদ্ধি'র জন্য তাঁদের উদ্বেগ জানিয়েছেন এবং 'উত্তেজন থামানো' ও 'শান্তি'র জন্য আহ্বান জানিয়েছেন এবং তাঁরা ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার জন্য ইসরায়েলকে 'অপরাধী' না বানানোর ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্ক। যেন ৫ বছরের আলা কাদুম এবং ৫ ও ১১ বছরের দুই ভাই আহমেদ ও মোমেন আল নাইরাব ইসরায়েলি বোমায় নয়, প্রাকৃতিক কারণে মারা গেছে। যেন ইসরায়েলি শাসকরা ফিলিস্তিনিদের দশকের পর দশক ধরে কোনো কারণ ছাড়া হত্যা, পঙ্গু কিংবা ট্রমায় ফেলেনি।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অন্যরা এমনকি ইসরায়েলি সহিংসতার পরও তাদের প্রতি শর্তহীন সহায়তার হাত বাড়াতে এতটুকু কার্পণ্য করেনি। উদাহরণস্বরূপ, ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব লিজ ট্রুস গত সপ্তাহের অপারেশন চালানোর পরই ইসরায়েলকে সমর্থন করে এমন একটি বিবৃতি দিয়েছেন, যেখানে ফিলিস্তিনিদের মৃত্যুর কোনো কথাই উল্লেখ ছিল না। বিবৃতিতে তিনি বলেন, 'ব্রিটেন ইসরায়েলের পক্ষে এবং নিজেদের রক্ষা করার অধিকার তাদের রয়েছে।' ব্রিটেনের এই বক্তব্যে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। কারণ, ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা থেকেই দেশটি ইসরায়েলকে সব ধরনের সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এমনকি এখানেও অবাক হওয়ার কিছুই নেই- ব্রিটেন গাজায় বোমা ফেলতে ইসরায়েলকে সামরিক হার্ডওয়্যারও সরবরাহ করছে।
এ জানি, আমরা ফিলিস্তিনিরা ইউক্রেন নই। আমরা জানি, ইউক্রেনীয়রা যে ব্যাপক সহায়তা পাচ্ছে, আমরা তা পাব না। শক্তিশালী দখলদারদের কবল থেকে মুক্তি এবং আমাদের অধিকার রক্ষায় কেউ নেই। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আমাদের শহীদদের মহিমান্বিত করে কোনো ছবি প্রকাশ করবে না। পপ তারকা, হলিউড অভিনেতা কিংবা প্রধানমন্ত্রীরা গাজার ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও বসবাসকারী পরিবারদের দেখতে আসবেন না।
বাস্তবতা হলো, বিশ্ব সম্প্রদায় যতদিন নীরব থাকবে ইসরায়েলি শাসকগোষ্ঠী দায়মুক্তি নিয়েই বোমা হামলা এবং ফিলিস্তিনিদের হত্যা অব্যাহত রাখবে।
ইয়ারা হাওয়ারি: প্যালেস্টাইন পলিসি নেটওয়ার্ক আল-শাবাকার ফেলো; আলজাজিরা থেকে ভাষান্তর