Mahfuzur Rahman Manik
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলাই শেষ কথা নয়
এপ্রিল 20, 2022
আমরা মুখে যদিও বলছি, শিক্ষা ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে, বাস্তবে সেটা নিরূপণে দেরি কেন?

দীর্ঘ দুই বছর পর ১৫ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে স্বাভাবিক শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হয়েছে। করোনার ক্ষত কাটিয়ে শিক্ষা কতটা স্বাভাবিক পরিবেশে ফিরেছে, কিংবা স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরলেও দীর্ঘদিন বন্ধ থাকায় কী প্রভাব পড়েছে, এ সময়ে আমরা কী হারিয়েছি বা অর্জন করেছি তা পর্যালোচনার বিষয়। এ নিয়ে যে গবেষণাও প্রয়োজন তা ইতোমধ্যে অনেকে বলেছেন।

মহামারির দুই বছরের ঘটনাপ্রবাহ অনেকেরই মনে থাকার কথা। এ সময়ের মধ্যে দুই ধাপে বন্ধ ছিল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর ধাপে ধাপে ছুটি বাড়িয়ে প্রায় দেড় বছর পর ২০২১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সীমিত পর্যায়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে এ বছরের ২১ জানুয়ারি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হওয়ার পর সীমিত পর্যায়ে মাধ্যমিক বিদ্যালয় খোলে ২২ ফেব্রুয়ারি আর প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলে ২ মার্চ থেকে। ১৫ মার্চ থেকে দুই বছর পর প্রাক-প্রাথমিকের শ্রেণি কার্যক্রম শুরু হওয়াসহ শিক্ষার সব পর্যায়ে ওইদিন থেকে পুরোপুরি পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয়।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলেছে এবং পুরোদমে চলছে, এটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। কিন্তু এটাই শেষ কথা হওয়া উচিত নয়। এখানে দুটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। একটি হলো, করোনার কারণে বন্ধের সময়ে শিক্ষার কেমন ক্ষতি হয়েছে তা নির্ণয়। আরেকটি, ওই ক্ষতি কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়, সেজন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা। মনে রাখতে হবে, শিক্ষার ক্ষতি আর অর্থনীতির ক্ষতি এক বিষয় নয়। অর্থনীতি বা অন্যান্য ক্ষতি টাকার অঙ্কে নিরূপণ করা গেলেও শিক্ষার বিষয়টি সেভাবে পরিমাপ করা কঠিন। শিক্ষার ক্ষতি পরিমাপের জন্য প্রথমেই দেখতে হয় ঝরে পড়া বা ড্রপ আউটের হার। এরপর শিখনশূন্যতা কতটা হলো তা দেখতে হবে। মূলত এই দুটিই বড় বিষয়। এগুলো ধরে কাজ করলে প্রাসঙ্গিক অন্যান্য বিষয়ও চলে আসবে। যেমন কভিডকালে অনলাইন শিক্ষা কেমন হয়েছে, অ্যাসাইনমেন্ট পদ্ধতি কতটা কার্যকর ছিল, এ সময়ে শিক্ষার্থীর নির্দিষ্ট শিখন দক্ষতা বা শ্রেণিভিত্তিক 'টার্মিনাল কম্পিটেন্সি' কতটা অর্জিত হয়েছে ইত্যাদি। ঝরে পড়া নির্ণয়ের কথা ইতোমধ্যে শিক্ষা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত সেপ্টেম্বরে এবং এ বছরের শুরুতে বলা হলেও এ ধরনের কোনো পদক্ষেপ আমাদের চোখে পড়েনি। বিষয়টি নিয়ে সমকালেই আমি আলোকপাত করার চেষ্টা করেছিলাম। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানভিত্তিক পরিসংখ্যান গ্রহণ করে বিষয়টি অল্প সময়েই বের করা সম্ভব। এখনও এটা জরুরি, কারণ পুরোপুরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পরও কোন শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসছে না, তারা কেন আসছে না, বাল্যবিয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে কিনা, প্রতিষ্ঠানগুলোর তা জানা উচিত।

শিখনশূন্যতা নিরূপণেও পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি কতটা হয়েছে তা নিরূপণে প্রতিবেশী ভারতসহ অনেকেই প্রাথমিক পর্যায়ে ওরাল রিডিং ফ্লুয়েন্সি (ওআরএফ) জরিপ করছে। এর মাধ্যমে একটা চিত্র উঠে আসবে বটে, তবে সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীর শিখন ঘাটতি কতটা হয়েছে তা নির্ণয় করতে পারেন শিক্ষকরাই। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানকালে বিষয়ভিত্তিকভাবে শিক্ষকরা তা বুঝতে পারবেন। বিশেষ করে ২০২০ এবং ২০২১- এ দুই বছরে শিক্ষার্থীদের ক্ষতিটা হয়েছে। ফলে যে শিক্ষার্থী এখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ছে, তার ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠগুলো সে কেমন পারে তা শিক্ষকই ভালো বুঝবেন। তারপরও ঝরে পড়া এবং শিখন ঘাটতি উভয়টির একটি মোটামুটি চিত্র পাওয়ার জন্য একই সঙ্গে গোটা দেশে একটা জরিপ হতে পারে। সমকালের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে রাশেদা কে চৌধুরী শিক্ষাশুমারির কথা বলেছেন। আমি মনে করি, সেটা হওয়া উচিত এবং এই শুমারিতে শিখন ঘাটতিসহ অন্যান্য বিষয়ও যাতে আসে, তা নিশ্চিত করা দরকার। বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরো তথা ব্যানবেইজ এ কাজটি করতে পারে।

আমরা দেখেছি, উন্নত বিশ্ব শিক্ষায় করোনার ঘাটতি পূরণে 'ক্যাচআপ প্ল্যান' বা 'রিকভারি প্ল্যান' নিয়েছে। আমাদেরও সে ধরনের পরিকল্পনা জরুরি। কিন্তু ক্ষতি পূরণের পরিকল্পনা নেওয়ার আগে ক্ষতিটা তো পরিমাপ করতে হবে। অন্যান্য দেশ তাদের পরিবেশ-পরিস্থিতির আলোকে সিদ্ধান্ত নিয়ে তা কার্যকর করছে। আমাদেরও অবস্থার আলোকে সে ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিকল্পিতভাবে সমস্যা নিরূপণ ও সমাধানে হাত দিলে অল্প সময়েই ক্ষত কাটানো সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে স্তরভিত্তিক পদক্ষেপ নিলে ভালো সুফল পাওয়া যাবে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এমনকি উচ্চশিক্ষা থেকেও কভিডের কারণে অনেকে ঝরে থাকবে। সেজন্য প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রশাসন ও উচ্চশিক্ষার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

স্বাভাবিক নিয়মেই করোনা মহামারি আমরা ভুলে যাব। কিন্তু এ মহামারি সব ক্ষেত্রে যে ধাক্কা দিয়ে গেছে এবং সেখান থেকে কীভাবে আমাদের উত্তরণ ঘটেছে, তার রেকর্ড ভবিষ্যতের জন্য রাখা প্রয়োজন। আমরা মুখে যদিও বলছি, শিক্ষা ক্ষেত্রে করোনার প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়েছে, বাস্তবে সেটা নিরূপণ করছি না। ক্লাস যেহেতু পুরোপুরি শুরু হয়েছে, তা এখনই করার সময়। সে আলোকে অতিরিক্ত শ্রেণি কার্যক্রম হাতে নেওয়াসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাও এখনই নিতে হবে।

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।