Mahfuzur Rahman Manik
কৃষি বাজেটের সুফল সরাসরি কৃষকের ঘরে পৌঁছান- আবদুল লতিফ মণ্ডল

আবদুল লতিফ মণ্ডল খাদ্য সচিব হিসেবে ২০০২ সালে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে এক বছর রাষ্ট্রপতির সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তী সময়ে তিনি বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংকের চেয়ারম্যান হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ৪। বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই সংবাদপত্রে বিশেষত কৃষি খাতের নানাদিক নিয়ে লিখছেন নিয়মিত। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক আবদুল লতিফ মণ্ডল শিক্ষকতা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করলেও সিএসপি অফিসার হিসেবে সিভিল সার্ভিসে প্রবেশ করেন স্বাধীনতারও আগে। তিনি রংপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

সমকাল: বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের উল্লেখযোগ্য অংশ কৃষি খাতকেন্দ্রিক হলেও জাতীয় আয়ে কৃষি খাতের অবদান সেই অর্থে কম। বাজেটেও কি এর প্রভাব রয়েছে?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: কৃষি খাতের অবদান জাতীয় আয়ে একেবারে কম নয়। এটা ঠিক, স্বাধীনতার পর জিডিপিতে কৃষির অবদান অনেক বেশি ছিল। তার কারণ তখনও অন্যান্য খাত সেভাবে বিকশিত হয়নি। ধীরে ধীরে অন্যান্য খাত বিশেষত শিল্পের বিকাশে কৃষির অবদান কমেছে। তবে মনে রাখতে হবে, কৃষি খাত অনেক বড় বিষয়। এর সঙ্গে শস্য, মৎস্য, বন এমনকি প্রাণিসম্পদও অন্তর্ভুক্ত। জিডিপিতে কৃষির অবদান ২০ শতাংশের নিচে নেমে এলেও বাজেটে কৃষি যথাযথ গুরুত্ব পাচ্ছে না তা কিন্তু নয়।

সমকাল: কৃষি কীভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: আমরা দেখেছি, দেশের সব বাজেটে কৃষিতে বরাদ্দ ছিল। প্রথম থেকে পঞ্চম পর্যন্ত সব পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও কৃষিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে যথাযথভাবে। মনে রাখা দরকার, শিল্পের অগ্রগতিতে কৃষি খাতে জিডিপিতে অবদান কমলেও কৃষিই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত। কৃষি আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। দেশের মোট কর্মসংস্থানের অন্তত ৪০ শতাংশ কৃষিকেন্দ্রিক। এমনকি আমরা যদি হিসাব করি, দেখা যাবে অন্যান্য খাতও কৃষির ওপর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে জড়িত। যেমন হোটেল-রেস্তোরাঁ, পর্যটন এবং অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসা।

সমকাল: কৃষি গুরুত্ব পেলেও কৃষক বঞ্চিত হচ্ছেন। কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া নিয়ে অভিযোগ আছে বিস্তর। এ সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: কৃষক কৃষিপণ্য উৎপাদন করে ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না- এমন অভিযোগ এখনও রয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রেই যে তারা বঞ্চিত হচ্ছেন, এমনটি কিন্তু বলা যাবে না। কৃষকের ন্যায্যমূল্য মানে উৎপাদন খরচ মিটিয়ে কৃষক যাতে কিছু লাভ পান। সেজন্য সরকার প্রতি বছর ধান-চালের একটি দাম নির্ধারণ করেন। তা কৃষকের স্বার্থ দেখেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে করা হয়। যেমন এবার সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২৭ টাকা কেজিতে ধান কিনবে। গত বছর থেকে এবার এক টাকা বাড়ানো হয়েছে। চালের সংগ্রহ মূল্য এবার তিন টাকা বাড়িয়ে ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। কৃষক থেকে সরকার সরাসরি ধান নিলে কৃষক বেশি উপকৃত হতে পারেন।

সমকাল: কৃষক আর কীভাবে উপকৃত হতে পারেন।

আবদুল লতিফ মণ্ডল: আমি মনে করি সরকারের দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন বিপণনের দিকে। ধরা যাক, গ্রামের একজন কৃষক যে কৃষিপণ্য বিক্রি করেন ২০ টাকায় তা ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে বিক্রি হয় ৩৫-৪০ টাকায়। মাঝে যে ১৫-২০ টাকার ফারাক তা কিন্তু কৃষক পাচ্ছেন না। তা মধ্যস্বত্বভোগীরা পেয়ে যাচ্ছেন। আমরা যদি এমন একটি বিপণন ব্যবস্থার সৃষ্টি করতে পারি, যার মাধ্যমে সরাসরি কৃষক থেকে পণ্য নেওয়া হবে- তাহলে কৃষক আরও বেশি মূল্য পেতে পারেন না?

সমকাল: কৃষি যান্ত্রিকীকরণে সরকার বাজেটে বরাদ্দ দিচ্ছে। বিষয়টি আপনি কীভাবে দেখছেন?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কৃষির যান্ত্রিকীকরণের বিষয়টি আসছে। যান্ত্রিকীকরণের প্রয়োজন রয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে খেয়াল রাখতে হবে, পুরো কৃষি খাত যাতে যান্ত্রিকীকরণ না হয়। কৃষি পুরোপুরি যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীল হলে আমাদের কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আমরা দেখেছি, কৃষি মৌসুমে দরিদ্র কৃষক কাজের প্রয়োজনে উত্তরবঙ্গ থেকে বিভিন্ন জেলায় যান। যান্ত্রিকীকরণ হলে অনেক কৃষকই বেকার হয়ে পড়বেন। কৃষকরা যেখানে শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশ, তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। যান্ত্রিকীকরণ প্রয়োজন রয়েছে। হাওরে বোরো কাটার সময়টি সংক্ষিপ্ত হয়। এ সময় দ্রুত ধান তোলা না গেলে বন্যায় তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। তখন তারা যেন যন্ত্রের মাধ্যমে দ্রুত ধান কাটতে পারে। মনে রাখা দরকার আমাদের শ্রমঘন শিল্প বেশি দরকার, যাতে অধিক শ্রমিকের কর্মসংস্থান করা যায়।

সমকাল: করোনা দুর্যোগের মধ্যেও কৃষিপণ্যের উৎপাদন ধরে রেখেছেন কৃষক। বাজেটে তাদের জন্য প্রণোদনা কতটা জরুরি?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: করোনা মহামারির এ সময়ে সব খাত ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কৃষি উৎপাদন ধরে রেখেছেন কৃষক। প্রশাসন ও অন্যরাও কৃষকের সাহায্যে এগিয়ে এসেছেন। এ সময়ে খাদ্য সংকট হলে বাংলাদেশ বিপদে পড়তে পারত। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ায় অন্তত না খেয়ে কেউ মরেনি। কৃষকের এ অবদানের জন্যই নয়, এমনিতেই তাদের প্রণোদনা দরকার। কৃষিক্ষেত্রে বাজেট প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। করোনার এ সময়ে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে এ খাতে বাজেট বাড়ানো প্রয়োজন।

সমকাল: কৃষি বাজেট বাড়লে কৃষক এর সুফল কতটা পাবেন?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: কৃষি বাজেটের সঙ্গে কৃষকের গভীর সম্পর্ক। সরকার বাজেটে কৃষকের জন্য বরাদ্দ দিলে তা কৃষকের কাছে পৌঁছবে। সমস্যা হলো, কৃষক প্রণোদনা কিংবা ভর্তুকি কোনোটাই সরকার থেকে সরাসরি পান না। কৃষকের কাছে বীজ, সার ইত্যাদি কীভাবে সরাসরি পৌঁছানো যায় এবং বাজেটে যে ভর্তুকি দেওয়া হয় তা যেন কৃষকের ঘরে যায় তা নিশ্চিত করতে হবে।

সমকাল: সার ও বীজে সরকারি সহায়তার সুফল কৃষক কীভাবে পেতে পারেন?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: সার ও বীজ কৃষককে কম মূল্যে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। যথাসময়ে সার না পেলে তার প্রভাব পড়ে উৎপাদনে। সরকার ডিলারদের মাধ্যমে তৃণমূল পর্যন্ত সার দিয়ে থাকে। যেমন গত বোরো মৌসুমে করোনার কারণে লকডাউনে হাট-বাজার পুরোপুরি খোলা না থাকার কারণে কৃষক যথাসময়ে সার না পাওয়ায় বোরো উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়। সার-বীজে ভর্তুকি বাড়িয়ে এগুলো কৃষকের জন্য সহজলভ্য করা প্রয়োজন।

সমকাল: কৃষি ঋণ নিয়ে বিস্তর অভিযোগ। এ ব্যাপারে আপনার মন্তব্য কী?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: কৃষি ঋণ নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ রয়েছে, তা অসত্য নয়। কৃষক কৃষি ঋণ পাবেন নীতিমালা অনুযায়ী। নীতিমালা অনুযায়ী জমির দলিল বন্ধক রেখে ঋণ নিতে হয়। কিন্তু আমাদের অধিকাংশ কৃষকেরই জমি নেই। আবার অনেকেরই জমির মালিকানা-সংক্রান্ত পারিবারিক জটিলতা থাকে। নীতিমালা অনুযায়ী জমি না থাকলেও ঋণ পাবেন, সেক্ষেত্রে বর্গাচাষি জমি ভাড়ার চুক্তিপত্র জমা দেবেন। অথচ লিখিত চুক্তির মাধ্যমে কোনো চাষি জমি বর্গা নেন না। অনেক সময় ব্যাংকের অনিয়মের কারণে কৃষক বঞ্চিত হন। অসাধু ব্যাংক কর্মকর্তার সহায়তায় কৃষকের নামে ঋণ নিয়ে আত্মসাতের অভিযোগও সংবাদমাধ্যমে আমরা দেখেছি। তার পরও অনেকে ঋণ নিচ্ছেন। আগের চেয়ে বেশি কৃষক ঋণসুবিধা ভোগ করছেন।

সমকাল: কৃষিপণ্যের বাজার যে মাঝে মাঝে চড়া হয় তার কারণ কি উৎপাদন মূল্য?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: কৃষিপণ্যের বাজার নানা কারণেই চড়া হতে পারে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মধ্যস্বত্বভোগীরা দাম বাড়িয়ে দিয়ে লাভবান হয়; কিন্তু কৃষকের কোনো উপকার হয় না। তবে হ্যাঁ, সাধারণত উৎপাদনমূল্যের সঙ্গেই বাজারমূল্য নির্ধারিত হয়। কৃষিপণ্যে উৎপাদনমূল্য কেবল কৃষকের জন্যই নয় বরং ভোক্তার স্বার্থেই জরুরি। আমরা প্রায় আশি ভাগই ভোক্তা। ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সরকারকে কৃষকদের ভর্তুকি দিয়ে হলেও স্বল্প মূল্য উৎপাদনের ব্যবস্থা করতে হয়। বিশ্বব্যাপী এ চর্চাই আমরা দেখছি। কৃষির উৎপাদন মূল্য কমাতে সরকার নানাভাবে ভর্তুকি দিয়ে থাকে। বাজেটেও যদি সরকার পরিকল্পিতভাবে বরাদ্দ দেয় তাতে কৃষির উৎপাদনমূল্য কমে বিপুলসংখ্যক ভোক্তার উপকার হতে পারে। তবে সরকারকে কৃষক ও ভোক্তার উভয়ের অধিকারই রক্ষা করতে হবে।

সমকাল: কৃষকের লাভের গুড় কি মধ্যস্বত্বভোগীরা খাচ্ছে বলে মনে করেন?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: মধ্যস্বত্বভোগীরা নানাভাবেই কৃষকের লাভের অংশীদার হচ্ছে। সার, বীজ পাওয়া থেকে শুরু করে কৃষিপণ্য বিক্রি, এমনকি ঋণসুবিধা ও প্রণোদনা ভর্তুকি- সবক্ষেত্রেই মধ্যস্বত্বভোগীরা লাভবান হচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রেই তারা কৃষকের চেয়ে বেশি লাভ করছেন। কৃষকের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ ও কৃষি বিপণন ব্যবস্থা চালুর মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

সমকাল: কৃষকের জন্য শস্যবীমা চালু করা কতটা প্রয়োজন?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: কৃষির জন্য শস্যবীমা চালু করা অত্যন্ত জরুরি। কয়েক বছর আগে অর্থমন্ত্রী শস্যবীমা চালুর কথা বলেছেন। কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হলে কিংবা শস্য উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটলে শস্যবীমার মাধ্যমে কৃষক ক্ষতিপূরণ পেতে পারেন। আমাদের বিপুল সংখ্যক কৃষকের অধিকাংশই প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষক বলে শস্যবীমার গুরুত্ব তারা সেভাবে অনুধাবন নাও করতে পারেন। বিষয়টি তাদের বোঝানোর পাশাপাশি সরকার প্রিমিয়াম নিয়ে শস্যবীমা চালু করতে পারে।

এরপর কয়েক কিস্তিতে তাদের কাছ থেকে তা আদায় করা যেতে পারে।

সমকাল: বাজেটের মাধ্যমে সরকার কীভাবে কৃষি গবেষণায় উৎসাহ দিতে পারে?

আবদুল লতিফ মণ্ডল: আমাদের দেশে কৃষি গবেষণায় বেশি জোর দেওয়া দরকার। সেজন্য বাজেটে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ রাখা উচিত। বিশেষ করে, যেভাবে দিন দিন কৃষি জমি কমছে, সেই অনুপাতে জমির উৎপাদনশীলতা না বাড়লে খাদ্যে ঘাটতি দেখা দেবে। জমির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে গবেষণার বিকল্প নেই। একই সঙ্গে কৃষিজমির যাতে অপচয় না হয়, সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া চাই।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ।

আবদুল লতিফ মণ্ডল: ধন্যবাদ। সমকালের জন্য শুভকামনা।

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।