জন্ম হোক যথা তথা কর্ম হোক ভালো। এই প্রবাদের মতোই প্রত্যাশা থাকবে- এবারের উচ্চ মাধ্যমিকের পরীক্ষা না হোক কিংবা ফল যা-ই হোক উচ্চ শিক্ষায় ভর্তি ঠিকভাবে হওয়া চাই। সে লক্ষ্যেই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির তোড়জোড় শুরু হয়েছে বলে ৬ ফেব্রুয়ারির সমকালের প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি। কার্যত অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই ভর্তি পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা করা হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের সময়ও শেষ হয়ে আসছে। এগুলো অবশ্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। বস্তুত সংবাদপত্রের প্রতিবেদনগুলোতে বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আলোচনাই বেশি আসে। অথচ শতাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও যেভাবে শিক্ষার্থীরা ভর্তি হচ্ছে, দিনে দিনে যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উচ্চশিক্ষায় প্রভাব ও ভূমিকা রাখছে; সেখানকার ভর্তিযজ্ঞের খবর এখন অনেকেরই আগ্রহের বিষয়।
সমকালের প্রতিবেদন থেকেই অবশ্য আমরা জানছি, 'দেশের ৪৬টি সরকারি ও ১০৪টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য পা রাখবেন লাখ লাখ শিক্ষার্থী।' এ বছর পাবলিক তথা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সুখবর হলো, অধিকাংশই গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তি পরীক্ষার মাধ্যমে যাচ্ছে। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের মতো পরীক্ষা নেবে। কিন্তু এদের কোনো প্রতিষ্ঠান এখনও ভর্তি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেনি। এমনকি সংবাদমাধ্যমের তরফে আমরা জানছি, এপ্রিলের আগে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ভর্তি পরীক্ষা হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। এমনিতেই সবকিছু দেরি হয়ে গেছে, তারপরও অবস্থার দোহাই দিয়ে এভাবে পরীক্ষা পিছিয়ে দেওয়ার যুক্তি কী?
ইতোমধ্যে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হয়ে যাওয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই দোটানায় পড়বেন। কেউ হয়তো এখানে ভর্তি হয়ে থাকবেন, পরে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলে সেখানে চলে যাবেন। অথচ প্রতিটি ভর্তিতেই খরচ ও সময়সাপেক্ষ বিষয়। উদাহরণ হিসেবে ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস তথা বিইউপির কথা বলা যায়। বিইউপি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় থাকলেও খরচের দিক থেকে সরকারি-বেসরকারির মাঝামাঝি। বিইউপির অনার্সের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে এ মাসে ২৬ ও ২৭ ফেব্রুয়ারি। বিশ্ববিদ্যালয়টির লিখিত পরীক্ষা একযোগে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া ও খুলনায় অনুষ্ঠিত হবে। বিইউপির বিজ্ঞপ্তিতে ভর্তি বাতিলের বিষয়টিও এসেছে। ক্লাস শুরু হওয়ার আগে ভর্তি বাতিল করতে চাইলে শিক্ষার্থী ভর্তি ফির নব্বই শতাংশ ফেরত পাবেন, ক্লাস শুরুর ১৫ ও ৩০ দিনের মধ্যে বাতিল করলে ৭৫ ও ৫০ শতাংশ ফি ফেরত পাবেন। কিন্তু ৩০ দিনের পর কোনো ফি ফেরত দেওয়া হবে না। স্বাভাবিকভাবেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি কার্যক্রম শুরু হলে অনেকেই এই বিড়ম্বনায় পড়বেন। অনেকে এবারের উচ্চশিক্ষায় আসন সংকটের কথা বলেছেন। আসলে এবার কোনো আসন সংকট নেই। তবে প্রত্যাশিত জায়গায় অনেকেই ভর্তি হতে পারবেন না। এবার এক লাখ ৬১ হাজার জিপিএ ৫ এর মধ্যে শুধু বিজ্ঞান শাখায় পেয়েছেন এক লাখ ২৩ হাজার ৬২০ শিক্ষার্থী। অথচ দেশে মেডিকেল ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন অনেক কম। ফলে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তীব্র প্রতিযোগিতা হবে। সে অর্থে ভালো ফল নিয়েও অনেকে কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারবে না, আবার অনেকে অপেক্ষাকৃত কম ফল দিয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ভালো করে ভর্তি হতে পারেন। এটা অবশ্য অন্যান্য বছরও আমরা দেখে আসছি। তবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বিদেশেও অনেকে পড়তে পারেন। এ হার কিন্তু প্রতিবছরই বাড়ছে।
এবার আরেকটি সংকট হলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির নূ্যনতম স্কোর থাকা সত্ত্বেও ভর্তি পরীক্ষা দিতে পারবেন না অনেক শিক্ষার্থী। বিশেষ করে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এমনই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সেখানে যোগ্যতা অনুযায়ী ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা কোনো ফি ছাড়াই আবেদন করবেন। এরপর আবেদন করা প্রার্থীদের যাচাই-বাছাই করে নির্ধারিত সংখ্যক প্রার্থীদের ভর্তি পরীক্ষার সুযোগ দেওয়া হবে। যারা ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার জন্য যোগ্য হবেন, তারা ৫০০ টাকা ফি দিয়ে আবার আবেদন করবেন। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হঠাৎ করে এমন সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে? এটা বলা যায়, যাদের জিপিএ ভালো, তারাই ভর্তি পরীক্ষায় বসার সুযোগ পাবেন। যদি একই জিপিএ একাধিক শিক্ষার্থীর থাকে, তখন বিষয়ের নম্বর বিবেচনা করা হবে। এর পক্ষে যুক্তি থাকতে পারে। কিন্তু এ বছরই এমন সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিগ্রাহ্য? এ ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উচিত যত বেশি শিক্ষার্থীকে সুযোগ দেওয়া যায়, সে ব্যবস্থা করা। আমরা দেখেছি, নূ্যনতম যোগ্যতা নিয়েও অনেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে তীব্র ভর্তি প্রতিযোগিতায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হয়েছেন। যারা পরবর্তী সময়ে ভালো করেছেন।
গুচ্ছ পরীক্ষায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরেকটি সুযোগের সংকোচন ঘটিয়েছে, তারা বিভাগ পরিবর্তনের জন্য আলাদা কোনো পরীক্ষা নিচ্ছে না। এ বিষয়ে অনেকেই আগেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন, শিক্ষার্থীরা আলাদাভাবে ভর্তির জন্য আন্দোলন করেছে। আমিও সমকালেই লিখেছিলাম। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দুঃখজনকভাবে তাদের আগের সিদ্ধান্তই বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।
এবারে উচ্চশিক্ষায় মেধা তালিকা তৈরিতে উচ্চমাধ্যমিকের ফলে গুরুত্ব না দেওয়াই যুক্তিযুক্ত। সেটা ধরতে গেলে শিক্ষার্থীর এসএসসি পর্যায়ের ফল দুইবার গুরুত্ব দেওয়া হবে। আগে আমরা দেখেছি, বিশেষ করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তি পরীক্ষার ফলের সঙ্গে এইচএসসি ও এসএসসির ফল যোগ করে মেধা তালিকা করত। যেখানে স্বভাবতই উচ্চমাধ্যমিকের ফল দ্বিগুণ গুরুত্ব পেত। এবার তেমনটা করলে অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আগের ফল ধরলেও সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ হিসেবে যোগ করা যেতে পারে। ফলে ভর্তি পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে হলে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে আমরা কাঙ্ক্ষিত মেধাবীদেরই পাব।