সতর্কতা, সচেতনতা, কাণ্ডজ্ঞান, জীবনবোধ- এগুলোই 'মানুষ' হওয়ার মূল বিবেচ্য। অনেকে বলেন, মানুষ মানে যার মান ও হুঁশ দুটিই রয়েছে। এগুলো ছাড়া মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেই অসম্পূর্ণ, ব্যক্তিত্বহীন কিংবা ভয়ঙ্কর। যার পরিণতিও ভয়াবহ। মঙ্গলবার সমকালের শেষ পাতায় প্রকাশিত 'বিয়ের গাড়িতে ট্রেনের ধাক্কা, বর-কনেসহ নিহত ১০' শিরোনামের প্রতিবেদনটি তার অন্যতম উদাহরণ। সোমবার সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় অরক্ষিত রেলক্রসিংয়ের বলি হলো এ মানুষগুলো। অরক্ষিত লেভেলক্রসিংয়ের জন্য রেল কর্তৃপক্ষের দায় অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু এখানেও যে সতর্কতা ও সচেতনতার ব্যত্যয় ঘটেছে, তা অস্বীকারের জো নেই।
এটা ঠিক যে ঘটনাটি মর্মান্তিক, ট্র্যাজিক ও হৃদয়বিদারক। দুর্ঘটনায় যে কোনো মৃত্যুই আমাদের জন্য বেদনার। তারপরও কিছু ঘটনা দাগ কাটে। এ দুর্ঘটনায় বর-কনের মেহেদির রঙ শুকাবার আগেই উভয়ের মৃত্যু হলো। অথচ কিছুক্ষণ আগেই তাদের বন্ধন হলো; সুখী ও দীর্ঘস্থায়ী একটি দাম্পত্য জীবনের স্বপ্ন হয়তো তাদেরও ছিল। তাদের স্বপ্নের যেমন মৃত্যু হয়েছে; একই সঙ্গে বিয়ের যাত্রী হিসেবে দুই পরিবারের স্বজনরাই প্রধানত হতাহত হয়েছে। পরিবার দুটি এমন শোক কেমনে সইবে!
বলা বাহুল্য, লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা নতুন নয়। আমাদের রেলক্রসিং যখন অরক্ষিত, তখন জীবন সুরক্ষিত থাকবে- এ চিন্তা বাতুলতা বৈ কিছু নয়। সংবাদপত্রের তরফে জানা যাচ্ছে, সারাদেশে রেল নেটওয়ার্কে মোট দুই হাজার ৫৪১টি লেভেলক্রসিং আছে। যার মধ্যে অনুমোদিত ক্রসিংয়ের সংখ্যা ৭৮০টি। বাকি এক হাজার ৭৬১টিই অনুমোদনহীন। আবার ৭৮০টি অনুমোদিত ক্রসিংয়ের মধ্যেও রক্ষী বা গেটকিপার আছে মাত্র ২৪২টিতে। অনুমোদিত রেলক্রসিংয়েরই যেখানে দুই-তৃতীয়াংশের বেশির রক্ষী নেই, সেখানে অনুমোদনহীনগুলোতে থাকার প্রশ্নই আসে না। ফলে রেলক্রসিংগুলোতে দুর্ঘটনা লেগে থাকাই স্বাভাবিক।
বোঝাই যাচ্ছে, এটি রেল কর্তৃপক্ষেরও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। কারণ রেলকে তোয়াক্কা না করেই নানা জায়গায় গড়ে উঠেছে রেলক্রসিং এবং এ সংখ্যাটি অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। আমরা অবশ্যই চাইব রেল কর্তৃপক্ষ বিষয়টিতে নজর দিক। অনুমোদিত লেভেলক্রসিংয়ের প্রত্যেকটি রক্ষী নিয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। আর অনুমোদনহীন রেলক্রসিংয়ের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে হবে। যেখানে রেলক্রসিং প্রয়োজন, সেখানে তার অনুমোদন ও সুরক্ষার ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
বিদ্যমান বাস্তবতায় যখন অধিকাংশ রেলক্রসিং অরক্ষিত, যখন যেখানে-সেখানে মানুষ রেলক্রসিং বানিয়ে নিচ্ছে, যেখানে রেল কর্তৃপক্ষও রেলক্রসিংয়ের নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ, সেখানে জননিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে কেবল সতর্কতা ও সচেতনতা। এর জন্য রক্ষী বা গার্ডের প্রয়োজন নেই, পুলিশি পাহারার দরকার নেই। সতর্ক ও সচেতন ব্যক্তি নিজেই তার সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট। আমরা জানি, চলন্ত ট্রেন চাইলেই হঠাৎ করে থামানো যায় না। কিন্তু চাইলেই নিজেকে হঠাৎ করে থামানো যায়, হঠাৎ করে সাইকেল-রিকশা-গাড়ির ব্রেক কষা যায়। বিষয়টি যখন আমরা জানছি, তখন ট্রেন আসার আগেই সতর্ক হয়ে নিজের বাহন নিয়ন্ত্রণে নিলে দুর্ঘটনা থেকে বাঁচা সম্ভব। এমনিতে ট্রেন খুব শব্দ করেই চলে, আবার ট্রেনের হুইসেল অনেক দূর থেকেই শোনা যায়। তা শুনে সচেতন হওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ।
অনিয়ম, দুর্ঘটনা ও অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত রেল। গত মাসেও রেলসেতু ভেঙে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটে। তারপরও প্রধানত ব্রিটিশ আমল থেকে চালু হওয়া ঐতিহ্যবাহী এ রেলপথের ওপর ভরসা রাখছে মানুষ। যাতায়াতের প্রয়োজনে এ পথটি সুবিধাজনক হলেও দুর্ঘটনা পিছু ছাড়ছে না, বিষয়টি কর্তৃপক্ষ বিবেচনা করবে।
তবে রেলক্রসিংয়ের দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখতে হবে আমাদেরই। অরক্ষিত রেলক্রসিংকে সুরক্ষিত করতে আমাদের সামান্য সতর্কতাই যথেষ্ট। আর এ সতর্কতা-সচেতনতা জীবনের সব ক্ষেত্রেই প্রয়োজন।