Mahfuzur Rahman Manik
স্যালুট চাকা!

প্রায় ১০ বছর আগে মার্কিন সাময়িকী স্মিথস অনিয়ানে 'অ্যা স্যালুট টু দ্য হুইল' শিরোনামে একটি ফিচার প্রকাশ হয়। সেখানে লেখক মেগান গাম্বিনো চাকাকে স্যালুট জানিয়েছেন। এই স্যালুট একেবারে সাদামাটা অর্থে কোনো অভিবাদন নয়, এর গোড়া আরও গভীরে।
সৈয়দ শামসুল হক ২০১২ সালে কালের খেয়ায় ধারাবাহিক এক উপন্যাস লেখেন, যার শিরোনাম- 'কেরানীও দৌড়ে ছিল'। উপন্যাসের বিষয় যা-ই হোক, তিনি দেখিয়েছেন, কেরানি তো বটেই, আসলে আমরা সবাই দৌড়াচ্ছি। জীবনযাপনের জন্য সবাইকে দৌড়াতে হয়। জীবনের এ দৌড় শুধু দু'পায়ে হয় না, বরং সময়ের যত আধুনিক ও দ্রুতযান আছে সবই অন্তর্ভুক্ত। আর যখনই যানবাহনের কথা আসছে তখনই হাজির চাকা। আজ চাকা ছাড়া জীবনের কোনো গতিই নেই।

চাকা আবিস্কার
বলাবাহুল্য, মানবসভ্যতার ইতিহাসে চাকার আবিস্কার একটি যুগান্তকারী ঘটনা। তবে কোথায় কখন এ চাকা আবিস্কার হয়, তার অকাট্য প্রমাণ নেই বললেই চলে। ফলে এ আবিস্কার নিয়ে রয়েছে নানা মুনির নানা মত। অবশ্য বিশেষজ্ঞ অনেকেই মনে করেন, যিশুখ্রিষ্টের জন্মের ৫০০০ বছর আগে তথা আজ থেকে ৭০০০ বছরেরও বেশি আগে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় (বর্তমান ইরাকের একটি সভ্যতা) চাকা আবিস্কৃত হয়। ককেশাসের উত্তর দিকে বেশকিছু কবর পাওয়া গেছে, যাতে ৩৭০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ঠেলাগাড়িতে করে মৃতদেহ কবর দেওয়া হতো। ৩৫০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি সময়ে তৈরি করা একটি মাটির পাত্র দক্ষিণ পোল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যাতে চার চাকার একটি গাড়ির ছবি আছে। এটিই এ পর্যন্ত প্রাপ্ত চাকাযুক্ত গাড়ির ছবির সবচেয়ে পুরনো নিদর্শন বা চিহ্ন। মনে করা হয়, গাছের গোল গুঁড়ি গড়িয়ে যেতে দেখে চাকার ধারণা আসে মানুষের মাথায়। তারা গুঁড়িটি পাতলা করে কেটে তার মাঝখানে ছিদ্র করে লাঠির মতো কিছু দিয়ে চাকতি দুটিকে যুক্ত করেছে। আর তাতেই তৈরি হয়েছে আদিম গাড়ি। ওই গাড়ির সঙ্গে বর্তমানের গরুর গাড়ির কিছুটা মিল থাকতে পারে। পরে নানাভাবে চাকার বিবর্তন হয়েছে। কাঠের চাকা দ্রুত ক্ষয়ে যাওয়া এবং ফেটে যাওয়ায় এতে লোহার পাতলা পাত লাগানো হয়। একপর্যায়ে পাতের জায়গা দখল করে পাতলা রাবার। সর্বশেষ রাবারের চাকা ও টিউব আবিস্কৃত হয়।

চাকায় জীবনের গতি
যখন চাকা ছিল না, সে সময়ের কথা ভাবা যায়! আমরা অনেকেই হয়তো দাদি-নানিদের গল্পে শুনেছি, তাদের আগের প্রজন্ম কীভাবে দূরদেশে যেতেন। কেউ হয়তো এক মাসের জন্য হজে যাবেন, তাকে পথেই কাটাতে হতো এক বছর কিংবা ছয় মাস। মানুষ কাঁধে করে, মাথায় নিয়ে অথবা ঘোড়ার মতো পালিত পশুর গায়ে চাপিয়ে মালপত্র নিয়ে যেত এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়।
একবার দূর দেশে কিংবা কাছাকাছি অন্য কোনো শহরে গেলে হয়তো মাসকে মাস তার খোঁজ-খবর থাকত না। আজ যখন আমরা বিমানে পাঁচ হাজার কিলোমিটারেরও অধিক দূরত্বের সৌদি আরবে ছয় ঘণ্টায় পৌঁছে যাই, তখন সে সময়ের কথা অবিশ্বাস্যই শোনায়। কেউ কেউ ভাবতে পারেন বিমানে বুঝি চাকা নেই। না, বিমানেও চাকা আছে। একাধিক চাকা। যেমন- বি৭৭৭ বিমানের ১৪টি চাকা থাকে, সামনে দুটি আর পেছনে ১২টি। তাছাড়া গ্রাম-গঞ্জ-শহর-বন্দর সর্বত্র আমরা যাদের মাধ্যমে দাপিয়ে বেড়াই- সাইকেল, রিকশা, মোটরবাইক, গাড়ি প্রত্যেকটিই চাকার ওপর নির্ভরশীল। এ চাকা আমাদের জীবনে গতি এনেছে। আপনি ধরুন কয়েকশ' কিলোমিটার দূরত্বের রাজধানীতে এখন কয়েক ঘণ্টায় যেতে পারছেন গাড়িতে, যদি হেঁটে যেতেন; কতদিন লাগত?

চাকা ও কর্মসংস্থ্থান
চাকা শুধু গতিই দেয়নি, দিয়েছে মানুষের কর্মসংস্থানও। আজকের যানবাহন চালক ছাড়া অচল। সারা পৃথিবীতে কত কোটি বাস, ট্রাক, গাড়ি আছে, তার চালক সংখ্যা কত? সহজে তা নির্ণয় করা সম্ভব নয়। আবার একটা যানবাহনে তো শুধু চালকই থাকেন না। তার ব্যবস্থাপনায় নানাভাবে জড়িত থাকে অনেক মানুষ। দেশের কথাই ধরুন। বিশাল বড় রেলগাড়ির চালক হয়তো দু'জন। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িয়ে যাদের কর্মসংস্থান, তাদের তালিকাটা বেশ দীর্ঘ। ট্রেন ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে টিকিট চেকার এমনকি ট্রেন আসার আগে যারা মানুষকে সতর্ক করেন তারাও জড়িত। আবার প্রতিটি বাসে চালকের বাইরেও থাকেন কন্ডাক্টর, হেলপার। অটোরিকশাচালক, রিকশাওয়ালা প্রত্যেকের জীবীকা কিন্তু ওই চাকার বাহনটিই। দেখাই যাচ্ছে আমাদের কর্মসংস্থানের একটা বিরাট অংশে রয়েছে চাকার অবদান।

চাকার দাপট
যার চাকা যত দ্রুত ঘুরছে তার জীবনের গতি তত বেশি। একই সঙ্গে যার চাকা যত দ্রুত ঘুরছে তার দাপটও তত বেশি- বলাও হয়তো অত্যুক্তি হবে না। আপনি যেখানে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাওয়ার সময়ের হিসাব কষছেন ঘণ্টায়, আরেকজন বিমানে গিয়ে হিসাব কষছে মিনিটে। কারও বাইসাইকেলের গতি মোটরসাইকেল এসে ম্লান করবেই। আপনি বড় খামারি, আপনার কৃষিপণ্য ট্রাকের গতিতে রাজধানীতে পৌঁছাবেই। ট্রাক না হয়ে যদি ভ্যান বা রিকশায় আপনি পৌঁছাতেন, হয়তো রাস্তায়ই পচতো আপনার জিনিস। আপনার টাকা আছে, দাপট আছে- সেটা বোঝাচ্ছে আপনার বাড়ির পাশাপাশি একটা গাড়িও আছে। আপনার মার্সিডিজ-বেঞ্জ, বিএমডব্লিউ, ল্যান্ডক্রুজারই বলে দিচ্ছে আপনার স্ট্যাটাস। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন কিংবা হাঁটছেন, আপনার সামনে দিয়ে দ্রুতগতিতে সাঁই সাঁই করে চলে যাওয়া গাড়িটির দিকে তাকিয়ে আপনি হয়তো তার দাপটের কথা চিন্তা করছেন। এটা আসলে তার নয়, চাকার দাপট।
পৃথিবীর হাতে গোনা যে কয়েকটি আবিস্কার মানবসভ্যতাকে এগিয়ে দিয়েছে তার অন্যতম চাকা। চাকা আমাদের জীবনকে কতটা সহজ করেছে তা কল্পনাও করা যায় না। এ চাকাকে স্যালুট না জানিয়ে উপায় আছে?

ট্যাগঃ , , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।