Mahfuzur Rahman Manik
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নপত্র ফাঁস ও আমাদের দায়ভার
অক্টোবর 25, 2018
কার্জন হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ হিসেবেই নয় বরং নানা কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জাতির আশা-আকাঙ্খার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। জ্ঞানচর্চার বাইরেও ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অন্যায়ের প্রতিবাদের কেন্দ্র হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি যেভাবে ভূমিকা পালন করে আসছে তাতে দেশের মানুষের স্বপ্ন জড়িয়ে আছে এর সঙ্গে। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হিসেবে খ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়টিতে যখনই খারাপ কিছু ঘটে আমরা ব্যথিত হই।  নানাদিক থেকেই অতীতের সঙ্গে তুলনা করে অনেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অবনতি’ দেখেন। সেটা ধরেও বলা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরর গৌরব, গরিমা, ঐতিহ্য, দাপট এখনও অটুট, অক্ষুণ্ন। তবে সম্প্রতি তাতে চির ধরেছে সে মন্তব্য করাও অমূলক নয়।

সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়টির ঘ ইউনিটের ভর্তির পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। প্রশ্ন ফাঁসের কারণে যে বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিবাদের প্রতীক তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ হয়েছে, এখনও হচ্ছে। প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার ২৩ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন’স কমিটির সভায় আবারও ঘ ইউনিটের পরীক্ষার সিদ্ধান্ত  হয়। কিন্তু জটিলতা এখনও কাটেনি, কারণ যতটুটু জানা যাচ্ছে, আগের পরীক্ষায় পাসকৃত কেবল ১৮ হাজার শিক্ষার্থীরই পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তাতে বাদ পড়বে ৫৭ হাজার শিক্ষার্থী। তবে ঘটনা যা-ই ঘটুক ডিন কমিটির এ সিদ্ধান্তে এটাই স্পষ্ট যে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রশ্ন ফাঁস স্বীকার করেছে এবং আমলে নিয়েছে।

স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ফাঁসের প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা দাঁড়িয়েছেন। এটা খুবই লজ্জার, যখন আমরা দেখলাম ১২ অক্টোবর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের অনুষ্ঠিত পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসের ঘটনার পরেও ফল প্রকাশ করা হয়। প্রথমে পরীক্ষার ফলাফল স্থগিত, তদন্ত কমিটি গঠনসহ কয়েকজন অভিযুক্তকে গ্রেফতার করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। কিন্তু পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটিতেই ফল ঘোষণা করা হয়। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনার সত্যতা স্বীকার করেন। তিনি জানান, এবার ৯ টা ১৭ মিনিটে ফাঁস হয়েছে; ক্রমান্বয়ে ক্লোজ ফ্রেমে নিয়ে আসবেন।

ফল ঘোষণার সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নিতে পারেনি। সবাই দাবি করেছিলো- ঘ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষা ও ঘোষিত ফল বাতিল করতে হবে, প্রশ্নফাঁসে জড়িতদের গ্রেফতার ও বিচার এবং ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষায় দায়িত্বরত সংশ্লিষ্টদের পদত্যাগ করতে হবে।

প্রথমে প্রতিবাদে কান দেননি প্রশাসন। এটা অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয় যে প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ স্বীকার করেও কীভাবে তার ফল ঘোষণা করা হলো। নিয়মানুযায়ী নতুন করে তারিখ ঘোষণা করে পরীক্ষা নেওয়া-ই তো ছিলো স্বাভাবিক বিষয়। অথচ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন প্রথম দিকে স্বাভাবিক পথে হাটলেন না। ফল ঘোষণা অযৌক্তিক, অস্বাভাবিক, নৈতিকতা বিরোধী ছিলো। প্রকাশিত ফলে বিস্ময়করভাবে আমরা দেখলাম এমন একজন প্রথম হলেন, যিনি গ ইউনিটে ফেল করেছিলেন কিন্তু বাংলায় তিনি ৩০ এর মধ্যে পুরো ৩০ পেয়েছেন!

এর মধ্যে সোমবার আবার ‘নিবিড় তদন্ত কমিটি’ গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। ক্ষোভ-বিক্ষোভ আন্দোলনের মধ্যে কমিটি ঘোষণা করা হয়। অথচ সবার দাবি ছিলো নতুন করে পরীক্ষা নেওয়ার। বলার বিষয় হলো, এই সেই কমিটি গত বছরও যখন ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ উঠে তখন এদের নিয়েই তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। তাদের সেই তদন্তের প্রতিবেদন এক বছরেও আলোর মুখ দেখেনি। আমরা জানি না ‘নিবিড়’ তদন্তের এ কমিটি কতটা ‘নির্জীব’ থেকে আবার একটা বছর পার করে দিবেন। এর মধ্যে আবার নতুন করে উত্তীর্ণ ১৮ হাজার শিক্ষার্থীর পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার ঘোষণা এলো।

আমরা ভুলিনি গত বছর যে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের আন্দোলন হয়েছে, এ বছর ঠিক একই সময়ে একই আন্দোলন হচ্ছে! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ কলঙ্ক কি চলতেই থাকবে? এরকম মারাত্মক অভিযোগেও আমরা বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করি, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দায়সারা গোছের কাজ করেন। নামকাওয়াস্তে লোক দেখানো কমিটি করেন। প্রশাসনের মনে রাখা উচিত, মানুষের টাকায় চলা পাবিলক বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৬ কোটি মানুষের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে।

আমাদের মনে আছে, ২০১০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) ভর্তি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগে আইইআরের স্বতন্ত্র ভর্তি পদ্ধতি বাতিল করা হয়। এর পরিবর্তে ‘খ’ ও ‘ঘ’ ইউনিটের পরীক্ষার মাধ্যমে ইনস্টিটিউটের ভর্তি নেওয়া হয়। উল্লেখ্য ইনস্টিটিউট হিসেবে আইবিএ স্বতন্ত্র পরীক্ষা নেয়।  আইইআরেও অনার্স ভর্তি পরীক্ষায় ১০টি বিষয় হতে পরীক্ষা হতো। সে পরীক্ষা পদ্ধতি আইইআরের জন্য স্বতন্ত্র হলেও প্রশ্ন ফাঁসের অজুহাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তে তা খ ও ঘ ইউনিটের সঙ্গে একীভূত করা হয়। আইইআরের আন্দোলনের পরও স্বতন্ত্র পদ্ধতি আর ফেরেনি। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হিসেবে হয়তো ছিলো উত্তম সিদ্ধান্ত। বিষয়টি বলার কারণ হলো, তখন প্রশাসন যেরূপ তৎপর ছিলো, এখন যেন তা অনুপস্থিত।

আমরা বলছি, অন্ধ হলে প্রলয় বন্ধ থাকে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও তা নিশ্চয়ই জানেন। প্রশাসন যেভাবে গোঁজামিল দিয়ে একের পর এক সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলছে। প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে যারা যেভাবেই প্রশ্ন ফাঁসের কেলেঙ্কারির সঙ্গে জড়িত তাদের খুঁজে বের করে শাস্তির আওতায় আনা জরুরি। দায়ী ব্যক্তি যত প্রভাবশালী, ক্ষমতাবান কিংবা পদস্থই হোন না কেন তাকে রেহাই দেওয়া যাবে না। একইসঙ্গে নতুন করে পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা চাই। সে পরীক্ষা অবশ্যই বিনা ফিতে নিতে হবে এবং তাতে প্রথম পরীক্ষায় অংশ নেওয়া পুরো ৭৫ হাজার শিক্ষার্থীকেই সুযোগ দেয়া একটি যৌক্তিক দাবি। কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে হয়তো কিছুটা হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চির ধরা গৌরব, গরিমা, ঐতিহ্য বাঁচানো যাবে। না হলে বর্তমান প্রশাসনকে আজীবন এই কেলেঙ্কারির বোঝা বইতে হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাবী ও যোগ্যদের জায়গা নিশ্চিত করুন; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম পুনরুদ্ধার করুন।

ট্যাগঃ , ,

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।