বিখ্যাত, ক্ষমতাশালী কিংবা জনপরিচিতদের সঙ্গে 'সম্পর্ক' থাকার কথা উচ্ছ্বাসের সঙ্গে প্রকাশ করা মানুষের সাধারণ প্রবণতা। তাদের আপনজন, নিকটাত্মীয়-দূরাত্মীয়, পরিচিত এমনকি অপরিচিতজনও হয়তো এই 'সম্পর্কে'র কথা বলেন। কোনো সন্তান যেমন বলতে পারে, এই আমার বাবা কিন্তু সচিব। কেউ আবার বলবে, আমার দুলাভাইয়ের মামা কিন্তু এমপি। কিংবা কেউ বলবে, অমুক মন্ত্রী কিন্তু আমাদের পাশের এলাকার। আবার কেউ হয়তো কোনো লিংক খুঁজবে, অমুক নায়ক কিন্তু আমার এক আত্মীয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে এসেছিল। হুমায়ূন আহমেদ এই ছাত্রাবাসে একসময় ছিলেন, আর সেখানে আমি এখন থাকি_ কারও কাছ থেকে এরকম শোনাও অসম্ভব নয়। হুমায়ূন আহমেদের (১৩ নভেম্বর, ১৯৪৮ – ১৯ জুলাই, ২০১২) প্রসঙ্গ যখন এসেছে, বলে নেওয়া ভালো, তার মৃত্যুর পর এ রকম 'সম্পর্কের' অসংখ্য সূত্র ধরে অনেকের লেখা পাঠক দেখে থাকবেন।
বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমানের সঙ্গে 'সম্পর্কে'র এ রকম একটা সূত্র খুঁজছিলাম। বিবৃত কোনো সূত্রই খাটল না। তারপরও একটা সূত্র আবিষ্কার করা গেছে যা হয়তো একেবারে ফেলনা নয়। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করার পর গত বছরের সমাবর্তনের কথা মনে পড়ছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদাধিকারবলে চ্যান্সেলর বা আচার্য। তার পরে থাকেন উপাচার্য বা ভাইস চ্যান্সেলর, যিনি কার্যনির্বাহী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাত্যহিক নানাবিধ কর্মকাণ্ডে উপাচার্যের দেখা মিললেও আচার্যের দেখা মেলা ভার। শিক্ষার্থী হিসেবে সরাসরি সেই আচার্যের দেখা মিলল আমাদের সমাবর্তনে। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৬তম সমাবর্তন ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯০ বছরের মধ্যে ইতিহাস, যেখানে তখন পর্যন্ত সর্বাধিকসংখ্যক ১৬ হাজার ৮২৬ জন শিক্ষার্থী 'গ্র্যাজুয়েট' সনদ পেয়েছিলেন। এসব সৌভাগ্যবানের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম। সমাবর্তনে সবাইকে সনদ দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি হিসেবে তখনকার আচার্য মো. জিল্লুর রহমান।
তার সঙ্গে নিজের 'সম্পর্ক' প্রমাণে এর চেয়ে বড় সূত্র আর নেই। অবশ্য আর কিইবা হতে পারে। সমাবর্তনকে ঘিরে শিক্ষার্থীদের যে আবেগ, উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা আর আনন্দ তার পেছনে নানা কিছু থাকলেও মূলে কিন্তু একটাই_ সার্টিফিকেট। চার-পাঁচ বছর পড়াশোনার আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি। সেই স্বীকৃতি দেন আচার্য, রাষ্ট্রপতি। যেমনটা আমাদের দিয়েছিলেন তিনি। শান্ত, সৌম্য এই মানুষটির কণ্ঠ আজ ভালোভাবেই মনে পড়ছে। সমাবর্তন বক্তৃতায় তিনি ছাত্রসমাজের গৌরবোজ্জ্বল দিকের কথা বলছিলেন, বর্তমানে যে অনেকটাই ম্লান তা বলতেও ভোলেননি। গৌরবোজ্জ্বল সেই দিনগুলোতে যে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তা স্মরণ হতেই বিনম্র শ্রদ্ধায় মাথা নুইয়ে আসছে।
লেখাটা লিখতে গিয়ে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গেলাম, তখন যেন সম্পর্কের সূত্রটা আরও গাঢ়ই হলো। এখন চ্যান্সেলর হিসেবে নামটি লেখা আছে মো. জিল্লুর রহমান। সেখানে তার বিশাল ক্যারিয়ার লাইফ রয়েছে। যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থাকতেই ছাত্রদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ১৯৫৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয় গ্র্যাজুয়েট হয়েছেন আর আমি প্রায় আটান্ন বছর পর তারই হাত থেকে আমার গ্র্যাজুয়েশনের সনদপত্র নিয়েছি। এ সম্পর্ক কতটা শক্তিশালী আমি জানি না। তবে আজ বলতে পারছি, তিনি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথমদিককার অগ্রজ, তিনি আমাকে গ্র্যাজুয়েশনের সার্টিফাই করেছেন। তিনি আমাকে না চিনলেও তার প্রতি একটা টান রয়েছে, যেটা আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। সেটা নিয়ে লিখছি। তার সঙ্গে এই সম্পর্কোদ্ধারে এটাই প্রথম লেখা, হয়তো শেষ লেখাও। কারণ, তিনি যে আর দুনিয়ায় নেই। মাত্র চার দিন আগে চলে গেছেন, তার কাছ থেকে ব্যক্তিস্বার্থে বা বৈষয়িক কিছু প্রত্যাশা করি না। কিন্তু যে উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তিনি রেখে গেলেন, তা অনুসরণযোগ্য।