Mahfuzur Rahman Manik
পঞ্চম নয় অষ্টম শ্রেণীই সমাপনী পরীক্ষার সর্বোত্তম সময়
এপ্রিল 7, 2010

পঞ্চম নয় অষ্টম শ্রেণীই সমাপনী পরীক্ষার সর্বোত্তম সময়
মাহফুজুর রহমান মানিক

পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা আরম্ভ হলো গত বছর। সবাই এর ভালো দিকই তুলে ধরেছেন। জাতীয় পর্যায়ের একেকটি পরীক্ষা জীবনের একেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। সে ধাপে আমরা আমাদের শিশুদেরকে ১০/১১ বছরেই ঠেলে দিচ্ছি। যুদ্ধ যাকে বলে। গত বছরের মাঝামাঝি থকেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা হওয়ার জল্পনা কল্পনা চলছিলো। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে লেগে যায় সেপ্টেম্বর মাস। সেপ্টেম্বরের সাত তারিখের ঘোষণায় প্রাথমিক শিক্ষার সমাপনী পরীক্ষা নিশ্চিত হয় এবং শিক্ষার্থীরা তখন থেকে প্রস্তুতি নেয়। ২১ নভেম্বর শুরু হয় পরীক্ষা। সকাল বিকাল অর্থাৎ একদিন দুই বিষয় করে পরীক্ষা হয়। একদিন দুই বিষয় করে পরীক্ষা নেয়ার প্রয়োজন কী ছিলো? মানলাম সরকার প্রাথমিক বৃত্তি পরীক্ষা না নিয়ে তার পরিপূরক হিসেবেও এ পরীক্ষা নিচ্ছে। তাই বলে আগের বৃত্তি পরীক্ষার আদলে সকাল বিকাল পরীক্ষা নেওয়ার তো কোনো প্রয়োজন ছিলো না। একেতো ঘোষণাই হয়েছে দেরিতে, মাত্র দুইমাস আগে, তারওপর আবার দিনে দুই বিষয়ের পরীক্ষা। অবশ্য এসব কারণ থাকা সত্তেও শিশুরা যে পরীক্ষায় ভালো করেছে, তা ফলাফল দেখলেই বোঝা যায়। পরীক্ষা শেষ হওয়ার একমাসের মাথায়ই শিক্ষার্থীরা পেয়ে যায় তাদের কাঙ্খিত ফলাফল। মোট প্রায় ২০ লাখ শিক্ষার্থী এ পরীক্ষার জন্য রেজিষ্ট্রেশন করলেও অংশগ্রহণ করে ১৮ লাখ ২৩ হাজার ৪৬৫ জন। অর্থাৎ পরীক্ষার আগেই একটা অংশ ঝরে পড়লো। এরপর অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে পাশ করে মোট ১৬ লাখ ২০ হাজার ৫৪ জন। পাশের হার ৮৮.৮৪ ভাগ। যদিও এর মধ্যে গনিত ও ইংরেজীতে সর্বোচ্চ ১৩ নাম্বার গ্রেস দিয়ে আরো ৭ ভাগ শিক্ষার্থীকে পাশ করানো হয়। পাশের হার ৮৯ ভাগ ধরলেও এখানে ঝরে পড়েছে ১১ ভাগ শিক্ষার্থী। পাশ করা শিক্ষার্থীদের প্রথম বিভাগ পেয়েছে ৬ লাখ ৬৭ হাজার ৭১৭ জন। দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছে ৬ লাখ ১৫ হাজার ও তৃতীয় বিভাগ পেয়েছে ২৭ হাজার জন। অর্থাৎ ৪১.৭৭ পেয়েছে প্রথম বিভাগ, ৩৭.৯৮ ভাগ পেয়েছে দ্বিতীয় এবং ২০.২৫ ভাগ পেয়েছে তৃতীয় বিভাগ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের হিসেবে ৩৭ হাজার ২২৫ টি প্রতিষ্ঠানের সবাই পাশ করেছে‌। আর ১ হাজার ৯৩৭ টি প্রতিষ্ঠানের কোন শিক্ষার্থীই পাশ করতে পারেনি। প্রাথমিক শিক্ষায় ১১টি ধারা থাকলেও দুঃখজনক হলেও সত্য তার অন্যতম ধারা মাদরাসার শিক্ষার্থীরা গত বছরের সমাপনী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেনি। কর্তৃপক্ষ নাকি তাদের কথা ভুলে গেছে। এ বছর থেকে অবশ্য তাদেরকে অন্তর্ভূক্ত করা হবে। ফলে এবছর মাদরাসা পড়ুয়া কোনো শিক্ষার্থী এ সাধারণ ধারার ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারছেনা। যাই হোক সার্বিক বিবেচনায় প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা সফল সরকার ৫০ হাজার শিক্ষার্থীকে ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বৃত্তি দেবে। বেশ ভালো কথা। প্রাথমিক স্তরের সমাপনী পরীক্ষা চালু করার বিষয়ে কিছু যুক্তি দেখানো হয়েছে, ঝরে পড়ার হার কমানো, এনরোলমেন্ট বাড়ানো, আলাদাভাবে বৃত্তি ব্যবস্থা বাদ দেয়া ইত্যাদি। ঠিকই আছে, কিন্তু তাই বলে এস এস সি'র মতো দেশব্যাপী পাবলিক পরীক্ষার বোঝা শিশুদের মাথায় দেওয়া কতটা কল্যাণের। কম টাকার মধ্যে ফরম পুরণ করা গেছে ঠিক আগে। এ পদ্ধতির খারাপ দিক ও আছে। একটি দশ এগারো বছরের শিশুকে এভাবে পাবলিক পরীক্ষার দিকে ঠেলে দেওয়া মানে তার মাথায় একটা বোঝা চাপিয়ে দেয়া, যা বহন করতে সে সক্ষম নয়। এ বোঝা হলো পড়ার বোঝা। তার এবং তার অভিভাবকের মাথায় শুধু পাশ করার চিন্তা। ফলে শিশুর ধারণ ক্ষমতার বাইরের সময়ে তাকে পড়তে হবে। গত বছর দেখা গেছে অনেক অভিভাবকই আর সন্তানকে রাত ১২টা পর্যন্ত পড়িয়েছেন রাজধানীর ভর্তি যুদ্ধেও তাই হয়। ফলে এবার দেখা গেছে ভর্তি পরীক্ষা দিতে এসে পরীক্ষার হলেই ঘুমিয়ে পড়েছে। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনীতে ফলাফলের যে বিন্যাস তা ও শিশুসুলভ নয়। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিভাগ এ ভর্তির ফলাফল দেয়া হয়েছে। যে শিশু প্রথম বিভাগ পায়নি, তার মানে দ্বিতীয় ও তৃতীয় বিভাগ পাওয়ার বেদনা থাকতে পারে, যা তাকে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকেই কুকড়ে খাবে। সাথে সাথে আজীবন তাকে তৃতীয় শ্রেণীর সার্টিফিকেট নিয়ে থাকতে হবে। এরাতো পাশ করলো বলা যায়, কিন্তু যারা পরীক্ষায় পাসই করেনি তারা তো ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হতে পারছেনা। সে কী করবে? আরেকবার পরীক্ষা দেয়ার প্রেষণা সে কোথা থেকে পাবে। যেখানে তার সব সাথীরা তার উপরের শ্রেণীতে পড়ছে। এদেরকে পরবর্তী ধাপে ফিরিয়ে আনা যে কষ্ট হবে তা বলা যায়। দরিদ্র পিতামাতার পুনরায় পরীক্ষায় অংশ দিতে দেওয়ার প্রেষণা ফুরিয়ে যাবে। এবার যদিও ১১ভাগ শিশু পাশ করেনি, একটা বিরাট অংশ এ পরীক্ষায়ই অংশ নেয়নি। এদের জন্য সমাপনী পরীক্ষা কল্যাণের চেয়ে অকল্যাণই বয়ে আনবে। এবার আসা যাক ৮ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার বিষয়ে। যাকে বলা যায় জুনিয়র এসএসসি। কিছুদিন হল সরকার এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখানে ও বৃত্তি পরীক্ষার বিষয়টিকে বড় করে দেখানো হয়েছে। অর্থাৎ ৮ম শ্রেণীর বৃত্তি পরীক্ষা না হয়ে একেবারে সমাপনী পরীক্ষা। ৫ম শ্রেণীর চেয়ে ৮ম শ্রেণীর এ সমাপনী পরীক্ষাই যুক্তিযুক্ত। ৮ম শ্রেণীকে আমরা শিক্ষার একটা ধাপ বলতে পারি। শিক্ষার্থীদের বয়স ও কিছুটা বোঝার ১৩-১৪বছর। এ বয়সে তাদেরকে পাবলিক পরীক্ষার সম্মুখীন করাই যায়। অন্যদিকে এ স্তর অধিক উপযুক্ত, কারণ এবারের শিক্ষানীতিতে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা করার সুপারিশ করা হয়েছে ।শিক্ষানীতির এ প্রস্তাবনা চূড়ান্ত হলে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষা হবে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত। তখন প্রাথমিক স্তরের সমাপনী পরীক্ষা হিসেবে জাতীয় পর্যায়ে এসএসসির মত এ পরীক্ষা নেওয়া যায়। যার সার্টিফিকেট ও জীবনের সর্বস্তরে কাজে লাগানো যাবে। এখন যেমন সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন চাকরিতে ৮ম শ্রেণী পাশ করা প্রার্থী চাওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে এ পরীক্ষা বৈধ সার্টিফিকেট প্রার্থী দেখাতে পারবে। এখন দেখা যায় অনেকে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশুনা না করে ও যেকোন প্রতিষ্ঠান থেকে পাশের নকল সার্টিফিকেট সংগ্রহ করে নকল শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রমাণ দেখায়। এবারের শিক্ষানীতিতে ৬ষ্ঠ শ্রেণীর পর থেকে কারিগরি ভোকেশনাল তথা বাস্তবমুখী পাঠ্যপুস্তকের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তা যথোপযুক্ত। প্রথম শ্রেণী হতে ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত আট বছরের শিক্ষা জীবনের অর্জিত যেন তার জীবনের অর্জন হয়। অর্থাৎ ৮ম শ্রেণী পর্যন্ত পড়েও সে যাতে তার পরবর্তী জীবন সুন্দরভাবে পরিচালনা করতে পারে সেটি নিশ্চিত করা। ঠিক যে কারণে প্রাথমিক শিক্ষাকে ৫ম থেকে বাড়িয়ে ৮ম শ্রেণী করার প্রস্তাবনা এসেছে ,একই কারণে ৮ম শ্রেণী শেষে সমাপনী পরীক্ষা নেওয়া দরকার। সরকার একই সিলেবাসের কথা বলেছে। ৮ম শ্রেণী সমাপনী পরীক্ষায় একই সিলেবাস হলে মাদ্রাসা যাবে কোথায়? তাহলে কি গতবারের ৫ম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষার মতো অষ্টম শ্রেণীতে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের বঞ্ছিত করা হবে। অভিন্ন সিলেবাসের কথা যদি সকল ধারার সিলেবাস মত হতো। এবছর মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করতে মাদ্রাসা এবং স্কুলে দুই সিলেবাসে পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে। অবশ্য এ ব্যাপারে মাত্র সিদ্ধান্ত হয়েছে। তা বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে সভাপতি করে যে কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাদের সুপারিশ দেখা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। এখন থেকে ৫ম ও ৮ম শ্রেণী তথা উভয় স্তরে পরীক্ষা না নিয়ে কেবল ৮ম শ্রেণীতে সমাপনী নিলেই হয়। এতে এক দিকে শিক্ষার্থীও কল্যাণ অন্যদিকে নতুন শিক্ষানীতির সাথেও মিলানো যাবে।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।