Mahfuzur Rahman Manik
তাঁতিদের ঘুম-নির্ঘুম

রমজানের মাঝামাঝি পর্যায় এখন, দিন পনের বাদেই ঈদ। ঈদের আনন্দের সঙ্গী যখন নতুন কাপড় তখন তাঁতিদের চোখে ঘুম থাকবে কী করে। শনিবারের সমকাল তা-ই বলছে, পাবনায় তাঁতি সম্প্রদায়ের চোখে ঘুম নেই। তাঁতিরা এখন ব্যস্ত কাপড় বুননে। প্রতিবেদনে পাবনার কথা বলা হলেও দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তাঁতিরাও নিশ্চয়ই সমান ব্যস্ত। তাঁতপল্লীতে কেউ সুতা কাটছেন, কেউ সানা বাঁধছেন, কেউ সুতা রঙ করছেন। কেউবা শুকাচ্ছেন। এ ছাড়া তৈরি করা শাড়ির ওপর নান্দনিক শিল্পকর্ম, বল্গক, বর্ণিল সুতা ও চুমকির কাজ করছেন কেউ কেউ। প্রতিবেদক পাবনার সদর উপজেলার কয়েকটি গ্রামে সরেজমিন ঘুরে তাদের কাজকর্ম দেখেছেন। কেবল পাবনাই নয় সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, রংপুর, সিলেট প্রভৃতি এলাকায় তাঁতপল্লী রয়েছে। টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি তো জগৎজোড়া।
একসময় তাঁতিদের হাতে তৈরি হতো বিখ্যাত মসলিন কাপড়। সুতার সূক্ষ্মতা, বুননশৈলী ও নকশার বৈচিত্র্যে মসলিনের কদর ছিল বিশ্বব্যাপী। সে মসলিন এখন নেই, তার ঐতিহ্যে টিকে আছে জামদানি। আমাদের তাঁতপল্লীগুলোতে জামদানি, সুতি জামদানি, সুতি কাতান, চোষা, বেনারসি, শেঠ ইত্যাদি নানা রকমের শাড়ি তৈরি হয়। তবে তাঁতও নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে টিকে আছে। প্রান্তিক তাঁতিদের মাঝখানে ঢুকে গেছে মহাজন। সুতা বণ্টনের সুষ্ঠু নীতিমালার অভাব, মহাজনের কাছ থেকে উচ্চমূল্যে সুতা কেনা, কাপড়ের ভালো মূল্য না পাওয়া_ এসব কারণে কোনো কোনো এলাকার তাঁতশিল্পীরা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছেন।
এখন ঈদ এসেছে, তাঁত চাঙ্গা। সমকাল প্রতিবেদকের কাছে এক তাঁতি বলেছেন, সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় মহাজন তাঁত বন্ধ রেখেছিলেন। রোজার ঈদ সামনে রেখে আবার চালু করেছেন। ক্ষতি পুষিয়ে নিতে দিনরাত কাজ করছেন তারা। প্রতিবেদনে আরও এসেছে, পাবনার বিভিন্ন এলাকায় ঈদ সামনে রেখে প্রায় ৫০ হাজার তাঁত সচল হয়েছে। এতদিন এসব তাঁত বন্ধ ছিল। এটা দুঃখের খবর বটে। একদিকে আমরা জানছি, আমাদের তাঁতের শাড়ি যাচ্ছে আমেরিকা, কানাডা, ভারত, শ্রীলংকা, মালদ্বীপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে; অন্যদিকে এ প্রতিবেদন থেকেই জানছি, কেবল ঈদ বা উপলক্ষেই সচল হচ্ছে বন্ধ থাকা তাঁতকল। দুটি বিপরীতমুখী খবর হবে কেন? যে তাঁতের চাহিদা রয়েছে দেশে ও বিদেশে, সে তাঁত বন্ধ থাকবে কেন?
এটা ঠিক যে, যান্ত্রিক শিল্পের প্রতিযোগিতায় হস্তচালিত তাঁতশিল্প অন্তত দামের দিক থেকে পিছিয়ে পড়ছে। প্রযুক্তির গতির সঙ্গে হাতের গতির তাল মেলানোরও ব্যাপার রয়েছে। অনেকে বলছেন, তাঁতের শাড়ির চেয়ে ভারতের শাড়ির দাম কম থাকায় অনেক ক্রেতা সেদিকে ঝুঁকছেন। আবার মহাজনী চক্রের হাতে বন্দি হয়ে পড়ায় বিপণন ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না, তাতে আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের শাড়ি মার খাচ্ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ও সহজশর্তে ঋণ না পাওয়ার কারণে তাঁতশিল্প পিছিয়ে পড়ছে বলে বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
যদিও আমরা জানি, তাঁতশিল্পে সরকারের বিশেষ নজর রয়েছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড তাঁতশিল্পের সার্বিক উন্নয়নে কাজ করছে। তারপরও কেন প্রকৃত তাঁতিরা সুফল পাচ্ছে না তা খতিয়ে দেখা দরকার। তাঁতীদের হাতের সঙ্গে প্রযুক্তির মেলবন্ধনও জরুরি।
এখন ঈদ আসছে বলে কাজের চাপে তাঁতিদের চোখে ঘুম নেই। আবার ঈদ চলে গেলে হয়তো অনেকেরই কাজের অভাবে ঘুম থাকবে না। হয়তো বেছে নেবে অন্য কোনো কাজ। তা আমরা চাই না। প্রান্তিক পর্যায়ে তাঁতিরা সারা বছর কাজ করতে পারলে, সরকারের যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা, প্রশিক্ষণ, ঋণ, সুষ্ঠু বিপণন ব্যস্থাপনা ও ন্যায্য দাম পেলে তাঁতশিল্প আবার ঘুরে দাঁড়াবে। তখন তাঁতিরা নিশ্চয়ই শান্তিতে ঘুমোতে পারবেন।

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।