Mahfuzur Rahman Manik
জাতীয় শিক্ষানীতি ও শিক্ষায় ভাষা মাধ্যম
এপ্রিল 4, 2010

ভাষার মাস ফেব্রুয়ারি। এ মাসের আন্দোলনকে অনেকে বলেন ভাষা আন্দোলন। শুধু ভাষা আন্দোলন বললে ভাবটা পূর্নাঙ্গ হয়না, বলা উচিত রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলন। ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি। এ বছরের একুশ তারিখ সবে গত হলো। অবশ্য ফেব্রুয়ারি এখনও বিদ্যমান। ফেব্রুয়ারির সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা যে বাংলা পেয়েছি, সে সংগ্রাম আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯ সাল থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের সকল দেশ দিবসটি পালন না করলেও তারা জানে একুশে ফেব্রুয়ারিকে। অনেক দেশ দিবসটি পালনও করে। এ ফেব্রুয়ারি আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, চেতনা আর গর্বই নয়। আমাদের কন্ঠ, আলাদা জাতিসত্তার পরিচয়, স্বাধীন পতাকার সূতিকাগারও বটে।মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে প্রত্যেককে কথা বলতে হয়। প্রয়োজন পূরণে ব্যবহার করতে হয় ভাষা। পরস্পরের ভাব আদান প্রদানে, যোগাযোগে, চলতে-ফিরতে সর্বত্র ভাষার প্রয়োজন। ভাষা ব্যবহারের সবচেয়ে বড় যে ক্ষেত্র সেটি শিক্ষা। শিক্ষাগ্রহণ ও প্রদানে ভাষার ব্যবহার অনস্বীকার্য। শিক্ষার উপাদান হিসেবে শিক্ষক, শিক্ষার্থী, প্রতিষ্ঠান, বই ইত্যাদিকে চিহ্নিত করা হয়। এর বাইরে ভাষা যে কত গুরুত্বপূর্ণ তা অনেকেরই দৃষ্টি গোচর হয় না। ভাষার মাধ্যমেই একজন শিক্ষক শিক্ষা দেন। এ ভাষার বিষয়কে শিক্ষাবিজ্ঞানে বলা হয় ‘মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন’। এ মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন বা শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে ভাষার সার্থক ব্যবহারের মাধ্যমেই শিক্ষায় সফলতা আসে। স্বাভাবিকভাবেই এ ভাষা মাধ্যম শিক্ষায় ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম।আমাদের দেশে এ ভাষা মাধ্যম নিয়ে খুব কমই মাতামাতি হয়। ব্যতিক্রমটা ফেব্রুয়ারি। অর্থাৎ এ ফেব্রুয়ারিকে ঘিরে ভাষা মাধ্যম নিয়ে কিছু আলোচনা শোনা যায়।পৃথিবীর প্রায় প্রত্যেক দেশেই নিজস্ব ভাষায় শিক্ষা দেয়া হয়। আমাদের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। সংগ্রাম করে আমরা বাংলা পেয়েছি। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাই আমাদের শিক্ষার মাধ্যম হওয়া উচিত। এ শিক্ষার মাধ্যম নিয়ে এবারের শিক্ষানীতির নির্দেশনা কী? এর বাস্তবতাইবা কতটুকু ইত্যাদি নিয়ে আলোচনার প্রয়াস চালাচ্ছি। (যদিও শিক্ষানীতি এখনও খসড়াই রয়ে গেছে। চূড়ান্ত করার প্রক্রিয়া চলছে।)শিক্ষানীতিতে ভাষা মাধ্যম বা মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশনের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষাস্তর অনুযায়ী দেখা যাক। শিক্ষাস্তর তিনটি হলো প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং উচ্চশিক্ষা। অবশ্য প্রাথমিকের আগে প্রাক-প্রাথমিককে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রাথমিক স্তরের আগে বলে প্রাক-প্রাথমিকের আলোচনা প্রথমেই এসেছে। এ স্তরে ভাষার কথা স্পষ্ট না থাকলেও শিক্ষাদান পদ্ধতি এসেছে। শিক্ষানীতির দ্বিতীয় অধ্যায়ে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার কৌশল শিরোনামে বলা হয়েছে, ‘অন্যান্য গ্রহণযোগ্য উপায়ের সঙ্গে ছবি, রং, নানা ধরনের সহজ আকর্ষণীয় শিক্ষা উপকরণ, মডেল, হাতের কাজের সাথে সাথে ছড়া, গল্প, গান ও খেলার মাধ্যমে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হবে।’আসি প্রাথমিক শিক্ষায়। প্রাথমিক শিক্ষায় ও ভাষা মাধ্যম নিয়ে স্পষ্ট কিছু নেই। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য উদ্দেশ্যে শিক্ষাদান পদ্ধতি এবং আদিবাসিদের ভাষা নিয়ে স্পষ্ট বক্তব্য এসেছে। সংশ্লিষ্ট তিনটি লক্ষ্য উদ্দেশ্য হলো-‘মানবিক বিকাশ এবং দেশজ আবহ ও উপাদান ভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং অনুসরন করা।কয়েকটি মৌলিক বিষয়ে এবং অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি সব ধরনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হবে।প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে আদিবাসি সহ সকল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে।এরপর প্রাথমিক স্তরে শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যবস্তু শিরোনামে কিছু নির্দেশনা দেয়া আছে, এখানে বাংলার কথা বলা না থাকলেও ইংরেজির কথা বলা হয়েছে, ‘মানসম্পন্ন ইংরেজি লিখন কথনের লক্ষ্যে যথাযথ কার্যক্রম শুরু থেকেই গ্রহণ করা হবে এবং ক্রমান্বয়ে ওপরের শ্রেণীসমূহে প্রয়োজন অনুসারে জোরদার করা হবে।’মাধ্যমিকের ব্যাপারে শিক্ষানীতির চতুর্থ অধ্যায়ে বিবৃত হয়েছে। এ স্তরের কৌশল শিরোনামে প্রথমেই এসেছে শিক্ষার মাধ্যম। বলা হয়েছে, ‘শিক্ষার মাধ্যম এই পর্যায়ে মূলত বাংলা হবে। তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামর্থ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি ইংরেজি মাধ্যমেও শিক্ষা দেয়া যাবে। বিদেশীদের জন্য সহজ বাংলা শিক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা থাকা বাঞ্চনীয়।’মাধ্যমিকের পর উচ্চশিক্ষা। উচ্চ শিক্ষায় ভাষা নিয়ে আলোচনা এসেছে উচ্চশিক্ষার কৌশল হিসেবে। অনেকগুলো কৌশলের মধ্যে দুটি কৌশল ভাষা সংক্রান্ত। এর একটি হলো, ‘বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে সকল ডিগ্রি কোর্স পর্যায়ে ১০০ নম্বরের / ৩ ক্রেডিট ইংরেজি বিষয় সকল শিক্ষাথীর জন্য বাধ্যতামূলক হবে।’অন্যটি হলো-‘উচ্চশিক্ষার শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি হবে আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের। উচ্চশিক্ষায় বাংলা সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ইংরেজিসহ অন্যন্য ভাষায় রচিত আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা বাংলা ভাষায় ভাষান্তরিত হওয়া প্রয়োজন। এই কাজকে জাতীয়ভাবে গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। উচ্চশিক্ষায় ইংরেজির ব্যবহার চালু থাকবে।’ভাষা বিষয়ক সুপারিশের কথা বললে গোটা শিক্ষানীতিতে এই ছিলো বর্ণনা। এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বললেও স্পষ্ট করার বিষয় হলো সকল স্তরের ভাষা মাধ্যম হবে বাংলা। সকল স্তরে বাংলার সাথে যে ভাষার প্রয়োজন ছিলো তা বলা হয়েছে। যেমন আদিবাসিদের ভাষার কথা এসেছে, ইংরেজির ভূমিকাও কয়েক স্থানে বলা হয়েছে। তবে এটা ঠিক যে, এসব ভাষা বিষয়ক সুপারিশমালার মাধ্যমে বুঝা যাচ্ছে, শিক্ষার মাধ্যমের বিশেষ কোন গুরুত্ব এ শিক্ষানীতিতে নেই। কারণ এ বিষয়ে যা বলা হয়েছে সবই এমন ঢিলেঢালা, যার নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা করণীয় নির্ধারণ করা হয়নি।শিক্ষানীতির এসব সুপারিশের আলোচনা বাস্তবতার আলোকে দেখা যেতে পারে।প্রাক-প্রাথমিকের ভাষার কথা বলি আর বইয়ের কথা বলি, এখানে বলা হয়েছে ছবি, রং, সহজ শিক্ষা উপকরন আর ছড়া গল্পের কথা। মূলত: এ স্তরটিকে দেখানো হয়েছে প্রাথমিক শিক্ষার প্রস্তুতির স্তর হিসেবে। শহরে বিভিন্ন ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে দেখা যায় প্রাথমিকের আগেই তিনটি শ্রেণী কেজি, নার্সারী ইত্যাদি নামে এসব ক্লাসে শিক্ষানীতিতে বিদ্যমান কৌশলগুলো তো বস্তবায়ন হয়ই না বরং অনেক বোঝা শিক্ষার্থীদের মাথায় চাপিয়ে দেয়া হয়। আড়াই থেকে তিন বছরেই স্কুলে যাচ্ছে শিশুরা। বাংলা তো বটেই ইংরেজির নানা বইও শিশুদের পড়ানো হয়। শিক্ষানীতি এ স্তরের জন্য কোন কারিকুলাম করেনি। খেলাধুলা বা মজার মাধ্যমে বিদ্যালয়ে আসার অভ্যাস করানোর উদ্দেশ্য হলেও বাস্তবতা তো আমরা দেখছি।প্রাথমিক শিক্ষায় আসা যাক। এখানে ভাষা মাধ্যম হিসেবে বাংলার কথা স্পষ্ট না হলেও ‘দেশজ আবহ’ বলে একটা শব্দ এসেছে। এর দ্বারা শুধু বাংলাকেই অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, সাথে সাথে বাংলাদেশের সংস্কৃতির বিষয়টিও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। পাশাপাশি ইংরেজি বলা ও লেখার জন্য কার্যক্রম নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। এর সাথে আদিবাসিদের মাতৃভাষায় শিক্ষাকেও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।রাষ্ট্রভাষা ও মাতৃভাষা দুটি ভিন্ন বিষয়। প্রত্যেক মানুষেরই মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার অধিকার আছে। আমাদের শিক্ষানীতি আদিবাসিদের তাদের মাতৃভাষায় জ্ঞান চর্চার সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে সে অধিকারকেই স্বীকৃতি দিচ্ছে। তারা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা শিখবে মাতৃভাষা হিসেবে নিজেদের ভাষাতো আছেই।শিক্ষানীতি যে দেশজ আবহ ও উপাদান ভিত্তিক পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যপুস্তক রচনা এবং অনুসরণ করার কথা বলেছে, তার সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে, আমাদের দেশে গড়ে উঠেছে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল। একে তো বাংলার বা বাংলা ভাষার ছোঁয়া তো এখানে নেই, পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য, সমাজ-সংস্কৃতি সবই শেখানো হচ্ছে বাইরের বিশ্বে। শিক্ষার্থীরা বাংলাদেশে বসেই লালন করছে অন্যদের সংস্কৃতি। একটি বাস্তব ঘটনার কথা বলা যেতে পারেÑ বঙ্গবন্ধু (যমুনা) সেতুর উপর দিয়ে যাচ্ছে বাবা আর ইংলিশ মিডিয়ামে পড়–য়া ছেলে। বাবা ছেলেকে সেতুটা দেখিয়ে বলছে, এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সেতু আর যে নদীটা দেখছো এটি দেশের অন্যতম বড় নদী। ছেলে বাবার কথা শুনে বলেছে, নদীটি নিশ্চয়ই টেমস নদীর চেয়ে বড় হবে না? অর্থাৎ ছেলে যে টেমস নদী পড়ে এসেছে সেটাই তার কাছে বড়, টেমস যমুনার চেয়ে যতই ছোট হোক না কেন।এ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের ব্যাপারে শিক্ষানীতির ভূমিকা নিরব দর্শক বৈ কিছু নয়।শিক্ষানীতি প্রথম শ্রেণী থেকেই যে ইংরেজি বিষয়টি পড়ানোর কথা বলেছে তা নিয়ে অনেকেরই দ্বিমত রয়েছে। শিক্ষাস্তরের প্রথম থেকেই মাতৃভাষার বইতে এসে অন্য একটি ভাষা শিক্ষার্থীদের মাথায় উঠিয়ে দেয়া। একেতো বোঝা তার ওপর ভিন দেশি ভাষা। উন্নত বিশ্বের কোন দেশে প্রাথমিক স্তরেই মাতৃভাষার বাইরে অন্য ভাষা এভাবে শিখানো হয় না। জাপান, ফ্রান্স, স্পেন, রাশিয়া যার প্রকৃত উদাহরণ। যারা সাধারণ শিক্ষায় ইংরেজিই মেনে নিতে পারছেন না, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল মেনে নেয়ারতো প্রশ্নই উঠে না। এসব স্কুলের ব্যাপারে শিক্ষানীতির একটি দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ছিলো। অন্তত ইংরেজি ভাষায় আমাদের প্রাথমিকের সিলেবাসগুলো অনুবাদ করে বাধ্যতামূলকভাবে সকল প্রতিষ্ঠান পড়াবে। (এখনও কিছু কিছু ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে এ পদ্ধতি চালু আছে।) আর বাংলা বিষয়টা বাংলার শিক্ষক পড়াবে। এক্ষেত্রে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো যে আন্তর্জাতিক মান আনুসরণ করে আমাদের পাঠ্যপুস্তকগুলোও সে মানেই তৈরি হবে।মাধ্যমিক স্তরে এসে স্পষ্টভাবে প্রখম বাংলার কথা এসেছে, ‘শিক্ষার মাধ্যম এই পর্যায়ে মূলত বাংলা হবে, তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামর্থ অনুযায়ী নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি ইংরেজি মাধ্যমেও শিক্ষা দেয়া যাবে’। অর্থাৎ এ নীতি অনুযায়ী এ স্তরের মাধ্যম বাংলা। কিছু বিষয় ইংরেজিতে শিক্ষা দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের সামর্থ বলতে কি বুঝাতে চেয়েছে শিক্ষানীতি তা স্পষ্ট নয়। তবে এর দ্বারা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল যে বুঝানো হয়নি তা স্পষ্ট। নির্দিষ্ট পাঠ্যসূচি বলতে প্রাথমিক স্তর থেকে যেসব বিষয় ইংরেজিতে পড়ে আসছে সেগুলোই বুঝাবে এর সাথে হয়তো কিছু বিষয় বাড়তে পারে। এর মাধ্যমে বলা যায় মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষানীতি স্বীকৃত ভাষা মাধ্যম দুটি বাংলা এবং ইংরেজি।উচ্চশিক্ষায় ভাষা মাধ্যম হিসেবে মাধ্যমিকের মতো বাংলাটা এতো স্পষ্ট নয়। তবে বাংলার কথা এসেছে আন্যভাবে। বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজ লেভেলের উচ্চশিক্ষায় ইংরেজিতে নির্দিষ্ট ক্রেডিট পড়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কিন্তু বাংলার ব্যপারে এমন কোন ক্রেডিট বাধ্যতামূলক করা হয়নি। তবে বাংলাকে সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করতে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার গুরুত্বপুর্ণ রচনা বাংলায় ভাষান্তরিত করতে সুপারিশ এসেছে। উচ্চশিক্ষায় দুটি ভাগ দেখা যায়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে মিডিয়াম অব ইন্সট্রাকশন বাংলা ধরা হলেও বিভাগ আনুযায়ী ভিন্নতা দেখা যায়। যে বিষয়টি প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদ তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষা শিরোনামের প্রবন্ধে তুলে ধরেছেন, ‘সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও বাংলার স্থান প্রায় নেই। অর্থনীতি বা হিসেব বা আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বা বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিভাগ কিছুটা বেশি শক্তিমান, তাই সেগুলোতে বাংলার স্থান প্রায় নেই’। আর আমাদের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে তো বাংলা পাওয়াই দুষ্কর। ইংরেজি বলতে পারুক না পারুক অন্তত বাংলা চলে না। অবারও হুমায়ুন আজাদ ‘বাংলাদেশের অসাধারণ বিশ্ববিদ্যালয় বা মহাবিদ্যালয়গুলো অবস্থিত অনেকটা বাংলাভাষা এলাকার বাইরে; সেখানে বাংলার অধিকার নেই; কারণ সেগুলো খুবই শক্তিমান’।পড়ার বিষয় হিসেবে বাংলা প্রাইভেট বিশ্ববিদালয়ে নেই। কর্পোরেট মার্কেট চাহিদার বিষয়টি মাথায় নিয়ে বিবিএ ইংরেজি এমন দু’একটি বিষয় নিয়েই প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষানীতির এ ব্যাপারে তেমন কোন মাথাব্যথা পরিলক্ষিত হয়নি।ভাষা মাধ্যম নিয়ে চূড়ান্ত কোন কথা বলা না গেলেও বলা যায়, এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট কোন নীতি নেই। প্রাথমিক স্তর থেকেই শিক্ষার্থীরা বাংলা পড়ে আসছে, তার সাথে ইংরেজির লেজ তো লাগানো আছেই। এরপরও শিক্ষার্থীরা বাংলা ব্যবহার করতে জানে না, ইংরেজি তো অনেক দূরে। এর অর্থ ভাষা নিয়ে আমাদের পরিকল্পিত কোন চিন্তা নেই। গল্প কবিতার সিলেবাস বাস্তব ময়দানে কোন কাজ দেয় না। ভাষার যে চারটি দক্ষতা আছে শোনা, বলা, পড়া এবং লেখা এগুলোর আলোকে বাস্তবধর্মী সিলেবাস প্রণয়ন করা দরকার। এ লক্ষ্যে কয়েক বছর ধরে ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে কম্যুনিকেটিভ পদ্ধতিতে ইংরেজি বিষয়টি চালু হয়েছে। এ পদ্ধতিতে ইংরেজি ভাষার দক্ষতাগুলো আয়ত্ত আসার কথা থাকলেও কাংখিত ফল কিন্তু আসেনি। সমস্যাটা শিক্ষাদানে। আমাদের বিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষকরা পাঠ দেন, তাদের অধিকাংশেরই ইংরেজির এসব দক্ষতা বলতে গেলে শূন্য। ফলে পরীক্ষায় পাশ ছাড়া অন্য কোন উদ্দেশ্য হাসিল হয় না। আবার বাংলায় শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষে মানভাষা ব্যবহার করেন না। শিক্ষার্থীরাও শিখে না।উন্নত বিশ্বের অনেক দেশের মতো শুধু আমাদের রাষ্ট্রীয় ভাষা বাংলাকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসে একমাত্র শিক্ষার মাধ্যম করা সম্ভব নয়। তবে অনেকে এ কথা মানতে নারাজ। বাস্তবতা হলো, বর্তমান প্রযুক্তির পৃথিবীই বলি আর বিশ্বায়নই বলি গ্লোবাল ভিলেজে শুধু বাংলা নিয়ে বেঁচে থাকা বা সামনে এগিয়ে যাওয়া অনেক কঠিন। জাপান, ফ্রান্স, রাশিয়া বা অন্যান্য দেশ কিভাবে সম্ভব করেছে? প্রশ্নটা অস্বাভাবিক নয়। এসব দেশ তাদের মাতৃভাষাকে নিয়ে বিশেষ টার্গেটে এগিয়েছে। নিজেদের ভাষায় যেমন আধুনিক বিশ্বেও আপডেট গ্রন্থ রচনা করেছে। তাদের ভাষা ছাড়াও অন্য যে ভাষাতেই উন্নত কোন বই বা প্রকাশনা এসেছে সাথে নিজেদের ভাষায় অনুবাদ করে ফেলেছে। তাদের শিক্ষার্থীরা গোটা পৃথিবীর আপডেট জ্ঞানকে নিজের ভাষায় পেয়েছে। মাতৃভাষার মাধ্যমেই উন্নতি করেছে।আমাদের বাংলায় সমৃদ্ধ সাহিত্য বা বইয়ের অভাব নেই বটে কিন্তু এর বাইরে এর চেয়ে অনেক প্রকাশনা রয়েছে। যা আমরা বাংলায় অনুবাদ করতে পারিনি। পৃথিবী যত দ্রুত এগুচ্ছে সকল জ্ঞান ভা-ারকে বাংলায় অনুবাদ করে মাতৃভাষায় শিক্ষাদান সম্ভব নয়। উচ্চশিক্ষায় কৃষির কথা বলি, যারা দেশের মাটি, ফসল, খাদ্য নিয়ে গবেষণা করছে তাদের ইংরেজিতে রচিত বই পড়তে হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষায় বাংলায় কয়টা বই আছে? প্রকৌশলে কিংবা অন্যন্য বিষয়ে বাংলার কয়টা বই আমরা পাব?মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা নিয়ে অনেকেই জোর গলায় কথা বলেন। সেটা হলে ভালোও হতো, আমরা নিজেদের ভাষায় পড়ে দ্রুত উন্নতি করতে পারতাম। বিশ্বপরিক্রমায় বর্তমান পর্যায়ে সৎসাহস নিয়ে এ কথা বলাটা কঠিন। এ সাহস দেখানো যেতে পারে এখন থেকেও যদি পরিকল্পিতভাবে অগ্রসর হওয়া যায়। রিস্ক থেকেই যাবে, তবুও চ্যালেঞ্জ নেয়া যেতে পারে। প্রথম কাজটা হতে পারে ব্যুরো অব ট্রান্সলেশন অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অনুবাদ সংস্থা গড়ে তোলা। যেটি আধুৃনিক বিশ্বের জ্ঞান ভা-ারকে অনুবাদ করবে। দ্রুত গতিতে এ কাজকে এগিয়ে নিতে আমাদের মেধাবীদের বিভিন্ন দেশে পাঠিয়ে কিংবা প্রবাসী বাঙ্গালীদের কাজে লাগানো যেতে পারে। অনুবাদ বা ভাষান্তরের বিষয়টি শিক্ষানীতিতেও এসেছে,’ উচ্চশিক্ষায় বাংলা সম্প্রসারিত ও সমৃদ্ধ করার লক্ষ্যে ইংরেজিসহ অন্যান্য ভাষার রচিত আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের ব্যবহারযোগ্য গুরুত্বপূর্ণ রচনা বাংলা ভাষায় ভাষান্তরিত হওয়া প্রয়োজন।’এছাড়া আমাদের বিদ্যমান ব্যবস্থায়ও অগ্রসর হওয়া যায়। বাংলা এবং ইংরেজি যেভাবে শিক্ষার্থীরা একসাথে শিখছে সেটা থাকবে, তবে কারিকুলাম হবে বাস্তবমুখী। প্রাথমিক, মাধ্যমিক স্তর শেষ করার পর উচ্চশিক্ষায় ইংরেজি পড়তে যাতে কাউকে হোচট খেতে না হয়। সে কারিকুলাম শিক্ষার্থীর বয়স, মনন, বুদ্ধির আলোকে বাস্তবমুখী হবে। এর সাথে যোগ্য শিক্ষকম-লীরও সমাবেশ ঘটানো যেতে পারে। ২১ তারিখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট উদ্বোধন করেছেন। এ ইনস্টিটিউট সত্যিকারার্থে আমাদের মাতৃভাষা বাংলা নিয়ে গবেষণা করে, বাংলাকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়। শিক্ষানীতি আমাদের ভাষা মাধ্যমে যে কৌশল নির্ধারণ করেছে সেগুলোর বাস্তবায়ন এবং এ নীতি চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে বাস্তবমুখী কিছু ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে শিক্ষার মাধ্যমকে শক্তিশালী করা যায়।
দৈনিক ডেসটিনিতে প্রকাশিত ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১০
ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।