Mahfuzur Rahman Manik
ইসরায়েলি ‘জেনোসাইড’ প্রমাণ হলেও পশ্চিমারা নির্বাক
জানুয়ারি 3, 2025

জোনাথন কুক

নেতৃস্থানীয় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী সংস্থা চলতি মাসে তিনটি পৃথক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে গাজায় ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর ইসরায়েলি গণহত্যার ভয়ানক চিত্র ফুটে উঠেছে। আরও সঠিকভাবে বললে, এতদিন যেটা দৃশ্যত স্পষ্ট ছিল, এখন তারা নিশ্চিত করেছে, গত ১৪ মাস ধরে ইসরায়েল সামরিক অস্ত্র দিয়ে নির্বিচারে হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করছে। একই সময়ে অনাহারে রেখে ধীরে ধীরে তাদের মৃত্যুমুখে পতিত করেছে। এমনকি তাদের চিকিৎসা পর্যন্ত করাতে দেয়নি।

গ্যাস চেম্বারের বিষ দিয়ে কিংবা ছুরি দিয়ে গণহত্যা সংঘটিত হতে পারে। অথবা ২০০০ পাউন্ড বোমা ফেলে কিংবা সাহায্য বন্ধ করার মাধ্যমেও গণহত্যা ঘটানো যায়। গণহত্যা যেভাবেই ঘটুক, এর উদ্দেশ্য একটি জনগোষ্ঠীকে নির্মূল করা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ও মেডিসিনস সানস ফ্রন্টিয়ার্স (এমএসএফ)– এই তিনটি সংস্থা এ ব্যাপারে একমত, এই নির্মূলের চেষ্টাই করছে ইসরায়েল। দেশটি তার এই অভিপ্রায় গোপন রাখেনি এবং এই সেটে তার কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই নিশ্চিত হয়েছে। এ বিষয়টি যারা ইচ্ছাকৃত অন্ধ, তারা এখনও অগ্রাহ্য করছে। যেমন পশ্চিমা রাজনীতিবিদ এবং তাদের দোসর সংবাদমাধ্যম। অগ্রাহ্য করার চেয়েও ভয়ানক বিষয় হলো, তারা মানবতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত এই অপরাধে ইসরায়েলকে প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, বুদ্ধিমত্তা ও কূটনৈতিকভাবে সাহায্য করছে।
গত সপ্তাহে এমএসএফ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যার শিরোনাম– ‘লাইফ ইন দ্য ডেথ ট্র্যাপ দ্যাট ইজ গাজা’। অর্থাৎ ‘গাজায় মৃত্যুফাঁদে যে জীবন’। সংস্থাটি পর্যবেক্ষণে বলেছে, ‘ইসরায়েলি বাহিনীর সহিংসতা এমন মাত্রায় শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে; চিকিৎসা দিয়ে ভালো করা কঠিন। ১৭ বছরের দীর্ঘ অবরোধ দিয়ে ইসরায়েল স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে।’ এমএসএফের ভাষায়– ইসরায়েল যদি আজ এই আক্রমণ বন্ধ করে, ধ্বংসের মাত্রা বিবেচনায় এটা চিন্তা করাও কঠিন যে, গাজাবাসীর তা সারাতে ঠিক কত সময় লাগবে।

এমএসএফের ১৮৫ পাতার পর্যবেক্ষণের পরই হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদন প্রকাশ হয়, যেখানে সংস্থাটি এই উপসংহারে পৌঁছেছে, ইসরায়েল ‘গণহত্যামূলক কাজ’ করছে। একটি নীতিকে তারা গুরুত্ব দিচ্ছে যে, ইসরায়েল গাজাবাসীকে পানির অধিকার থেকে বঞ্চিত করার পদ্ধতিগত চেষ্টা চালিয়েছে। উদ্দেশ্যমূলক এই কর্মকাণ্ডের সাহায্যে যে গণমৃত্যু ঘটেছে, সেটা জেনোসাইড। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মধ্যপ্রাচ্যের ডিরেক্টর লামা ফাকিহ বলেছেন, তাদের গবেষণায় প্রমাণিত, ইসরায়েল ‘ইচ্ছাকৃত গাজাবাসীকে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় পানি না দিয়ে হত্যা করছে।’ ইসরায়েল চারটি পদক্ষেপের মাধ্যমে সমন্বিতভাবে এটি করেছে। তারা গাজার বাইরে থেকে পানি সরবরাহকারী পাইপলাইন বন্ধ করেছে। এর পর গাজার নিজস্ব কূপ ও প্লান্ট থেকে পাম্পের মাধ্যমে যাতে পানি সরবরাহ করতে না পারে, সে জন্য বিদ্যুৎ বন্ধ করে দেয়। এমনকি তারা সৌর প্যানেল ধ্বংস করে, যা ছিল বিদ্যুতের বিকল্প ব্যবস্থা এবং সর্বশেষ বিদ্যুৎ মেরামতকারী ক্রু ও পানি সরবরাহে চেষ্টাকারী সংস্থার কর্মীদেরও তারা হত্যা করে। ইসরায়েল এবং ফিলিস্তিন-বিষয়ক এইচআরডব্লিউর ভারপ্রাপ্ত পরিচালক বিল ভ্যান এসভেল্ড বলেছেন, গাজাবাসী যাতে পানি না পায়, সে জন্য ‘সর্বতোভাবে পানি পেতে বাধা দেওয়ার নীতি তারা গ্রহণ করে।’ তিনি যোগ করেছেন, তার মানে ইসরায়েল খুব স্পষ্টভাবে জাতিগত নির্মূলের চেষ্টা করেছে।

এইচআরডব্লিউর কণ্ঠই প্রতিধ্বনিত হয়েছে বিশ্বের খ্যাতিমান আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের বিস্তৃত প্রতিবেদনে। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রকাশিত ২৯৬ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে অ্যামনেস্টি এই উপসংহারে পৌঁছেছে, ইসরায়েল গাজায় ‘বেপরোয়াভাবে, ক্রমাগত’ গণহত্যা চালাচ্ছ বা ‘নরকে পরিণত করছে’, সংস্থাটি ছবির মাধ্যমে একে আরও সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছে। অ্যামনেস্টি এই গবেষণা করেছিল জুলাই মাসে তথা পাঁচ মাস আগে। এর পরও ইসরায়েল উত্তর গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ আরও জোরদার করেছে, যাতে সেখানকার নাগরিকদের জোর করে বের করে দেওয়া যায়।
এর পরও অ্যামনেস্টি ‘আচরণের ধরন’ বর্ণনায় লিখেছে, ইসরায়েল পরিকল্পিতভাবে ত্রাণ সাহায্য ও বিদ্যুৎ সরবরাহে বাধা দেয় এবং ছিটমহলের মতো ছোট্ট পরিসরের গাজায় এত বেশি বিস্ফোরক দ্রব্যের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, যা দুটির বেশি পারমাণবিক বোমা বিস্ফোরণতুল্য। যে কারণে গাজার পানি, পয়োনিষ্কাশন, খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ধসে পড়ে। আক্রমণের মাত্রা এত বেশি ছিল, সংস্থাটি এটি বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে, যেখানে একুশ শতকের অন্য কোনো সংঘাতের তুলনায় এর গতি, মৃত্যু ও ধ্বংসযজ্ঞের তুলনাই চলে না। অ্যামনেস্টি বলেছে, গত মে মাসে রাফায় ইসরায়েল ‘নিরাপদ জোনে’ যে ধ্বংসযজ্ঞ চালায়, তাতেই এর জেনোসাইডের অভিপ্রায় প্রমাণ হয়ে যায়। এমনকি ইসরায়েলকে তখন বিশ্বের সর্বোচ্চ আদালত ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসও (আইসিজে) রাফায় আক্রমণ করার জন্য সতর্ক করেছিল; কিন্তু ইসরায়েল তা মানেনি।

জোনাথন কুক: ব্রিটিশ লেখক; মিডল ইস্ট আই থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক

সমকালে প্রকাশ: ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

ট্যাগঃ

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।